১৯৬৪ সালে মার্শাল ম্যাকলুহান বলেছিলেন, মিডিয়াম ইজ দ্য মেসেজ। অর্থাৎ বাহনই হলো বার্তা। মাত্র চার শব্দের এই বাক্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সহস্র শব্দের মর্মার্থ। আর ছয় দশক আগে বলা সেই কথা সময়ের সঙ্গে যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। বিশ্বায়নের যুগে এই চার শব্দের একটা বাক্য ডালপালা মেলে আরও বেশি সত্য আর মূর্ত হয়ে ধরা দিচ্ছে। এখন আর বিনোদনকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আটকে রাখা যাবে না। ডিজিটাল কনটেন্টগুলো তাই নির্মিত হচ্ছে নির্দিষ্ট দেশের, শ্রেণির, ভাষার দর্শকদের জন্য নয়, বরং বিশ্বের দর্শকদের জন্য। বাংলাদেশের মানুষ তাই বাংলাদেশি, ভারতীয় বা মার্কিন কনটেন্ট ছাড়াও ঝুঁকেছে কোরিয়া, জাপান, ইতালি, স্প্যানের চলচ্চিত্র, ওয়েব সিরিজ আর গানের প্রতি।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ব্লক চেইন, আইওটি, ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, রোবটিকস, মাইক্রোপ্রসেসর ডিজাইনের মত ক্ষেত্রগুলোতে জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথে নেতৃত্ব দিতে সবাইকে এক সাথে উদ্ভাবনের পথে একযোগে কাজ করতে হবে, তাহলেই আমরা এগিয়ে যাব। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার, বিদ্যুতের ব্যবহার এবং ট্রানজিস্টার আবিষ্কার ব্যাপক শিল্পায়ন সৃষ্টির মাধ্যমে মানবসভ্যতার গতিপথ বদলে দিয়েছিল বলে ওই তিন ঘটনাকে তিনটি শিল্পবিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখন বলা হচ্ছে, ডিজিটাল প্রযুক্তির নিত্যনতুন উদ্ভাবনের পথ ধরে আসছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, যেখানে বহু প্রযুক্তির এক ফিউশনে ভৌতজগৎ, ডিজিটালজগৎ আর জীবজগত পরস্পরের মধ্যে লীন হয়ে যাচ্ছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শুধু আমাদের কর্মজীবনেই পরিবর্তন করছে না, পাল্টে দিচ্ছে সবকিছুকেই। এটি প্রভাব ফেলবে আমাদের পরিচয় সত্তায় এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সব কিছুতে, আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তায়, আমাদের সম্পদ মালিকানার ধরনে, আমাদের ভোগের ধরনে, আমাদের কাজ ও বিশ্রামের সময়ে, আমাদের কর্মজীবন গড়ায়, আমাদের দক্ষতা চর্চায়, মানুষের সাথে সাক্ষাতে এবং আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কে। এই পরিবর্তন তালিকা অন্তহীন। এটি সীমিত একমাত্র আমাদের কল্পনায়। অনেকের ব্যক্তিগত জীবনে প্রযুক্তিকে স্বাগত জানানোর ব্যাপারে প্রবল উৎসাহ। কিন্তু এরা কখনো কখনো অবাক হন, আমাদের জীবনে এই অদম্য প্রযুক্তির সমন্বয় ধ্বংস করে দিতে পারে আমাদের কিছু অতি প্রয়োজনীয় পরিপূর্ণ মানবিক গুণাবলি, যেমন- সমবেদনা ও সহযোগিতা। এ ক্ষেত্রে আমাদের স্মার্টফোন একটি বিবেচ্য। অব্যাহত সংযুক্তি আমাদের বঞ্চিত করতে পারে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ থেকে : একটু থামার, প্রতিফলন ঘটানোর ও অর্থপূর্ণ কথাবার্তা বলার সময়।
ব্যক্তিজীবনে নতুন প্রযুক্তি যে চ্যালেঞ্জটি নিয়ে এসেছে বা আনবে তা হচ্ছে, আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বিনষ্ট হওয়া।
আমরা তাৎক্ষণিকভাবেই বুঝতে পারি, কেন এটি এতটা অপরিহার্য। এর পরও আমাদের সম্পর্কিত তথ্যের ওপর নজরদারি ও বিনিময় হচ্ছে নতুন কানেক্টিভিটির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মৌলিক বিষয়ে বিতর্ক, যেমন আমাদের অন্তর্জীবনে এর প্রভাব হবে আমাদের ডাটার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ আসছে বছরগুলোতে আরো জোরদার হবে। একইভাবে, জৈবপ্রযুক্তি তথা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিতে ঘটে চলা বিপ্লব আমাদের বর্তমান জীবনকাল, স্বাস্থ্য, বোধশক্তি ও সক্ষমতাকে পেছনে ঠেলে দিয়ে মানুষ হওয়ার সংজ্ঞা পাল্টে দিচ্ছে। বিষয়টি আমাদের বাধ্য করবে নৈতিক ও জীবনবিধান সম্পর্কিত সীমানা নতুন করে নির্ধারণে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সাথে আসা প্রযুক্তি কিংবা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একটি বাহ্যিক শক্তি, যার কোনোটির ওপরই তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এ কাজটি আমরা করছি আমাদের নাগরিক, ভোক্তা ও বিনিয়োগকারী হিসেবে প্রতিদিনের সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায়। অতএব, আমাদের সুযোগ ও ক্ষমতা কাজে লাগাতে হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে নতুন আকার দেয়ায় এবং তাকে এমন এক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে হবে, যাতে প্রতিফলন থাকে মানবজাতির অভিন্ন লক্ষ্য ও মূল্যবোধের। নিজেদেও জন্যই সব কিছুতেই।
প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে কম্পিউটার সহজলভ্য হয়েছে এবং এক সময় মানুষ তার নিজের ব্যক্তিগত কাজের জন্য কম্পিউটার ব্যবহার করতে শুরু করে। কম্পিউটার যখন শক্তিশালী হয়েছে তখন এটি শুধু লেখালেখি বা হিসাব নিকাশের জন্য ব্যবহৃত না হয়ে ধীরে ধীরে বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে। গান, চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র সবকিছু এখন কম্পিউটার দিয়ে করা যায়। তথ্য প্রযুক্তির কারণে বিনোদনের গ্রহণের প্রক্রিয়াটিতে যে রকম পরিবর্তন এসেছে ঠিক সেরকম পরিবর্তন এসেছে বিনোদনের বিষয়গুলোতে। সঙ্গীতকে ডিজিটাল রূপ দেওয়ায় এখন আমরা কম্পিউটারে গান শুনতে পারি। ঠিক একই ভাবে আমরা ভিডিও বা চলচ্চিত্র দেখতে পারি। সিডি রম কিংবা ভিডিও বের হওয়ার পর সেখানে বিশাল পরিমাণ এর তথ্য রাখা সম্ভব হয়েছে। সিনেমা হলে না গিয়ে ঘরে বসে কম্পিউটার কিংবা টেলিভিশনে সিনেমা দেখা এখন খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার। তথ্য প্রযুক্তির উন্নতি হবার পর নতুন কিছু বিনোদনের জন্ম হয়েছে যেটি আগে উপভোগ করা সম্ভব ছিল না, তার একটা হচ্ছে কম্পিউটার গেমস।
সারা পৃথিবীতে এখন কম্পিউটার গেমের বিশাল শিল্প তৈরি হয়েছে এবং নানা ধরনের কম্পিউটার গেম এর জন্ম হয়েছে। কম্পিউটার গেমসের ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে আন্দাজ করা যায় এটি বিনোদনের অন্তত সফল একটি মাধ্যম এর সাফল্যের একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে এটি ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক লোকজন ও তার রুচি মতো আনন্দ দিতে পারে পারে। নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কম্পিউটার গেমস একজন আরেকজনের সাথে খেলা যায় এমনকি দেশের বাইরের কারো সাথে খেলা যায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এই বিনোদন উপভোগ এর তীব্রতা এত বেশি হতে পারে যে, সেটি এক ধরনের আসক্তির জন্ম দিতে পারে, তাই সারা পৃথিবীতে কম্পিউটার গেমস খেলার ব্যপারে সতর্ক থাকার কথা বলা হয়েছে।
ধরুন বিনোদন জগতের কথা, এখন ‘অডিও’ শব্দটি সঙ্গীত ভুবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। অন্তত লিরিক্যাল ভিডিও প্রকাশনা শুর হওয়ার পর- এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়। একক গানের প্রসারে শিল্পী, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, প্রকাশকসহ কম গানের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সবাই অডিওর বদলে ভিডিওকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। যদিও পূর্ণাঙ্গ মিউজিক ভিডিও প্রকাশের আগে কেউ কেউ লিরিক্যাল ভিডিও প্রকাশ করছেন, তবে স্বল্প সময়ের জন্য। অ্যালবাম প্রকাশনা স্থবির হয়ে যাওয়ায় গান প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে ভিডিও। এতে অবশ্য দর্শক-শ্রোতা হতাশ নন, বরং সময়ের সঙ্গে গান প্রকাশের ধারা বদলে যাওয়ার বিষয়টি সহজ ও স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন তারা। অবশ্য কেউ কেউ গানের সঙ্গে আলাদা করে ভিডিও নির্মাণের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। তাদের কথায়, গান দেখার নয়, শোনা এবং অনুভবের বিষয়। যখন কেউ গান শোনেন তখন তার মনের ক্যানভাসে আপনা-আপনি কিছু দৃশ্য ভেসে ওঠে। আলাদা করে তাই মিউজিক ভিডিও নির্মাণের প্রয়োজন নেই। তবে সাধারণ মানুষ কিন্তু মনের অজান্তেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাবের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করেছেন।
মানুষ এখন ইনটারনেটের মাধ্যমে অডিও ভিডিও দু’টোই দেখতে ও শুনতে পারছেন। অডিওর স্থান মিউজিক ভিডিও দখল করে নেওয়া এবং তা কতটা দর্শক-শ্রোতার মাঝে প্রভাব ফেলছে? এমন প্রশ্নে তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু সবকিছুর পর এটাই সত্যি যে, অডিওর চাহিদা ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বেশি নয়, গত দেড় বছরের গান প্রকাশের তালিকায় চোখ রাখলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে আসলে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মিউজিক ভিডিও হয়ে উঠেছে সঙ্গীতপ্রেমীর চাহিদার অন্যতম উপকরণ। মিউজিক ভিডিওতে কত বৈচিত্র্য তুলে ধরা যেতে পারে, তার উদাহরণ দেখিয়েছেন নির্মাতারা। ‘গানের সুর-সঙ্গীতের পাশাপাশি গীতিকথার গল্পকে কত বৈচিত্র্যময়, রোমাঞ্চকর ও হৃদয়স্পর্শী করে তোলা যায়, তারই উদাহরণ মিউজিক ভিডিও। এখন যেহেতু মুঠোফোনের সুবাদে সবকিছু হাতের মুঠোয়, তখন আর শোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। গান হয়ে উঠেছে শ্রোতা ও দর্শকের। এখনকার মিউজিক ভিডিওগুলোকে ছোটখাটো চলচ্চিত্র বলা যায়। চলচ্চিত্রের মতোই নানা ধরনের গল্প নিয়ে ভিডিও নির্মিত হচ্ছে।
এখন মিউজিক ভিডিও নির্মাণে পরিবর্তন ঘটেছে। ভালো গান করার জন্য যেমন যথেষ্ট সময় নিয়ে কাজ করতে হয়, তেমনই ভিডিও নির্মাণে বড় বাজেট এবং সময় নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। মিউজিক ভিডিওর দর্শক কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ায় প্রতিটি কাজই ক্রমে চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। ‘চার থেকে সাত মিনিট ব্যাপ্তির গানে একটি গল্প তুলে ধরা কঠিন কাজ। সে কাজটিই করতে হচ্ছে এখনকার মিউজিক ভিডিওতে। গল্প তুলে ধরা শুধু নয়; ভিডিও নান্দনিক করে তুলতেও এর পেছনে প্রচুর সময় দিতে হচ্ছে। গায়ক-গায়িকাকে দিয়ে অভিনয়ও করাতে হচ্ছে। কিন্তু সেটা এমনভাবে উপস্থাপন করতে হচ্ছে, যাতে কারও এটা মনে না হয়, গানের চরিত্রগুলোয় চেনা-জানা মানুষের ছায়া নেই। খেয়াল করলে দেখবেন, চলচ্চিত্রের মতো গানের ভিডিওতে কমেডি, অ্যাকশন, ফ্যামিলি ড্রামা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেও তুলে আনা হচ্ছে। এ কারণেই হয়তো একের পর এক মিউজিক ভিডিওর দর্শক সংখ্যা কোটি অতিক্রম করছে।’ সমকালীন শিল্পী, সুরকার, সঙ্গীতায়োজক, ভিডিও নির্মাতা, মডেল- সবার কথায় একটা বিষয় স্পষ্ট, গানের ভেতরে গল্প যদি নান্দনিকভাবে পর্দায় তুলে ধরা যায়, তাহলে তা অগণিত দর্শকের মন জয় করবে। ‘গান যতটা শোনার, ততটাই দেখার বিষয় হয়ে উঠেছে এখন। যে জন্য অডিওর জায়গাটা পুরোপুরি দখল করে নিচ্ছে মিউজিক ভিডিও। এর প্রথম কারণ ভিডিওতে এখন অনেকে নানা ধরনের গল্প দেখার সুযোগ পাচ্ছেন।
যে কারণে অনেকে মিউজিক ভিডিওকে গানের ছবি বলেও উল্লেখ করছেন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে এবং সময়ের সঙ্গে শ্রোতার চাহিদা বদলে গেছে। ক্যাসেট ও সিডি প্লেয়ারের যুগ শেষ। এখন গান শোনার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন। যেখানে ভিডিও দেখার সুযোগ থাকছে। তাই দর্শক-শ্রোতা চান, স্বল্প সময়ের ব্যাপ্তির কোনো গল্পের চিত্রায়ণ। এটা নাটক বা সিনেমায় সম্ভব নয়। যে জন্য গানের ভিডিও এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।’ শিল্পী, সুরকার, গানের প্রকাশক, মিউজিক ভিডিও নির্মাতাদের এমন মন্তব্য থেকে এটাই স্পষ্ট, গান প্রকাশের এখন অন্যতম মাধ্যম মিউজিক ভিডিও। অডিও অনেকে শোনেন, কিন্তু ভিডিওর চাহিদা যত বাড়ছে তাতে ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে অডিও প্রকাশনা। গানের ভুবনে এখন তাই ভিডিওর জয় জয়কার আর সাধারণ মানুষ স্বাগত জানাচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে। ইতোমধ্যেই আমাদের চারপাশের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সদর্প পদচারণা দেখতে পাই আজকের এই দিনে। ব্যাপক হারে বাড়ছে কম্পিউটিং পাওয়ার। বিশ্ব অর্থনীতিতে চলছে অটোমেশনের জয়জয়কার।
গত কয়েক দশকে বদলে গেছে বিশ্ব। অন্য সবকিছুর সঙ্গে অবধারিতভাবে পরিবর্তন এসেছে বিনোদনমাধ্যমে। প্রযুক্তির কল্যাণে বিনোদনমাধ্যমে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে গেছে বিনোদন গ্রহণের ক্ষেত্রে। সিনেমা হল, টিভি, ডিভিডি ছাড়িয়ে বিনোদন স্থান করে নিয়েছে ডিজিটাল স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে। একটা স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই যে কেউ জামার পকেটে নিয়ে ঘুরতে পারে বিশ্বের বিনোদনের জগৎ।
একটা দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ আর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অ্যাকাউন্ট থাকলেই হাতের মুঠোয় চলে আসছে দেশি-বিদেশি হাজারো কনটেন্ট। আবার প্রতিটি প্ল্যাটফর্মেই পুরোনো আর ক্ল্যাসিক প্রযোজনার পাশাপাশি থাকছে তাদের নিজস্ব মৌলিক কনটেন্ট। একেকটি প্ল্যাটফর্ম কিছু কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে নিজেদের আকর্ষণীয় করে তুলছে সবার কাছে। হলে সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে কত রকম ঝক্কি-যানজট ঠেলে হলে যাওয়া, টিকিট কাটা বা নির্দিষ্ট শোর সময় মেনে সিনেমা দেখার বাধ্যবাধকতা। এই সব ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো। বিশেষ করে তাদের মৌলিক প্রযোজনাগুলো। ডিজিটালভাবে মুক্তি পাওয়া মাত্রই একযোগে সেসব দেখার সুযোগ পাচ্ছেন সারা বিশ্বের দর্শক।
টিভি সিরিজের ক্ষেত্রেও এসেছে বড় পরিবর্তন। সপ্তাহজুড়ে অপেক্ষায় থেকে একটি একটি করে নতুন পর্ব দেখার দিন শেষ। এমন বার্তাই দিচ্ছে নেটফ্লিক্সের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো। কোনো অপেক্ষার বালাই নেই, মুক্তির দিনেই সব এক বসায় দেখে ফেলার সুযোগ আছে এই প্ল্যাটফর্মে। ফলে গ্রাহকেরা শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে, জ্যামে থেমে, চলন্ত গাড়িতে যখন সময় মিলছে, টপাটপ দেখে ফেলছেন জনপ্রিয় ধারাবাহিকের একেকটা পর্ব। একেকটা অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম দর্শকদের দিয়েছে বিনোদনের স্বাধীনতা, অর্থাৎ স্বাধীনভাবে বিনোদন বেছে নেওয়ার সুযোগ।
কেবল আলংকারিক নয়, আক্ষরিক অর্থেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস বা ব্রিটিশ লাইব্রেরির মতো; যেখানে ঢোকার সুযোগ করে নিতে পারলেই পুরো রাজ্যের বিনোদন চলে আসে নাগালে। এত পদের কনটেন্ট দেখে আপনি দ্বিধাগ্রস্ত, বুঝতেই পারছেন না কী দেখবেন? কোনটা রেখে কোনটা দেখবেন? কোনো সমস্যা নেই। রেটিং দেখুন। বা পছন্দের ঘরানা বেছে নিয়ে একটি একটি করে দেখতে থাকুন। ভালো না লাগলে বাদ। অন্য আরেকটি চালু করুন। জোর কওে কেউ কিছু গেলাবে না আপনাকে। এভাবেই বিনোদন গ্রহণের ক্ষেত্রে সময় এবং স্থানের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিয়েছে অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো। বিশ্বের আর সব দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কদও বেড়েছে ডিজিটাল স্ট্রিমিং সাইটের। ‘হইচই’, ‘বায়োস্কোপ’, ‘বঙ্গ’, ‘আইফ্লিক্স’ কিংবা ‘জি–ফাইভ’-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ক্রমেই দখল করে নিচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলোর জায়গা। বিশেষ করে বিজ্ঞাপন বিভ্রাট আর সময়ের বাধ্যবাধকতামুক্ত থাকায় দেশীয় দর্শক ক্রমেই ঝুঁকছেন ডিজিটাল মাধ্যমে।
বিনোদন নিয়ে কেবল দর্শকের রুচির পরিবর্তনই নয়, নির্মাণ আর বিনোদনের সঙ্গে যুক্ত সবার ক্ষেত্রেই আমূল পরিবর্তন এনেছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। তরুণ একজন নির্মাতার এখন আর টিভিতে ভালো স্পট পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। চলচ্চিত্র নির্মাতারা এখন আর হল পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত নন। প্রযোজকেরাও লগ্নির অর্থ নিয়ে এখন বেশ স্বস্তিতেই আছেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের প্রসারে। লাভের গুড়ে ভাগ বসানোর সুযোগও নেই মধ্যস্বত্বভোগীদের।
পরিবর্তনই একমাত্র ধ্রুব সত্যি। সেই সত্যি মেনে সময়ের সঙ্গে সবকিছুই বদলে যায়। বদলে যায় বিশ্ব আর বিশ্বের সবকিছু। বদলে যায় মানুষের জীবন, জীবনযাপন, দর্শক আর দর্শকদের রুচি। আর সবকিছুর সঙ্গে অবধারিতভাবে বদলে যায় বিনোদন। পরিবর্তিত এই বিনোদনজগতে মানুষ যে আগের চেয়ে স্বাধীন ও সহজভাবে বিনোদন পাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতি মুহূর্তে ওপরের দিকে উঠতে থাকা জনপ্রিয়তার পারদই নীরবে চিৎকার করে তার প্রমাণ দিচ্ছে। পুরো প্রযুক্তি শিল্পজুড়ে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, অনেক শিল্প খাতই নতুন প্রযুক্তি সূচনা করেছে, যা বিদ্যমান চাহিদা পূরণ করবে পুরোপুরি নতুন উপায়ে গ্রাহকেরাই ক্রমবর্ধমান হারে চলে আসছে ভৌতপণ্য অথবা সেবা এখন জোরদার করা যাবে ডিজিটাল সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে, নাগরিক সাধারণ তাদের অভিমত তুলে ধরার সুযোগ পাবে, এমনকি জনগণ সরকারি কর্তৃপক্ষকেও তত্ত্বাবধান করবে। একই সাথে সরকার অর্জন করবে নয়া প্রাযুক্তিক ক্ষমতা, যার মাধ্যমে সরকার জনগোষ্ঠীর ওপর অধিকতর নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পাবে। সব কিছুই নির্ভর করে মানুষ ও মানবজাতির মূল্যবোধের ওপর।
আমাদের প্রয়োজন মানবজাতির জন্য এমন একটি ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ, যা আমাদের সবার জন্য উপকার বয়ে আনে, আমাদের জন্য তা কার্যকর প্রমাণিত হয়। জোর দিতে হবে মানুষের ওপর এবং মানুষের ক্ষমতায়নের ওপর। সবচেয়ে উচ্চাকাক্সক্ষী ডিহিউম্যানাইজড আকারের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের হয়তো সম্ভাবনা আছে মানবজাতিকে রোবটায়িত করার। মানবপ্রকৃতি-সৃজনশীলতা, সহমর্মিতা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বের সর্বোত্তম অংশ হচ্ছে একটি নতুন ধরনের যৌথ নৈতিকতা বোধ, যার ভিত্তি আমাদের পরিণতি বোধ। সেটি নিশ্চিত করাই আমাদের সবার দায়িত্ব। আর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এটি আমাদের কারো ভুলে থাকার অবকাশ নেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি