শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : শোক থেকে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা – ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম

১৭ মে ১৯৮১ সাল। ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটি ছিল সরকারী ছুটির দিন। সবার লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিমান বন্দর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত জনতার ভীড় জমা শুরু হয় সকাল থেকেই। ভীড়ের বিবরণ পাওয়া যায় দৈনিক ইত্তেফাকের পাতা থেকে। পত্রিকাটিতে লেখা হয় “ ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স এর বিমানটি আসিয়া পৌঁছে বিকাল সাড়ে ৪টায়। কিন্তু বিমান বন্দরে দেশের বিভিন্ন স্থান হইতে আগত জনতার ভীড় জমিতে থাকে বেলা ১২ টা হইতেই। বিমানবন্দরের রানওয়ে, টারমার্ক ও বিমানবন্দর প্রাঙ্গণ হইতে শেওড়াবাড়ী পযন্ত এলাকা জুড়িয়া দুপুর হইতে অপেক্ষমান দলীয় সমর্থকরা তাহাকে অভ্যর্থনা জানান। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে সভানেত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে বিমান হইতে ট্রাকে নামাইয়া নেন। পুলিশের ধাওয়া সত্ত্বেও শ্লোগানমুখর জনতা বার বার বিমান ও ট্রাককে ঘিরিয়া অধীর হইয়া উঠে।”

প্রায় ছয় বছর পরে দেশে ফিরেছিলেন এক বেদনা বিধূর ভগ্ন হ্নদয় নিয়ে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী (হাসিনা) শেখ হাসিনা বিমানবন্দর থেকেই চলে যান বনানী কবরস্থানে। মায়ের ও নিহত পরিজনের কবরস্থানে গিয়ে আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

আগস্টের শোকের ছায়ায় নিজের বাবা মা ভাইদের ও পরিজনদের হারানোর শোক উথলে উঠলো পুর্ণবার। জিয়ারত শেষে মায়ের কবরের পাশে গিয়ে স্বগতোক্তি করেন, “ মা, আমাকে কেন রাখিয়া গেলে?” তিনি যেদিকে তাকান, সেটি যেন শোকে মূহ্যমান। পরিবেশ বড়ই অচেনা, অজানা। কিন্তু তিনি সাহস পেলেন। ঠিক যেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার মতো-

ওহে দয়াময়, নিখিল-আশ্রয় এ ধরা-পানে চাও—
পতিত যে জন করিছে রোদন, পতিতপাবন,
তাহারে উঠাও।
মরণে যে জন করেছে বরণ তাহারে বাঁচাও

কত দুখ শোক,কাঁদে কত লোক,নয়ন মুছাও।
ভাঙিয়া আলয় হেরে শূন্যময়। কোথায় আশ্রয়—
তারে ঘরে ডেকে নাও।
প্রেমের তৃষায় হৃদয় শুকায়, দাও প্রেমসুধা দাও

হেরো কোথা যায়, কার পানে চায়। নয়নে আঁধার—
নাহি হেরে দিক, আকুল পথিক চাহে চারি ধার।
এ ঘোর গহনে অন্ধ সে নয়নে তোমার কিরণে
আঁধার ঘুচাও।
সঙ্গহারা জনে রাখিয়া চরণে বাসনা পূরাও “

তাইতো সেদিনের সম্বর্ধনা সভার শুরুতেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বললেন “ আসুন, আবার আমরা এক হই।” ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করতে তিনি জনতার উদ্দেশ্যে কান্না বিজড়িত কন্ঠে আরো বললেন, “ আপনাদের কাছে আমি বিচার চাই।” বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার এই দাবী ছিল অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত, গ্রহণযোগ্য এবং প্রাসঙ্গিক। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনে তদানীন্তন ক্ষমতাসীনরা বিচারকে কুক্ষিগত করেছিল আইনের বেড়াজাল দিয়ে (ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করে)। পুরস্কৃত করা হয়েছিল কুখ্যাত খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরীর মাধ্যমে।

১৯৮১ সালের ১৭ মে তারিখের আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে শেরে বাংলা নগরের সুপ্রশস্ত মানিক মিয়া এভিনিউয়ের সম্বর্ধনা সভায় তিনি বক্তৃতা করেন মাত্র আধঘন্টা। যদিও সেদিন বক্তৃতার পরিবেশ ছিল না। সম্বর্ধনা সভায় বৈদ্যুতিক আলোহীন অন্ধকার এবং ঝড় বৃষ্টির দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার বৈরি পরিবেশেও জনতা ছিল অধীর। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনাও জনগণকে প্রতিশ্রুতি দেন অত্যন্ত সাদামাটা ভাষায়।

বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বারবার অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। আবেগমথিত সেই বক্তৃতায় তিনি বললেন, “ আমি নেতা নই, সাধারণ মেয়ে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার একজন কর্মী। আপনাদের কাছে থাকিয়া বঙ্গবন্ধুর ‘ সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য আপনাদের লইয়া আমি নিরলস সংগ্রাম চালাইয়া যাইব।” সমাবেশে উপস্থিত শ্রোতাদের মুহুমুর্হু শ্লোগানে শেখ হাসিনা গণতন্ত্র ও সোনার বাংলার স্বপ্ন এবং বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচীর বাস্তবায়নের প্রত্যয় ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন ।
প্রথম দিন থেকেই তিনি সংগ্রাম ও আন্দোলনের জন্য জনগণকে সঙ্গে থাকতে বলেছিলেন। তাঁর বক্তৃতার উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছিল: “ তিনি জনগণকে লইয়া ‘ সোনার বাংলার স্বপ্ন’ রূপায়ণের লক্ষ্যে সংগ্রাম সূচনার অঙ্গীকার দিয়া বলেন, সেইদিন ‘ ৭৫ এর হত্যার বিচার হইবে, যেদিন বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী বাস্তবায়িত হইবে, যেদিন শোষণমুক্ত সমাজ ও শোষণহীন গণতন্ত্র কায়েম হইবে।” আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে সেদিন থেকেই দিশাহীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব হাতে নিতে হয়েছে। বিভক্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে এক কাতারে সামিল করার অভিযানে নামতে হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ দেখেছে কীভাবে চড়াই উৎরাই পাড়ি দিয়ে তাঁকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধ শক্তিকে মোকাবিলা করতে হয়েছে।

১৯৭৫ সালের সেই অভিযাত্রায় দীর্ঘ চার দশকের রাজনীতিতে তিনি যেমন বিরোধী দলে ছিলেন, আবার বারবার নির্বাচিত হয়ে সরকার প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন এবং এখনো আছেন। বিশ্বব্যাপী চরম দুর্যোগ, মহামারী এবং অর্থনৈতিক মন্দা বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও তাঁর নেতৃত্বে এমডিজিতে সাফল্যের পর ২০১৬ সাল থেকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলেছে দেশ। সাফল্যের এই মুকুটে ফোবর্স সাময়িকীর দৃষ্টিতে তিনি এখন বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ফরেন পলিসি সাময়িকীর করা বিশ্বব্যাপী শততম বৈশ্বিক চিন্তাবিদদের তালিকাতেও রয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাইতো তাঁর সেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনেই এই সাফল্যের বীজ নিহিত ছিল। এই দিনটির তাৎপর্য কম গুরুত্ব নয়। দিনটিকে আমরা স্মরণ করতে পারি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই উক্তির মাধ্যমে-

“এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর!

পুণ্য হল অঙ্গ মম, ধন্য হল অন্তর,

সুন্দর হে সুন্দর।”

[ ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম, প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক প্রোভিসি, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়]

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের চার দশক পূর্তিতে তথ্যচিত্র প্রদর্শনী
Comments (0)
Add Comment