৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের পাশে আর কেউ ছিল না। দুই মেরুবিশিষ্ট বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক বলয় থেকে বাংলাদেশকে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়েই যায়, তখন পশ্চিমা পুঁজিবাদী শক্তিসমূহ বাংলাদেশকে তাদের কবজায় রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে ক্ষমতায় রেখে বাংলাদেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার তাদের পক্ষে কঠিন ছিল। এটা তাদের বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। অর্থনৈতিক দুর্বলতা, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রক্ষীবাহিনীর কার্যক্রম, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, সেনাবাহিনীর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধাদের বিভেদ, রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের মধ্যে অনৈক্য প্রভৃতির সুযোগ গ্রহণ করে ষড়যন্ত্রকারীরা। বাকশাল গঠনের পর রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। রাজনীতি বন্ধ হওয়ায় এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মূল পরিকল্পনাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীরা জনগণের মনস্তত্ত¡ পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকবে ওই সময় অভ্যুত্থান ঘটালে প্রতিরোধের সম্ভাবনা নেই।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে ঘাতকের বুলেটে নির্মমভাবে শাহাদৎবরণ করতে হয়। আওয়ামী লীগ সরকারগুলোর সময় দিনটি জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে দিনটিকে শুধু শোকের বললে সম্পূর্ণ বলা হয় না বা কম বলা হয়। দিনটি বাঙালি জাতির জন্য জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার দিন, দিনটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার। জাতি হিসেবে আজ আমরা এতটাই অসংহত যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অর্থ সবার কাছে একই রকম নয়। এই দিনটি সীমাহীন শোকের বার্তা নিয়ে উপস্থিত হয় মাত্র দু’জন মানুষের কাছে। তাঁরা হলেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেদিন বিদেশে অবস্থানের কারণে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে আছেন। তারপর তাঁদের বংশধরদের কাছে এই দিনটি অত্যন্ত শোকের। ওই দিনে আরও যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের পরিবার-পরিজনের কাছেও দিনটি অত্যন্ত শোকের। দিনটি গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাদের কাছে কর্মীদেরদের কাছে। কিন্তু আজকাল অবশ্য এর ব্যতিক্রম বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবির পাশে নিজেদের ছবি দিয়ে বিলবোর্ড, ডিজিটাল ব্যানার, পোস্টার দিয়ে যাঁরা সারা দেশের রাস্তাঘাট, গাছের ডালপালা, লতা পাতা, বিদ্যুতের খাম্বা ভরে দিয়েছেন, রাস্তায় তোরণ নির্মাণ করে শোকের ভাষা প্রকাশ করেন অনেকে। তাঁদের কাছে দিনটি কী তাৎপর্য বহন করে, তা তাঁরাই বলতে পারবেন। যাঁরা চাঁদা তুলে এসব বিরাট আয়োজন করেন ১৫ আগস্ট পালনের ব্যবস্থা করেছেন, তাঁদের কাছে দিনটি নিশ্চয়ই অন্য অর্থ বহন করে। অন্যদিকে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এবং নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে যাঁরা অন্তরে ধারণ করেন, তাঁদের কাছে ১৫ আগস্ট অবশ্যই দুঃখের দিন, কষ্টের দিন, বেদনার দিন।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানসহ তৃতীয় বিশ্বের ৪৬টি দেশে অন্তত ৭৩টি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। বাংলাদেশের ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের যে ঘটনা, তার সঙ্গে পৃথিবীর আর কোনো ক্যুও কোনো মিল নেই। ১৯৭৩-এর সেপ্টেম্বরে চিলির মার্ক্সবাদী নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আলেন্দেকে জেনারেল পিনোশে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং তাঁকে হত্যা করা হয়। কিন্তু ঢাকার ৩২ নম্বরে যে বর্বরতা হয়, তার সঙ্গে কোনো রক্তাক্ত ক্যুরই তুলনা হয় না।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সহিংস তৎপরতার দিকে ইঙ্গিত করে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪-এ প্রকাশ্য জনসভায় বলেন, ‘আমার অবস্থা যদি আলেন্দের মতোও হয়…।’ অর্থাৎ অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা আঁচ করছিলেন, তাঁর ওপরও আঘাত আসতে পারে। কিন্তু তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি যে তাঁর স্নেহধন্য সেনা কর্মকর্তাদের থেকেই আসবে সে আঘাত।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যারা অভ্যুত্থান ঘটায়, সব দেশে তারা নিজেরাই একটি সরকার গঠন করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাঁর লাশের যথাযথ মর্যাদায় সৎকার করার আগেই তাঁর দলের তাঁরাই সরকার গঠন করেন, যাঁরা সবাই তাঁর সরকারেও ছিলেন। সেই জন্যই পনেরোই আগস্ট শুধু শোকের দিন নয়, দিনটি বিশ্বাসঘাতকতার।
বাঙালির জঘন্যতম মিথ্যা কথা ‘পনেরোই আগস্টের ঘটনাটি কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সামরিক কর্মকর্তার কাজ, তার সঙ্গে সামরিক বাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই।’ হ্যাঁ, অবশ্যই সেটা থাকত না, যদি শীর্ষ সেনাপতিরা মেজরদের আনুগত্য স্বীকার না করতেন এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বারা মেজরদের প্রতিষ্ঠিত অবৈধ সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা না দিতেন। বঙ্গবন্ধুকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হয়, তখন সেনা হেডকোয়ার্টার থেকে শীর্ষ কর্মকর্তারা ঘাতকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তেমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং পনেরোই আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষের নিহত হওয়ার কথা শুনেও শীর্ষ জেনারেলরা নিরুদ্বেগভাবে ছিলেন। কেউ সকাল আটটা পর্যন্ত শার্ট-প্যান্ট বা ড্রেসিং গাউন পরে ছিলেন।
ঢাকা জেলার দায়রা জজের আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে ২০ জানুয়ারি ১৯৯৮, সেদিনের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বলেন: ‘১৫ই আগস্ট সকাল আনুমানিক ৫টার সময় আমার ব্যাটম্যান আমাকে ডাকিয়া উঠায়। কর্নেল সালাহউদ্দিনের সহিত আমার ৫/১০ মিনিট কথা হয়। কর্নেল সালাহউদ্দিন আমাকে বলে যে আর্টিলারি এবং আর্মারের লোকেরা বঙ্গভবন, রেডিও স্টেশন এবং ধানমন্ডি ৩২ নম্বও রোডে যাবার কথা আমি জানি কি না। ইহার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার কথা হয়। তখন আনুমানিক সকাল সোয়া ৫টা।’
অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু অন্তত সাড়ে ৫টা পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তখন রীতিমতো দিন। আদালতে জেনারেল সফিউল্লাহ আরও বলেন ডেপুটি চিফ জেনারেল জিয়া এবং সিজিএস খালেদ মোশাররফ আনুমানিক ৫.৩০-৫.৪০-এ আমার বাসায় আসে। তার আগে কর্নেল সাফায়েতের সহিত টেলিফোনে আলাপের সময় সে মেজর রশীদের বরাত দিয়া বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা আমাকে জানায়। কিন্তু তখনো আমি এই হত্যার কথা বিশ্বাস করতে পারি নাই। আমার বাসভবন হইতে আমি প্রথমে আমার অফিসে অর্থাৎ হেডকোয়ার্টারে যাই। অনুমান ৮/৮.৩০টা পর্যন্ত অফিসে ছিলাম।’
প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী সাড়ে ৬টা-৭টার মধ্যেই তিন বাহিনীর প্রধান, রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তা ও পুলিশ প্রধানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। কারও সহযোগিতা তিনি পাননি। ১৯ জানুয়ারি ’৯৮ আদালতে কর্নেল শাহরিয়ারের উকিলের জেরায় জেনারেল সফিউল্লাহ বলেন: ‘পনেরই আগস্টের ঘটনা ঘটার পর ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ৭টার আগে আমার সহিত টেলিফোনে আলাপ করে। তখন আমি বাসা হইতে অফিসে যাইতেছিলাম। বাসায় আমার সহিত কথা হয়। আমি শেভ করে ইউনিফর্ম পরে অনুমান ৭টার দিকে অফিসে রওনা দেই। আমি বাসায় থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কথা জানিতে পারি কিন্তু বিশ্বাস করিতে পারি নাই।’
রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতির বাড়ি দুর্বৃত্তরা আক্রমণ করেছে এবং তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, এ কথা শোনার পরেও দাড়ি শেভ করার জন্য ১৫-২০ মিনিট সময় অপচয় করা আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকের হিসেবে চরম নিষ্ঠুরতা। বিশেষ করে যখন প্রধানমন্ত্রীর ফোন পান। সবকিছু জেনেশুনে বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন সেনাপ্রধান। আদালতে তিনি বলেন: ‘আমি যখন বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলি সোয়া ৫টা সাড়ে ৫টা তিনি আমার গলার আওয়াজ শুনে বলে উঠলেন, ‘সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ে এটাক করেছে, কামালকে বোধ হয় মেরে ফেলেছে, তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও। উত্তরে আমি বলেছিলাম, আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউস? আমি যখন জিয়া ও খালেদ মোশাররফকে ফোন করি তখন তাহাদেরকে তাড়াতাড়ি আমার বাসায় আসার কথা বলি। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে তাহারা আমার বাসায় আসিয়া পড়ে। জিয়া ইউনিফর্ম ও শেভ এবং খালেদ মোশাররফ নাইট ড্রেসে নিজের গাড়িতে আসে।’
বঙ্গবন্ধু সফিউল্লাহর সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেন, তা একজন স্নেহশীল বিপন্ন পিতা তাঁর পুত্রকে বলার মতো। তার জবাবে সেনাপ্রধান বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ইংরেজিতে যা বলেন, তা বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে নির্মম পরিহাস। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জীবন দিয়েছেন, কিন্তু অন্য কারও কোনো অসুবিধা হয়নি, বরং মোশতাক সরকার থেকে ঘটেছে তাঁদের প্রাপ্তিযোগ। দশ দিনের মধ্যে ডেপুটি প্রধান জিয়াউর রহমান হন সেনাপ্রধান এবং প্রমোশন পেয়ে ব্রিগেডিয়ার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হন মেজর জেনারেল ও উপপ্রধান। সফিউল্লাহ হন রাষ্ট্রদূত। তাঁর ভাষায়: ‘১৯৭৫ সনের ২৪ আগস্ট আমাকে সেনাপ্রধানের পদ হইতে অবসর দিয়া রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ করে। আমি একজন সরকারি কর্মচারী হিসাবে উক্ত নিয়োগ গ্রহণ করিতে বাধ্য হই। আমি ১৯৯১ সনের জুলাই মাস পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করি। এই সময় আমি নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হই নাই। তবে মাঝে মাঝে উড়ো চিঠি পাইতাম।’
নির্মম সত্য হলো, পনেরোই আগস্টের ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতা এবং সেনাবাহিনীর কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত। দেশের অন্য কোনো দলের তাতে অংশগ্রহণ ছিল না।
১৯৯৬ ও ২০০৯-এ আওয়ামী লীগ সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কেউ সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও খুনিদের শাস্তি হতো অথবা ১৯৭১-এর ঘাতকদের বিচার ও সাজা হতো কিনা সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। ২ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত খন্দকার মোশতাকের কোনো ক্ষমতাই ছিল না, ছিলেন প্রায় বন্দী। ৪ নভেম্বর খুনিরা নিরাপদে দেশত্যাগ করে।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক