বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কীয় বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ থেকে জানা যায় যে এই বিশ্বমানবতার প্রতিভূকে পাকিস্তান পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা শুরু করেছিল ১৯৭০ সালেই। ভুট্টো যখন উপলব্ধি করলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব জীবিত থাকলে ভুট্টো ক্ষমতায় যেতে পারবেন না, তখন থেকেই খুনি ভুট্টো মনে মনে করতে থাকেন বঙ্গবন্ধু হত্যার অশুভ পরিকল্পনা। ১৯৭০ সালে ভুট্টোর প্ররোচনায় পাকিস্তান আসলাম নামের এক পাকিস্তানিকে সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল মুজিব হত্যার দায়িত্ব দিয়ে। আসলাম বাংলা ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি পূর্ব বাংলায় এসেই একটি দৈনিক পত্রিকায় চাকরির নামে আসলে বঙ্গবন্ধু হত্যার ছক আঁটতে থাকেন। এই আসলাম বাংলাদেশে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান জেলখানা থেকে মুক্তি দিয়ে যে বিমানে লন্ডনে পাঠিয়েছিল, সেই একই বিমানে দবির সিদ্দিকি নামের এক ঘাতককেও সে সময়ের পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো তুলে দিয়েছিলেন হিথরো বিমানবন্দরেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে। কিন্তু হিথরো বিমানবন্দওে সেদিন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কঠোর নিরাপত্তা আরোপ করায় দবির সিদ্দিকি তাঁর পরিকল্পনা ফলপ্রসূ করতে পারেননি। এরপর ভুট্টোর নতুন নির্দেশনা ছিল বঙ্গবন্ধু কলকাতায় গেলে সেখানে তাঁকে হত্যা করার। সিদ্দিকি কলকাতায় যাওয়ার পর তাঁর পরিকল্পনা ভারতীয় গোয়েন্দারা জেনে গেলে তাঁকে কলকাতায় গ্রেপ্তার করা হয়। পরে বঙ্গবন্ধুর দাবি অনুযায়ী তাঁকে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জিয়া ক্ষমতা জবরদখল করার পর দবির সিদ্দিকিকে শুধু মুক্তিই দেননি, তাঁকে ঢাকা ক্লাবের সভাপতিও করা হয়েছিল।
এই দবির সিদ্দিকি ছিলেন মনেপ্রাণে এক পাকিস্তানপন্থী লোক, যিনি বাংলার স্বাধীনতা কখনো মানতে পারেননি। এটি ছিল তাঁর রক্তের মধ্যে। তাঁর পিতামহ ছিলেন মুসলিম লীগের অন্যতম স্রষ্টা।
দবির সিদ্দিকির কুপরিকল্পনা ব্যর্থ হলে ভুট্টো নতুন ছক আঁকা শুরু করেন, আর সেই সুযোগ এসে যায় বঙ্গবন্ধু যখন ভুট্টোকে বাংলাদেশে নিমন্ত্রণ করেন। এটি ছিল খাল কেটে কুমির আনার মতো। ভুট্টো ১৯৭৪ সালের জুন মাসে ঢাকায় আসেন পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর (আইএসআই) চৌকস কর্মকর্তাসহ ১০৭ জনকে নিয়ে। তাঁর ঢাকা সফরের মূল লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা নির্ধারণ করা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আমাদের হাতে যে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছিল সে পরাজয়ের কথা তারা কখনো হজম করতে পারেনি, এখনো না। আর সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই তখন পাকিস্তানি শাসনযন্ত্র মরিয়া হয়ে উঠেছিল আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে। পরাজয়ের গøানি সব সময়ই অসহনীয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। অতীতে পরাজয়ের গøানি সইতে না পেরে বহু রাজা আত্মহত্যা করেছিলেন, যার এক বড় প্রমাণ রাজা জয় পাল, যিনি সুলতান মাহমুদের কাছে পরাজিত হয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। পরাজিত হয়ে মিসরের রানি ক্লিওপেট্রাও নিজের পোষা সাপের কামড় খেয়েই আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। বিশাল হৃদয়ের অধিকারী বঙ্গবন্ধু এই সত্যটি উপলব্ধি করতে না পেরে বরং ভুট্টোকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।
ভুট্টো যে সেই অপপরিকল্পনা নিয়েই ঢাকায় এসেছিলেন তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। সে বছরেরই এপ্রিল মাসে ভুট্টো পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে বলেছিলেন উপমহাদেশে শিগগিরই বড় ধরনের পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। ভুট্টোর অন্যতম সফরসঙ্গী পাকিস্তানের খ্যাতনামা সাংবাদিক জেড এ সোলেরি পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে বলেছিলেন, যত দিন শেখ মুজিব জীবিত থাকবেন, তত দিন বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নত হবে না। আরেক সাংবাদিক রাখঢাক না রেখেই বলেছিলেন, বাংলাদেশে শিগগিরই সামরিক হস্তক্ষেপ হতে পারে। এগুলো সবই প্রকাশিত সত্য। আরেকটি প্রমাণিত সত্য হলো এই যে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর বড় কর্তারা সারা রাত অফিস করে বঙ্গবন্ধু হত্যার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং হত্যার পরপরই পাকিস্তান সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার, টেলিভিশন এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রচার করা হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর, পৃথিবীর অন্য দেশগুলো জানার আগে। কালবিলম্ব না করে তারা বলেছিল, বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র।
স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আগে তার সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি কওে খোন্দকার মোশতাক এবং ঘাতক চক্র। বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের সুযোগ নিয়ে পনের আগস্টের নীলনকশা তৈরি করে মোশতাক। পরে পরিকল্পনাটি জিয়াউর রহমানকে জানায় খুনিরা। আর জিয়া তাদের সাথে আছে জানিয়ে সম্মতি প্রদান করে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোচ্চার কণ্ঠ স্তব্ধ করার ষড়যন্ত্র চলে পাকিস্তান শাসনামল থেকেই। বাংলার স্বাধীকার আন্দোলনের পথ রুদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধুকে তাড়া করে ফেরে ঘাতকের বুলেট।
১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবকে হত্যার চেষ্টা চালায় পাকিস্তান সরকার। তবে সেই ষড়যন্ত্রের বিষয় জানতে পারায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু।
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবেদ খান বলেন, সার্জেন্ট জহুরুল হককে যেভাবে গুলি করা হয়েছিল ঠিক একইভাবে বঙ্গবন্ধুকেও হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
১৯৭২-এ পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির পর উড়োজাহাজের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলো ভুট্টোর জান্তা সরকার।
আবেদ খান বলেন, তিনি যখন প্লেনে উঠবেন সে সময় ভুট্টো সাহেব তাঁর জীবনের উপর হামলা করার জন্য একটা ঘাতকচক্র তৈরি করেছিলেন। এ বিষয়টি জেনে যায় ভারতের গোয়েন্দা বিভাগ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ।
সব ষড়যন্ত্রকে পেছনে ফেলে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াই শেষে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ার সংগ্রামে মনোনিবেশ করেন জাতির পিতা। ঠিক সেই সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থামাতে জাতির পিতাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় খোন্দকার মোশতাক ও খুনিচক্র। হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সাথে সখ্যতা বাড়াতে থাকে খুনিরা।
সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, ১৫ আগস্টের বিভিন্ন সময়ে তারা কিন্তু বার বার রেকি করেছে। অনেক আগে থেকে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে- যাতে কোন অবস্থায় কেউ সন্দেহ করতে না পারে। ডালিম-নূর এরা তার বাড়ির মধ্যে থেকে সম্পর্ক তৈরি করেছে।
জাতির পিতাকে হত্যার পরিকল্পনার কথা জানানো হয় জিয়াউর রহমানকে। আবেদ খান বলেন, জিয়াউর রহমানের মতো লোকের কাছে ঘাতকরা যখন প্রথমে পরামর্শ করতে গেল তখন বললেন তোমরা কর, আমি আছি। তিনি কিন্তু সুন্দর পরিকল্পনাটা ইনড্রোর্স করে চলে গেলেন।
এগিয়ে চলে খুনীদের ষড়যন্ত্র। খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। রচিত হয় বাঙালির ইতিহাসের ঘৃণ্যতম অধ্যায়।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক