২২ শে শ্রাবণ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ দিবস। মহাকালের চেনাপথ ধরে প্রতিবছর বাইশে শ্রাবণ আসে। এই বাইশে শ্রাবণ বিশ্বব্যাপী রবীঠাকুরের ভক্তদের কাছে একটি শূন্য দিন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্য সাহিত্যের বিশাল একটি অংশে যে পরমার্থের সন্ধান করেছিলেন সেই পরমার্থের সাথে তিনি লীন হয়েছিলেন এদিন। রবীন্দ্র কাব্যে মৃত্যু এসেছে বিভিন্নভাবে। জীবদ্দশায় মৃত্যুকে তিনি জয় করেছেন বারবার। কাব্য কবিতায় মৃত্যু বন্দনা করেছেন তিনি এভাবে- ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান’ জীবনের শেষ নববর্ষের সময় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর সাধের শান্তিনিকেতনে। সেদিন তাঁর কলমে রচিত হয়েছিল ‘সভ্যতার সংকট’ নামের অমূল্য লেখাটি। তারও কদিন পর ১৯৪১ সালেরই ১৩ মে লিখে রাখলেন, রোগশয্যায় শুয়েই ‘আমারই জন্মদিন মাঝে আমি হারা’।
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের শেষ দিনগুলোতে কখনও তিনি শয্যাশায়ী, কখনও মন্দের ভাল। শেষের দিকে ১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই, শান্তিনিকেতনের আশ্রম বালক-বালিকাদেও ভোরের সঙ্গীত অর্ঘ্য তিনি গ্রহণ করেন তার উদয়ন গৃহের পূবের জানলার কাছে বসে। উদয়নের প্রবেশদ্বার থেকে ছেলেমেয়েরা গেয়ে উঠেন কবিরই লেখা ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার, আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল আজ’।
রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্র জীবন কথা‘য় কবির মৃত্যু নিয়ে লিখেছেন। তিনি লিখেন, শান্তি নিকেতনে কবি এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দেহ আর চলছিলনা, চিকিৎসার ও সেবারও ত্রæটি নেই। অবশেষে ডাক্তাররা পরামর্শ করে ঠিক করলেন, অপারেশন ছাড়া উপায় নেই।
৯ শ্রাবণ (২৫ জুলাই) শান্তি নিকেতন থেকে কবিকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হলো। শান্তি নিকেতনের সাথে অনেক বছরের স্মৃতি বিজড়িত কবি কি বুঝতে পেরেছিলেন এই তাঁর শেষ যাত্রা? যাবার সময় চোখে রুমাল দিচ্ছেন দেখা গেছে। ৩০ জুলাই, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কবির শরীরে অস্ত্রোপাচার হল। তার কিছু পূর্বে শেষ কবিতা রচনা করেন ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি, বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী।’ চিকিৎসকরা অস্ত্রোপাচার করলেন তা নিস্ফল হয়। অবস্থা দ্রæত মন্দের দিকে যেতে লাগলো। তিনি জ্ঞান হারালেন। শেষ নিশ্বাস পড়ল -রাখীপূর্ণিমার দিন মধ্যাহ্নে, বাংলা ১৩৪৮ সালের ২২ শে শ্রাবণ, ইংরেজি ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট তারিখ কবি চলে গেলেন অমৃতলোকে। রবীন্দ্র ভক্তরা যেমন বাইশে শ্রাবণে অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রিয় কবিকে স্মরণ করেন, ভক্তি অর্চনা জানান।
বাংলা সাহিত্যের এই অসামান্য প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৬৮ বাংলা সনের ২৫ বৈশাখ, ইংরেজি ১৮৬১ সালের ৭ মে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মা সারদাসুন্দরী দেবী। রবীন্দ্রনাথ একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ ও চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটে শৈশবেই। মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর লেখালেখির হাতেখড়ি। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত¡বোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। এরপর এই লেখালেখি চলে বিরামহীন।
১৮৭৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিকাহিনী’ প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকেই কবির লেখা দেশ-বিদেশে প্রকাশিত হতে থাকে। উপন্যাস, নাটক, সংগীত, প্রবন্ধ, চিত্রকলা বা দর্শন বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে বিচরণ করেননি রবীন্দ্রনাথ। অসাধারণ সৃজনশীলতা, নিবিড় জীবনবোধ ও ভাষার অনন্য প্রকাশভঙ্গি দিয়ে সাহিত্যের সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের নানা ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত হয়েছে। নানা দেশের পাঠ্যসূচিতে তাঁর লেখা সংযোজিত হয়েছে।
গীতাঞ্জলি ১৯১০ সালে রচনা, ১৯১২ সালে প্রকাশ আর এই কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। । বলা হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথের লেখার প্রধান উপজীব্য ছিল জীবনানুভ‚তি যেখানে বাঙালির জাতিসত্তা, আশা-আকাক্সক্ষা-নিরাশার আবেদনগুলো স্পষ্টভাবে ওঠে এসেছে। এটি এমন প্রবলভাবে এসেছে যে তিনিই হয়ে ওঠেছেন বাঙালির জাতিসত্তা ও বোধের এক অপার আধার।
তাঁর প্রকাশিত কবিতার বই ৫২টি, উপন্যাস ১৩টি, ছোটগল্পের বই ৯৫টি, প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থ ৩৬টি এবং নাটকের বই ৩৮টি। কবির মৃত্যুর পর ৩৬ খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া, ১৯ খণ্ডে রয়েছে ‘রবীন্দ্র চিঠিপত্র’।
এ সব মৌলিক সৃজনশীলতার বাইরেও কবির প্রতিভার স্ফুরণ রয়েছে। জমিদার পরিবারের সদস্য হিসেবে তিনি জমিদারিও করেছেন। তার প্রজাহিতৈষী মনোভাব সর্বজন বিদিত। তিনি ১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ (শাহজাদপুর), নাটোর (পতিসর) ও ওড়িশায় তাদের জমিদারি দেখাশোনা করেন। সেখানকার পৈতৃক ‘কুঠিবাড়িতে’ তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। পাশাপাশি তিনি ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯০১ সালে কবি কুষ্টিয়ার শিলাইদহ থেকে সপরিবারে বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিশ্বভারতী’। বিশ্ব ভ্রমণেও কবি ছিলেন অনন্য। তিনি ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন।
কবি রচনা করেছেন দুই হাজারের বেশি গান। অধিকাংশ গানের সুরারোপর তারই। ‘গীতবিতান’ তার সমগ্র গানের গ্রন্থ’। কবির লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ আমাদের জাতীয় সংগীত। ভারতের জাতীয় সংগীতটিও কবির লেখা। কবি তার গান দিয়েও চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন শতকোটি মানুষের হৃদয়ে।
২২ শ্রাবণে অবিশ্রান্ত বর্ষণ মুখর দিনেই ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন তিনি। বাংলা হারিয়েছিল তাঁদের প্রাণের ঠাকুরকে। যাঁর সঙ্গে আত্মিক যোগ বাঙালির। সেই প্রাণের ঠাকুর আজও বেঁচে আছেন প্রতি বাঙালির অন্তরে। যাঁর লেখনির আধুনিকতা আজও অপ্রতিরোধ্য। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই হারিয়েছিলেন মাকে। পড়াশোনা বিদেশেই করেছিলেন তিনি। সেখান থেকে ফিরে তিনি ফিরে আসেন ১৮৮০ সালে। পুঁথিগত বিদ্যা একেবারেই পছন্দ করতেন না তিনি। শান্তিনিকেতনে আশ্রম তৈরি করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন প্রকৃতির মাঠে পাঠই আসল শিক্ষা দেয়। নতুন ধারার শিক্ষায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। খোলা আকাশের নীচে পড়া। করোনা আবহে সেই খোলা আকাশের নিচে শিক্ষাকেই বেছে নিতে বলছেন গবেষকরা। গীতাঞ্জলী, গোরা, গৃহদাহ, চার অধ্যায়ের মতো একাধিক উপন্যাস লিখেছেন। সেই সব সাহিত্য আজও ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক। শুধু উপন্যাস বা সাহিত্য নয়। একাধিক গান, কবিতা, গীতিনাট্য, চিত্রনাট্য লিখেছিলেন তিনি। যেগুলি আর কেউ লিখে উঠতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথে গীতাঞ্জলী একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যকে অতটাই সমৃদ্ধ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সেই ধারা বাঙালি আজও নিয়ে চলেছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক