ভাতের দানা
– মোহীত উল আলম
কৃষকের ধান মাঠে পড়ে আছে। ধান কাটার লোক নেই। এজন্য সরকার দলীয় নেতা কর্মীরা, বিভিন্ন নির্বাচিত জন-প্রতিনিধি, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার লোকজন এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ধান কাটার কাজে সোৎসাহে নেমে পড়েছেন। টিভির নিউজগুলোতে এ দৃশ্যগুলি ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। আবার জোরালো প্রচারের জন্য লোক-দেখানো ভিডিও ফুটেজও তৈরি করে ভাইরাল করা হচ্ছে। আর এ ধরনের কর্মকান্ডের বিরোধিতা করে এর ব্যাপক সমালোচনাও চোখে পড়ছে। ভিডিও ট্রলও হচ্ছে। ব্যাপারটা হাসি-ঠাট্টার বিষয় বলেও অনেকের কাছে মনে হয়েছে।
কিন্তু আমার মনে হয়েছে ব্যাপারটার মধ্যে বড় একটি ইতিবাচক দিকও আছে। বিশেষ করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বয়সে তরুণ। ধান কাটার মতো পরিশ্রমী একটি মৌলিক কাজে জড়িয়ে পড়লে তাদের ভবিষ্যত জীবনে কী এর একটি দীর্ঘ ছাপ পড়বে না? মানুষতো আর রোবট না যে সে একটা কাজে নামবে আর সে কাজের অভিঘাত তার চেতনায় নতুন উৎসাহের সৃষ্টি করবে না। ধানের চারা রোপন করা, চারা থেকে বীজতলা সাজানো, সে বীজতলা থেকে জমিতে ধানগাছ লাগানো, সে ধানগাছের যত্ন নেওয়া, বড় হয়ে পাকতে শুরু করলে ধান কাটার ব্যবস্থা করা—এই বহুস্তরের কর্ম শৃঙ্ক্ষলা কৃষকসমাজ প্রায় বিনা বাক্যব্যয়ে সারা বছরেই করে যাচ্ছে। আমাদের ছাত্রসমাজের সিংহভাগ এই কৃষি সম্প্রদায় থেকে উঠে এসেছে। কাজেই জমি, ধান, ফলন এগুলির সঙ্গে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কমবেশি পরিচয় আছে। এই পরিচিতির কথা ছাড়াও আমি যে পরিচিতির কথা বলতে চাইছি সেটি হচ্ছে দেশপ্রেমজাত অণুপ্রেরণা। যে একবার ধানের গোছা মুঠো করে হাতে ধরেছে, আর গাছিতে কাস্তে লাগিয়েছে, তার কি একবার ধানের প্রতি প্রেম জন্মাবেনা? ধানের উৎপাদনের সময় মাঠ পর্যায়ে যেহেতু গরিব চাষি এবং কামলারা যুক্ত, সে জন্য ধানের প্রতি নতুন জেগে ওঠা প্রেম কি গরিবের জন্য প্রেমের সৃষ্টি করবে না? অনেকেই হয়তো এটা পুরোপুরি অলীক কল্পনা বলে আমার প্রত্যয়কে নাকচ করে দিতে পারেন, কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, তরুণদের মধ্যে এই ধরনের কাজ সত্যিই দেশের জন্য ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়।
কাজেই, ধানকাটার সহায়তায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নেমে পড়ায় তার মধ্যে আমি বিরাট ইতিবাচকতা দেখতে পাচ্ছি। হয়তো করোনা চলে যাবে, কিন্তু যুবাদের এই কাজে নামার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত না করে এটার একটি স্থায়ী রূপরেখা তৈরি করে যুবসমাজকে দেশগঠনে ধারাবাহিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। যেমন এটা করা যায় কীনা, প্রতি বোরো মৌসুমে ধান কাটার সময় পর্যায়ক্রমে অঞ্চলভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমর্থ-বয়সী শিক্ষার্থীদের যার যার জীবনে একবারের জন্য ধান কাটার কাজে নিযুক্ত করা।
এপ্র্রিলের শেষের দিকে এবং মে মাসের প্রথম দিকে বোরো ধান পাকতে থাকে। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন প্রধান ধান হিসেবে আমন এবং আউশের উল্লেখ থাকলেও শেষ লাইনে উল্লেখ থাকতো ‘বোরো’ নামক একটি ধানের, যার ফলন হয় শীত কালে, তাও অল্প-স্বল্প। অর্থাৎ আগে বাংলাদেশের জমি ছিলো দু’ফসলী। কিন্তু ত্রিশাল গ্রামটিতে আমি চারটি বছর থাকার পর বুঝতে পেরেছি, বাংলাদেশ এখন তিন ফসলী জমির দেশ, এবং বস্তুত বোরো ধানেরই চাষ হয় সর্বাধিক। আমন ধানটা পরিণত হয় অক্টোবরের শেষের দিকে, এবং পাকে নভেম্বরে, এবং তখন শীতও নেমে পড়ে আর শুরু হয় নবান্নের উৎসব। কিন্তু আমার দেখায় আমন ধানটা বর্ষার ফসল বিধায় এর রূপ প্রত্যক্ষ করতে হয় বৃষ্টি-ভেজা, জলে ডোবা অবস্থায়। অন্যদিকে বোরো প্রায় শীতের মাঝখান থেকে শুরু করে বড় হতে হতে বসন্ত পার করিয়ে গ্রীষ্মের প্রথম দিকে পাকতে শুরু করে। সে জন্য প্রখর রোদ আর প্রকৃতির বাসন্তিক ফুলেল রূপের মধ্যে দিগন্তবিস্তৃত জমিকে জমি (চট্টগ্রামে ভাষায় দোনকে দোন) বোরো ধান এমন সোনালী-শ্যামল রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয় যে বাংলাদেশের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য আমরা কেবলই অতৃপ্ত দৃষ্টিতে অবলোকন করতে থাকি। সে জন্য, আমার ত্রিশাল বাসের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলছি, আমনের গভীর সবুজ জলজ রূপের চেয়েও বোরোর মাঠ জুড়ে শুকনো দীপ্তিময় স্বর্ণাভ আভা-কাজ করছে যেসব যুবক করোনার বিরতিতে–তাদের মনকে ছুঁয়ে যাবে।
তবে ধানের সোনালী সৌন্দর্যের তলায় লুকিয়ে আছে কঠিন অর্থনৈতিক সত্য। বঞ্চনার ইতিহাস, শোষণের ইতিহাস, মানুষের ঘাম রক্তে পরিণত হওয়ার ইতিহাস।
অর্থনৈতিক চক্রটি এখানে কঠিন সংঘর্ষময়। যে চাষা জমিতে ধান বুনছে, জমিটা তার নয়—সে হয় বর্গা খাটছে, কিংবা কামলার কাজ করছে। লাঙ্গলটাও তার নয়, গরুটাও তার নয়। অর্থাৎ তার ঘামটা টাকায় পরিণত হয়ে তার কাছে আসছেনা, যাচ্ছে জমির মালিকের পকেটে। আবার ক্ষুদ্র চাষী আছে, জমি হয়তো আছে, কিন্তু ধান ফলনের পুঁজি নেই। আবার বড় চাষীদের জমিতে হয়তো যন্ত্রের সাহায্যে জমিতে সেচ দেওয়া থেকে শুরু করে ট্রাক্টর দিয়ে জমি নিংড়ানো এবং ধান কাটার কাজও হয়ে থাকে। বস্তুত ত্রিশালে লাঙ্গল আর গরুর চেয়েও বেশি চোখে পড়তো ট্রাক্টর জাতীয় কৃষিযানগুলো। সম্ভবত এটা সারা কৃষি-বাংলাদেশেরই এখনকার ছবি। ত্রিশালে আরো দেখতাম জল সরবরাহের যন্ত্রটা জমির মালিকেরা ভাগাভাগি করে নিয়ে পর্যায়ক্রমে সকল জমিতে সেচ কাজ সম্পন্ন করে নিতেন।
তবে, জমিতে চাষীর প্রত্যক্ষ শ্রমের বিপরীতে তার কম মজুরি পাবার কথা, কিংবা শ্রমিকের শ্রমের বিনিময়ে কারখানায় তার কম মজুরির পাবার কথা, অর্থাৎ চাষী বা শ্রমিককে ঠকানোর তত্ত্ব নিয়ে দার্শনিক কার্ল মার্কস তাঁর বিখ্যাত বাড়তি মূল্য তত্ত্ব বা থিওরি অব সারপ্লাস ভ্যালু কথাটির ব্যাখ্যা দেন—এবং এই ব্যাখ্যাটি মানবজীবনের জন্য এক করুণ বর্ণনা।
আমি মার্কসের ব্যাখ্যাটি হয়তো বিভিন্ন প্রসঙ্গে ছুটোছাটাভাবে পড়েছি, অর্থনীতির একটি দুরূহ তত্ত্ব এটি। তাই আমি যে ভাবে সহজভাবে বুঝি, সেভাবে বলি। যেমন ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ানোর সময় ওয়াশিংটনের একটি বিরাট মলে ঘুরতে ঘুরতে আমি আর আমার স্ত্রী আবিস্কার করলাম যে প্রায় মেনস আর উইমেনস গার্মেন্টসের প্রাইস ট্যাগের সাথে লেখা আছে ’মেইড ইন বাংলাদেশ’। বিশাল গর্ব হলো। তবে সাথে সাথে মনের আয়নায় ভেসে উঠল আমার গরিব বস্ত্র শ্রমিক ভাইদের কথা। এই বস্ত্রগুলি আমেরিকার বাজারে সাধারণত ১৫/২০ ডলারের মধ্যে প্রাপ্তব্য। আমরা আত্মীয়স্বজনের জন্য কিনলাম, নিজেদের জন্যও কিনলাম। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কাঁদলাম। কারণ ২০ ডলারের একটি ট্রাউজারের জন্য আমি বাংলাদেশী টাকায় দিলাম ২০ পূরণ ৮০= ১৬০০ টাকা। কিন্তু একজন নারায়নগঞ্জের বস্ত্র শ্রমিক হয়তো মাসে আট থেকে দশ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছে। পুরো মাসে সে হয়তো তার কারখানায় যেখানে তার অবস্থান সেখান থেকে সে ধরলাম দশ হাজার ট্রাউজার তৈরি করল। অর্থাৎ শুধু তার একার শ্রমের সহায়তায় কারখানার দেশী সরবরাহকারী এবং বিদেশের চালান-আদেশকারী মালিক মাসে শুধু একজন শ্রমিকের নির্ধারিত শ্রমের বিনিময়ে পেল ১০০০০ পূরণ ১৬০০= ১ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা, আর শ্রমিক পেল মাত্র দশ হাজার টাকা। মালিকের উৎপাদনের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বাদ দিলেও তার লাভের পুঁজি জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। এখানে মার্কস যে কথাটি বলতে চেয়েছেন, সেটি হলো শ্রমিকের শ্রমের বিনিময়ে যে লাভটা হচ্ছে সেটা নয়, কিন্তু শ্রমিকের কাজের দক্ষতার বিনিময়ে লাভটা (বা অতিরিক্ত অর্থটা আসছে।)। অর্থাৎ মালিক তার শ্রমের বিপরীতে একটি পারিশ্রমিক দিচ্ছেন এটার মধ্যে কোন ঠকানি নেই, কিন্তু তার দক্ষতার বিনিময়ে অর্থাৎ তার সৃজনশীল কর্মতৎপরতার জন্য কোন পারিশ্রমিক সে পাচ্ছে না। এইটি হচ্ছে সেই উদ্বৃত্ত মূল্য যেটি মালিকই ভোগ করছে কিন্তু যে শ্রম দিচ্ছে সে ভোগ করতে পারছে না। মার্কসের এই তত্ত্ব আরো বলে পুঁজিবাদী সমাজে এই প্রক্রিয়ার ফলে শ্রমিক এবং লাভের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় তার থেকে সামাজিক অসন্তোষ তৈরি হয়। বিপ্লব ঘটে যায়। সাহিত্যে আমরা যে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতাবোধ (alienation) বলে একটি বিষয়ের সম্মুখীন হই, সেটির ব্যাখ্যাও এই মার্কসীয় রীতিতে দেওয়া সম্ভব বলে আমার মনে হয়।
ওপরের ব্যাখ্যাটি কারখানার ব্যাপারে যেমন, তেমনি জমি চাষের বেলায়ও সত্য। তবে যেটা অমানবিকভাবে বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়, সেটি হলো জমিদার চাষী ছাড়া জমিতে ফলন ফলাতে পারবে না, আবার চাষীও জমিতে ফসল না ফলিয়ে পারবে না। তা হলেতো তার উপার্জন থাকবে না। এখানেই –অর্থাৎ সামাজিক অর্থনীতির মধ্যে এই বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে শোষণের সৃষ্টি হয়।
আরেকটি নিদারুণ ছবি দেখি: চাউল বা ভাতের দানা বাজারে সস্তা হলে আমরা খুশি হই, কিন্তু কৃষকের মাথায় হাত পড়ে।
বাংলাদেশের সামাজিক অর্থনীতি—আমি যতোটুকু বুঝি—বড় পুঁজিতে নেই, হয়তো এখন হচ্ছে, যেমন জাহাজ বানাচ্ছে, সাইকেল বানাচ্ছে ইত্যাদি। কিন্তু এখানে মধ্যম শ্রেনির বিশাল পুঁজির সৃষ্টি হয়েছে, সেজন্য কর্মেরও সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম দিকের বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশ বহু গুণে আলাদা, এবং কৃষি থেকে কৃষি শিল্পায়নেও আমাদের বহু অগ্রগতি হচ্ছে, ফলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হারও বেড়েছে। দারিদ্র বহুলাংশে লোপ পেয়েছে।
এরকম একটি সম্ভাবনাময় প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থী শ্রেনি যদি ধান কাটার কাজে নামে, আমার মনে হয় এটি একটি ইতিবাচক শুরু।
পরিশেষে ২০০১ সালে প্রকাশিত আমার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ “এ পাড়ে অপার টান”-এ ছাপানো “ভাতের দানা” শীর্ষক কবিতাটি আজকের লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিধায় এখানে দিয়ে দিলাম:
ভাতের দানা
মোহীত উল আলম
আমি ক্রমশ ভাতের দানার কাছে কেমন উবু
হয়ে পড়েছি, নতজানু হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইছি।
ছোটবেলায় হাঁপানী-নানী বলতেন,
’খবরদার একটি ভাতের দানাও যেন
মাটিতে না পড়ে—গুনাহ্ হবে।।’ কী
মমতা দিয়ে কম্পিতহাতে তিনি মাটি থেকে
দানা খুঁটে তুলতেন, কী পূত শৃঙ্ক্ষলা।
ভাতের কাছে যেতে আমার লজ্জা করে।
এক একটা ইতিহাস এক একটা দানা।
ভাতে তোমাদের ঘাম মিশে আছে।
ভাতের দানা লক্ষ লক্ষ আয়না
আঙ্গুল ছোঁওয়াতে পারি না, নোয়ানো শরীর
অমনি উঠে আসে, তোমাদের শিরাময় বৌ
তাদের বাচ্চা-কিলবিল সহিষ্ণু পেট।
হরতালবিহীন তোমাদের অফুরন্ত দিবস।
আমার আরাম, বৌ কোলে রাখা স্বভাব,
ছিঁচ-কাঁদুনে নিয়ম-নীতি, ভূলুণ্ঠিত হয়—
কেবল একটি ভাতের দানার কাছে
পবিত্র হতে চায়, নতজানু হয়ে বলতে
চায়, ‘বলো কী করলে এ গুনাহ্
থেকে মুক্ত হতে পারি।
আর প্রলম্বিত করুণ সুরে বাজে শ্যামল বাংলা।
৪ মে ২০২০।
মোহীত উল আলম-সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর-
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ।