জাতির পিতা ২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে কাটানোর পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে ৯ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশের উদ্দেশে রওনা হলেন। সকাল সাড়ে ৬টায় পৌঁছান লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে। সকাল ১০টার পর থেকে বঙ্গবন্ধু কথা বলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের সঙ্গে। পরে ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর একটি বিমানে করে পরের দিন ৯ জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন। ১০ জানুয়ারি সকালে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেন। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্রিংকসভা, প্রধান নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা হিসেবে।’
অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি আসে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু, ফিরে আসেন স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়। বিমানটি তেজগাঁও বিমানবন্দর স্পর্শ করে বিকেল ৩টায়। বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু জনতার মহাসমুদ্রের উদ্দেশে হাত নাড়েন। তাঁর চোখে তখন স্বজন হারানোর বেদনা-ভারাক্রান্ত অশ্রুর নদী, আর জ্যোতির্ময় দ্যুতি ছড়ানো মুখাবয়ব জুড়ে বিজয়ী বীরের পরিতৃপ্তির হাসি। বিমানের সিঁড়ি বেয়ে জাতির জনক তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সম্মান জানানো হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
চারদিক থেকে তাঁর ওপর পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকে। বাংলাদেশ সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী রাষ্র্নপ্রধানকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু সালাম গ্রহণ করেন। এ সময় বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণী ওসমানী, লে. কর্নেল শফিউল্লাহ্ এবং বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল জাতির জনকের পাশে ছিলেন। এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে সেখানে স্থাপিত মঞ্চে প্রায় কুড়ি মিনিটের সেই আবেগঘন বক্তৃতায় তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দিদশায় তিনি ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন, বাঙালিকে কেউ ‘দাবায়ে রাখতে’ পারবে না। “যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কি-না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।”
বাঙালিদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বিশ্বনেতারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। পরাজিত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক চাপে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। দেশে ফেরার দিন বঙ্গবন্ধু সেদিন উৎফুল্ল জনতার উদ্দেশ্যে ডাক দেন আরেক যুদ্ধের। সেই যুদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার। তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। কিন্তু সমস্ত জীবন দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন, বাঙালি চাইলে যে কোনো অসাধ্য সাধন করতে পারে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন দেশে নগর ও গ্রামের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষিবিপ্লব, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতায়ন, কুটিরশিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল পরিবর্তন সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে শুধু অঙ্গীকারই করেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে তা অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তিনি স্থায়ী ও দৃঢ় প্রত্যয়নে অঙ্গীকার করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, অর্থাৎ আমাদের এই দেশ অপার সম্ভাবনাময় একটি দেশ। তিনি তাঁর মেধা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। তিনি দেখলেন সব সুযোগ-সুবিধা শহরকেন্দ্রিক। তিনি বাংলাদেশের গ্রামগুলোকে আধুনিক ও পরিকল্পিত গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখলেন। কাউকে পেছনে ফেলে না রেখে এগিয়ে যাওয়া এই নীতি ও আদর্শকে সামনে রেখে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
বাংলার জনগণ বঙ্গবন্ধুর দেয়া ৩৫টি নির্দেশনাকে যুদ্ধ চলাকালীন অবশ্য করণীয় কর্তব্য হিসেবে পালন করে। এসব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে প্রশাসন, শিক্ষা, আইন-শৃংখলা রক্ষা, বন্দর কার্যক্রম, বৈদেশিক বাণিজ্য, যোগাযোগ, কৃষি, সেবা, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্প-কারখানা নির্মাণ, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক ও ট্রেজারি চালান, কর আদায়, বীমা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অবসরকালীন ভাতা প্রদান, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাতা প্রদান ইত্যাদি।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ভাষণে বঙ্গবন্ধু একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে উন্নীত করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর তালিকা তৈরি করেন। তিনি সবার আগে অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে নজর দেন। কারণ সেসময় দেশব্যাপী জনগণকে সহায়তা প্রদান ও ব্যবসা পরিচালনার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার পুন:নির্মাণ খুবই জরুরি ছিলো। জাতির জনক একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে আপসহীন ছিলেন। তিনি বলেন, আমি আমার অফিসারদের হুঁশিয়ার করছি কেউ যেন ঘুষ না নেয়। এই মাটিতে দুর্নীতিকে কোনভাবেই মেনে নেয়া হবে না।
তাঁর ভাষণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ছিলো সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখা। তিনি জনগণকে শান্তি বজায় রাখার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের অবশ্যই শান্তি বজায় রাখতে হবে। শান্তিপ্রিয় বাঙালি স্বাধীনতার জন্য অনেক রক্ত ঝরিয়েছে। তারা শান্তি রক্ষা করতেও জানে। বক্তৃতায় তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বললেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ অসাম্প্র্রদায়িক রাষ্ট্র হবে।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির ব্যাপারেও জাতির জনক সজাগ ছিলেন। তিনি তাঁর ভাষণে বৈদেশিক নীতির মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা দেন। তিনি বলেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ জাতির জনক একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণের দিক নির্দেশনা দেন যেখানে দল-মত নির্বিশেষে সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে। তিনি বলেন, ‘আমি স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই বাংলাদেশ একটি ধর্ম নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হবে’।
সঠিক দিক নির্দেশনা ছাড়া জাতি পুনঃর্গঠন হলে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের মানুষ যদি পর্যাপ্ত খাদ্য না পায়, মা-বোনদের যদি কাপড় না জোটে এবং যুব সমাজ যদি কাজ না পায় তাহলে আমাদের এই স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।’ সশ্রদ্ধ চিত্তে বঙ্গবন্ধু সবার ত্যাগের কথা স্মরণ করেন এবং সবাইকে দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করে বলেন, ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ তোমাদের মোবারকবাদ জানাই তোমরা গেরিলা হয়েছ, তোমরা রক্ত দিয়েছ, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।’
‘একটা কথা- আজ থেকে বাংলায় যেন আর চুরি-ডাকাতি না হয়। বাংলায় যেন আর লুটতরাজ না হয়। বাংলায় যারা অন্য লোক আছে অন্য দেশের লোক, পশ্চিম পাকিস্তানের লোক বাংলায় কথা বলে না, তাদের বলছি তোমরা বাঙালি হয়ে যাও। আর আমি আমার ভাইদের বলছি তাদের ওপর হাত তুলো না, আমরা মানুষ, মানুষকে ভালোবাসি। তবে যারা দালালি করেছে, যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে’ উল্লেখ করে জাতির পিতা বলেন, ‘তাদের বাংলার স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেন, একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই স্বাধীন দেশে স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে। আমি দেখিয়ে দিতে চাই দুনিয়ার কাছে শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।’
একে এক অস্ত্র জমা নেওয়া, পাকিস্তানি সৈন্যদের ফিরিয়ে দেওয়া, ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের ফিরিয়ে দেওয়া, বিদেশের সাথে দ্রুত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা, দেশকে তাঁর স্বপ্নমতো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সকল কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন খুব অল্প দিনের মধ্যেই।
দেশের কৃষক শ্রেণি ও কৃষি ব্যবস্থার ভাগ্য পরিবর্তন ও আমূল সংস্কারের জন্য স্বাধীনতা লাভের পরপরই ৩৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বা নামমাত্রমূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন; এ দেশের কৃষকদের প্রকৃত বন্ধু ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর অসামান্য আরো অনেক অবদানের মধ্যে রয়েছে : দেশের ৫৮০টি শিল্পকারখানাসহ পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সব সম্পদ জাতীয়করণ, হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মসংস্থান, মাদ্রাসা বোর্ডের পুনর্গঠনসহ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট স্থাপন এবং মদ, জুয়া, রেসকোর্সে ঘোড়াদৌড় প্রতিযোগিতাসহ সমাজবিরোধী অনেক কার্যকলাপ দক্ষতার সঙ্গে কঠোর হস্তে বন্ধ করার মতো দুঃসাধ্য কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনন্য প্রজ্ঞাসমৃদ্ধ নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশ খুব দ্রুততম যুদ্ধ বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে বিদ্যমান ক্ষতসমূহ মুছে উন্নয়নের পথে চলতে শুরু করে।
আজকের বাংলাদেশের যে সমৃদ্ধি, উন্নয়নের মহাসোপানে যে অভিযাত্রা তার সূচনা করেছিলেন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু । এ দেশের মানুষের কথা তিনি ভাবতেন সব সময়। কীভাবে এ দেশের মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে, উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবনযাপন করতে পারবে সেই সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন মাত্র কয়েক বছরেই।
তিনি বলেন আমার দেশের প্রতি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে উন্নত জীবনের অধিকারী হবে- এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা সমবায়ের পথ-সমাজতন্ত্রের পথ, গণতন্ত্রের পথ। সমবায়ের মাধ্যমে গরীব কৃষকরা যৌথভাবে উৎপাদন-যন্ত্রের মালিকানা লাভ করবে। অন্যদিকে অধিকতর উৎপাদন বৃদ্ধি ও সম্পদের সুষম বণ্টন ব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষুদ্র্র চাষী গণতান্ত্রিক অংশ ও অধিকার পাবে। জোতদার ধনী চাষীর শোষণ থেকে তারা মুক্তি লাভ করবে সমবায়ের সংহত শক্তির দ্বারা। একই ভাবে কৃষক, শ্রমিক, তাঁতী, জেলে, ক্ষদ্র্র ব্যবসায়ীরা যদি একজোট হয়ে পুঁজি এবং অন্যান্য উৎপাদনের মাধ্যমে একত্র করতে পারেন তবে আর মধ্যবর্তী ধনিক ব্যবসায়ী-শিল্পপতির গোষ্ঠী তাদের শ্রমের ফসলকে লুট করে খেতে পারবে না। সমবায়ের মাধ্যমে গ্রাম-বাংলায় গড়ে উঠবে ক্ষুদ্র শিল্প যার মালিক হবে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক এবং ভূমিহীন নির্যাতনের শিকার দুঃখী মানুষ। সমাজতন্ত্র স্থাপনের জন্য আমরা ইতিমধ্যেই সমস্ত বড় শিল্প, ব্যাংক, পাটকল, চিনিকল, সূতাকল ইত্যাদি জাতীয়করণ করেছি। জমির সর্বোচ্চ মালিকানার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছি। আজ সমবায় পদ্ধতিতে গ্রামে গ্রামে, থানায়, বন্দরে গড়ে তুলতে হবে মেহনতী মানুষের যৌথ মালিকানা। কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত ফসলের বিনিময়ে পাবে ন্যায্যমূল্য, শ্রমিকরা পাবে শ্রমের ফল-ভোগের ন্যায্য অধিকার।
কিন্তু এই লক্ষ্যে যদি আমাদের পৌঁছাতে হয় তবে অতীতের ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে এক সত্যিকারের গণমুখী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। অতীতের সমবায় ছিল শোষক-গোষ্ঠীর ক্রীড়নক। তাই সেখানে ছিল কোটারী স্বার্থের ব্যাপক ভূমিকা।
জেলে সমিতি, তাঁতী সমিতি, গ্রামীণ কৃষক সমিতি যেন সত্যিকারের জেলে, তাঁতী, কৃষকের সংস্থা হয়, মধ্যবর্তী ব্যবসায়ী বা ধনী কৃষক যেন আবার এই সমিতিগুলিকে দখল করে অতীত দুর্নীতির পুনরাবৃত্তি না করে। যদি আবার সেই কোটারী স্বার্থ সমবায়ের পবিত্রতা নষ্ট করে, তবে নিশ্চিতভাবে জেনে রাখুন যে আমরা সমস্ত পুরাতন ব্যবস্থা বাতিল করে দেবো। আমার প্রিয় কৃষক মজুর জেলে তাঁতী ভাইদের সাহায্যে এমন একটি নুতন ও সুসম ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যা শোষণ ও প্রতিক্রিয়াশীল কোটারী স্বার্থকে চিরদিনের জন্য নস্যাৎ করে দেবে।
বাংলাদেশ আমার স্বপ্ন, ধ্যান, ধারণা ও আরাধনার ধন। আর সেই সোনার বাংলা ঘুমিয়ে আছে চির অবহেলিত গ্রামের আনাচে কানাচে, চির উপেক্ষিত পল্লী গ্রামে, বিস্তীর্ণ জলাভূমির আশে পাশে আর সুবিশাল অরণ্যের গভীরে। ভাইয়েরা আমার- আসুন সমবায়ের যাদুস্পর্শে সুপ্ত গ্রাম বাংলাকে জাগিয়ে তুলি। নব-সৃষ্টির উন্মাদনায় আর জীবনের জয়গানে তাকে মুখরিত করি। আমাদের সংঘবদ্ধ জনশক্তির সমবেত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলতে হবে ‘সোনার বাংলা’। এ দায়িত্ব সমগ্র জাতির, প্রত্যেক সাধারণ মানুষের এবং তাঁদের প্রতিনিধিদের। তবেই আমার স্বপ্ন সার্থক হবে, সার্থক হবে শহীদের আত্মত্যাগ, সার্থক হবে মাতার শ্রম। রাজনৈতিক স্বাধীনতা তার সত্যিকারের অর্থ খুঁজে পাবে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদে, আপামর জনসাধারণের ভাগ্যোন্নয়নে। তবেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে রূপায়িত হবে সমাজতান্ত্রিক নীতির এবং সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাবো সমবায়ের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তুলতে হবে।
জাতির জনকের দু’টি স্বপ্ন ছিল- বাংলাদেশ স্বাধীন করা এবং দেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। আমাদের তিনি স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং তাঁর দ্বিতীয় স্বপ্ন পূরণ করছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে এবং বাংলাদেশ ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত দেশের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করেছে। বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। কিন্তু আজ আমরা বাঙালি হিসেবে অনেক বেশি গর্ববোধ করি। কারণ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একে একে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল করে চলেছেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক