বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্রের আজ তার একান্ন বছর পেরিয়ে শতবর্ষের অভিমুখে ধাবিত। এই রাষ্ট্রসত্তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যাদের চিন্তা-চেতনায়, তাদের অন্যতম একজন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তাঁর মহাপ্রয়াণ পরবর্তী প্রজন্মের কাঁধে দিয়ে গেল প্রগতিশীল চেতনার উত্তরাধিকার বহনের অনিবার্য দায়িত্ব। সন্দেহ নেই, তাঁর মৃত্যু আমাদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। বাংলাদেশ আপনার মতো কালজয়ী সন্তানকে ভুলবে না। আপনি আমাদের বুকের গহিনেই থাকবেন।
একুশের অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’গানের রচয়িতা, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন সন্ধিক্ষণের সাক্ষী তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। তিনি ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয় বাংলার প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন তিনি। এ সময় তিনি কলকাতার আনন্দবাজার ও যুগান্তর পত্রিকায়ও কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন। স্বাধীনতার আগেও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এ দেশের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে নানা বিশ্লেষণধর্মী লেখা লিখেছেন। তিনি ১৯৫৫ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করতে গিয়ে ঢাকায় কারারুদ্ধ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সাংবাদিক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায়। পরবর্তীকালে দৈনিক সংবাদ, মাসিক সওগাত, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক জনপদসহ বহু পত্রপত্রিকায় কাজ করেছেন। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর স্ত্রীর চিকিৎসাজনিত কারণে তিনি যুক্তরাজ্যে প্রবাসী হলেও বাংলাদেশের শীর্ষ দৈনিকগুলোতে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ কলাম লিখেছেন। রাজনীতি, সমসাময়িক ঘটনা ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি নিয়ে লেখা তার কলামগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কলাম লেখক।
মৃত্যুর কয়েকদিন আগপর্যন্ত তিনি দেশের বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লিখেছেন। শুধু সংবাদপত্রের কলাম নয়, তার বেশকিছু উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও স্মৃতিকথা। তিনি দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে বাঙালি জাতি একজন মহান দেশপ্রেমিক ও গুণী অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাণপুরুষকে হারাল। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর শারীরিক মৃত্যু হলেও তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে, বিশেষ করে একুশের অমর গানের মধ্য দিয়েই তিনি অমর হয়ে থাকবেন।
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি এবং রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত অধ্যায় একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি ছিলেন এর একটি অক্ষয় অধ্যায়। যত দিন বাঙালি জাতি থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে, তত দিন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নামটি প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসবেই।
একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বের দেশে দেশে পালিত হয় একুশে ফেব্রুয়রি মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। একুশের অর্জন ও মর্মান্তিক অধ্যায় স্মরণে প্রভাতফেরিতে কিংবা একুশকে সামনে রেখে যে কোনো অনুষ্ঠানে যে গানটি গীত হয় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’- এর স্রষ্টা প্রয়াত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।
দীর্ঘকাল ধরে সাংবাদিকতার ভুবনে তাঁর অবস্থান ছিল প্রধানত গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, জাতীয়তাবাদী মতাদর্শকে কেন্দ্র করে। এ ধারাতেই স্বদেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর খ্যাতি। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তিনি তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসে ধারণ করেছিলেন এবং এ দুই উৎস থেকে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক শক্তিতে ঋদ্ধ হয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব নীতিতে অটল থেকেছেন। বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিকে চেতনার মর্মমূলে ধারণকারী এক খাঁটি বাঙালি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবে পরিণত হন কিংবদন্তিতে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সরব ছিলেন প্রগতিশীলতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে; অসাম্প্রদায়িকতা, পশ্চাৎপদতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখলেই তিনি ক্ষুরধার এগিয়ে এসেছেন। জোরালো যুক্তি, ইতিহাসের তথ্য ও বাস্তব অভিজ্ঞতার বয়ানে আঁধার ঠেলে জাতিকে আলোর পথে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মাথার খুলি উড়ে যাওয়া ভাষাশহীদ রফিকউদ্দিনের রক্তাক্ত দেহ দেখে তাঁর স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখতে রচনা করেছিলেন একুশের অমর সংগীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্ব্রুয়ারি, যেটি স্বীকৃতি পেয়েছে প্রভাতফেরির অমর সংগীত হিসেবে।
১৯৭০ সালে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় গানটি ব্যবহৃত হয়। বিবিসির শ্রোতা জরিপে গানটি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থান লাভ করে। বর্তমানে হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশসহ ১৫টি ভাষায় এই গান গাওয়া হয়। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন ইতিহাস-ঐতিহ্য সচেতন, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যখনই বাঙালি জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে, তখনই তিনি কলম হাতে তুলে নিয়েছেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর চিন্তা-চেতনা বাঙালিকে উজ্জীবিত করে অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাঙালি জাতীয়তাদের দীপ্তিতে করে ভাস্বর। তাঁর কলাম ও সাহিত্য জাতির চেতনায় প্রজ্বালিত করে বাঙালিত্বের চিরায়ত অগ্নিমশাল।
একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ‘জয় বাংলা’, ‘যুগান্তর’ ও ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় কাজ করেছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তার লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি তাকে শুধু খ্যাতি নয়, অমরত্ব এনে দেয়। প্রথমে তিনি নিজেই গানটিতে সুর করেছিলেন। পরে শহীদ আলতাফ মাহমুদ এ গানে সুরারোপ করেন এবং বর্তমান সেই সুরেই গানটি গীত হয়। গাফ্ফার চৌধুরী একটা গীতিকবিতা লেখার পরে আর না লিখলেও তাঁর আয়ু বাংলা ও বাঙালির সমান। তাঁর জীবন ও সংগ্রামের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ক্ষুরধার লেখনী তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক