সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোর স্বাধীনতা কোনোভাবেই বাক্ স্বাধীনতা নয়। সম্প্রতি জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক ২৫ জন বিশেষজ্ঞ এক যৌথ বিবৃতিতে এ কথা জানান। বিবৃতিতে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সম্প্রতি টুইটার অধিগ্রহণের পর বর্ণবাদী শব্দের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে। এর মাধ্যমে আফ্রিকার জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। এসবের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জোরালো জবাবদিহি ব্যবস্থা প্রয়োজন।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নেটওয়ার্ক কনটেজিওয়ন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের’ প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিবৃতিতে বলেছে, টুইটার অধিগ্রহণের প্রথম দিনগুলোতে, বিশেষ করে অধিগ্রহণের প্রথম ১২ ঘণ্টায় ঘৃণ্য ও বর্ণবাদী একটি শব্দের ব্যবহার আগের চেয়ে প্রায় ৫০০ গুণ বেড়েছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, টুইটার ওই বিদ্বেষমূলক প্রচারণাকে উপহাস বলে আখ্যা দিয়ে বলেছিল, সেখানে বিদ্বেষের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের বিরুদ্ধে যে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে তা অত্যন্ত উদ্বেগের। আর তা মানবাধিকারকেন্দ্রিক সাড়া দেওয়ার দাবি রাখে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শুধু টুইটার নয়, মেটার মতো অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কাছেও এ ধরনের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য উদ্বেগের বিষয় নয়। বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের বিরোধিতা করেন এমন অনেকের দাবি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নীতির বিষয়ে অঙ্গীকার আর তা বাস্তবায়নে পার্থক্য আছে, বিশেষ কওে ফেসবুকে নির্বাচনী বিভ্রান্তি, ষড়যন্ত্রের তত্তে¡র বিষয়ে আলোচনা ও উসকানিমূলক বিজ্ঞাপন অনুমোদনের ক্ষেত্রে এটি উল্লেখযোগ্য। ‘গ্লোবাল উইটনেস’ ও ‘সামঅফআস’-এর সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মেটা নির্দিষ্ট কিছু বিজ্ঞাপন আটকাতে পারে না।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অনেক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মেটা ২০২০ সালে নজরদারি পর্ষদের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেয়। এই পর্ষদের কার্যকারিতা দেখতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। অনলাইনে জাতিগত বিদ্বেষের প্ররোচনাকে মোকাবেলা করার জন্য তাদের প্রক্রিয়া পর্যালোচনা এবং সংশোধন করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সর্বোচ্চ পর্যায়ে অব্যাহত প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। বিবৃতি দেওয়া জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আফ্রিকার বংশোদ্ভূত জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ, ব্যবসা, আন্তঃদেশীয় করপোরেশন ও মানবাধিকার বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের সভাপতি ও সদস্যরাও রয়েছেন।
এটি এখন বাস্তবতা যে আমাদের দেশেও, সমকালীন বিশ্বের মত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অতিমাত্রায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একদিকে এর অত্যধিক ব্যবহারিক গুরুত্ব, অন্যদিকে অপব্যবহারের মাত্রা বিভ্রান্তির বেড়াজালে পুরো সমাজে নির্মাণ করছে কদর্য-সংশয়-আশঙ্কার অনাকাক্সিক্ষত প্রাচীর। অপসংস্কৃতির মোড়কে রাজনীতি-ধর্ম-অর্থনীতি-সামগ্রিক সামাজিক বিষয়গুলোর মিথ্যা ভিত্তিহীন প্রচারণা, সাম্প্রদায়িকতা, কূপমন্ডকতা, অসহিষ্ণুতা, সহিংসতা, বিরোধ, বিচ্ছেদ জীবনপ্রবাহের সাবলীল গতিময়তায় প্রচন্ড অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কতিপয় ব্যক্তিত্বের পরিচয়ে নানামুখী নেতিবাচক বক্তব্য পরিবেশন অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করছে। এতে সামাজিক অসংগতি গণমানুষের জীবনে অসহনীয় দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত করছে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির আচ্ছাদনে দুরভিসন্ধিমূলক তরুণসমাজের সৃজন-মনন-মানবিক-নৈতিক চরিত্রের বিচ্যুতি ভবিষ্যৎ স্বাভাবিক সমাজ বিনির্মাণে কতটুকু ভূমিকা রাখবে, তার গভীর বিশ্লেষণ অতীব জরুরি।
সমৃদ্ধ পাঠ্যপুস্তক-বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিমানসের জীবনচরিত জ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর পঠনপাঠন থেকে দূরে সরিয়ে সামাজিক যোগাযোগনির্ভরতা যে ভয়াবহ বাস্তবতার ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করছে, তা অনুধাবনে ব্যর্থ হলে সুন্দর ধরিত্রী কঠিন অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিপতিত হবে-এ সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
২০১০ সালে বুকার পুরস্কার বিজয়ী খ্যাতিমান ব্রিটিশ লেখক হাওয়ার্ড জ্যাকবসন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘২০ বছরের মধ্যে শিশুদের মূর্খ বানাবে ফেসবুক-টুইটার। ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আধিপত্যের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশুরা অশিক্ষিত হবে। স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং প্রচুর পরিমাণে ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে নাটকীয়ভাবে তরুণ প্রজন্মের যোগাযোগের পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। আর এসবের কারণে তারা হারাচ্ছে বই পড়ার অভ্যাসও।’ অপরাধবিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইদানীং আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে।
এ মাধ্যম আমাদের মানবিক গুণাবলিকে প্রভাবিত করছে। মানি লন্ডারিং, আক্রমণাত্মক গেম, ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে অনেকে। মানসিকভাবে অনেকেই আছে অস্থির অবস্থায়। এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ক্রমেই রাগ-ক্রোধ-অবসাদ-বিষণœতা-একাকিত্ব-হতাশা-হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার নিয়ে শঙ্কিত স্বয়ং ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সিইও মার্ক জাকারবার্গের ভাষ্যমতে, ‘সোশ্যাল মিডিয়া সময় নষ্টের জন্য নয়। এটি সত্যিকারে উপকারে আসতে পারে, যদি এর সঠিক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আপনি যদি শুধু এখানে বসে থাকেন আর যা দেখানো হবে, তাই গলাধঃকরণ করেন, তাহলে তো হবে না।’
ইতিবাচক অবদান রাখার পাশাপাশি প্রবাসী ও অভিবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে অনেকেই দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এদের সরব উপস্থিতি ও দেশবিরোধী আপত্তিকর মন্তব্য-বক্তব্য প্রচারের কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
তারা যেসব দেশে অবস্থান করছে, সেসব দেশের নানা আইনি জটিলতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে। এসব ঘৃণ্য কাজে নিয়োজিত-তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের তালিকা ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ মিশনগুলোয় পাঠানো হয়েছে। ওইসব দেশের আইনের আওতায় এনে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো থেকে সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর কাছে আবেদন জানানো জরুরি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্রমতে, বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৭০ শতাংশ মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংযুক্ত, যার প্রায় ৯০ শতাংশই তরুণ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, লিঙ্কডিন, স্কাইপে প্রভৃতি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সর্বাধিক জনপ্রিয় ফেসবুক। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশের রয়েছে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং এর একটি বিশাল অংশ কিশোর-কিশোরী।
বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপের ফলাফল অনুসারে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের কারণে উল্লেখযোগ্য তরুণ ও তরুণী বিপথগামী-মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে-পড়াশোনায় মনোযোগ হারাচ্ছে-খেলাধুলা ছেড়ে দিয়ে রাতদিন ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। চরম স্খলন হচ্ছে শিক্ষা-নীতি নৈতিকতার। ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে সংঘাত-সহিংসতা। ভুয়া তথ্য সরবরাহ-ঘৃণা-বিদ্বেষ, যৌনতা ও অশ্লীলতা-চরিত্রহনন-মুদ্রা ও মানব পাচার-জুয়া-সাইবার সহিংসতাসহ নানা মাত্রিক অপরাধের মাধ্যম হিসাবে পরিগণিত হয়েছে এ সামাজিক যোগাযোগ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরাধের ক্রমবর্ধনশীলতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইন-চাপ প্রয়োগের ফলে ইউটিউব ও ফেসবুকের মতো অনেক সাইট তাদের নিজস্ব নিয়মে অগ্রহণযোগ্য ও ক্ষতিকর বিষয়বস্তু দ্রæত মুছে ফেলাসহ প্রথম প্রকাশ হওয়া প্রতিরোধের পদক্ষেপ নিয়েছে। ইউটিউব ও ফেসবুক কর্তৃপক্ষ নিয়মিত অনুপযুক্ত বিষয়বস্তু অপসারণের তথ্য প্রকাশ করছে।
গুগলের মালিকানাধীন ভিডিও শেয়ারিং সাইটের তথ্যমতে, তারা ২০২০ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৮৮ লাখ ভিডিও, ৩৩ লাখ ক্ষতিকারক চ্যানেল ও ৫১ কোটি ৭০ লাখ অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য অপসারণ করেছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা উল্লেখ্য সময়ে ৩ কোটি ৩০ লাখ ক্ষতিকারক বিষয় সরিয়ে নিলেও অগ্রহণযোগ্য ও ক্ষতিকর বিষয়বস্তুর আধিক্যের কারণে শুধু কোম্পানির একার পক্ষে এটি ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। নিয়ন্ত্রক কোম্পানিগুলোর শত প্রচেষ্টা সত্তে¡ও এটি দিনদিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে পরিচালিত প্রতিটি ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন বিনোদনমূলক প্ল্যাটফরমগুলোর জন্য বিটিআরসি থেকে কিছু শর্তসাপেক্ষে নিবন্ধন নেওয়ার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, দেশে পরিচালিত যে কোনো ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অফিস বাংলাদেশে থাকতে হবে। সংবাদ-কিউরেটেড কনটেন্ট-ফিল্ম-ওয়েব সিরিজ রয়েছে এমন ওয়েবসাইটের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এনওসি বাধ্যতামূলক।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশও আইনি কাঠামোর ভিত্তিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গণমাধ্যমের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, জার্মান সরকার ২০১৮ সালে নেটজডিজি এ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিকে তাদের সাইটে প্রকাশিত আপত্তিকর বিষয়বস্তু সম্পর্কে অভিযোগ পর্যালোচনা করার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা-বিষয়বস্তু প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা অপসারণ-কোম্পানিগুলোর কাজের বিবরণ সম্পর্কে প্রতি ছয় মাস অন্তর আপডেট প্রতিবেদন প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ভারতে ২০২১ সালে প্রণীত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা মতে, ফেসবুক-টুইটার-হোয়াটসঅ্যাপ ও অন্যান্য যোগাযোগমাধ্যমের কর্তৃপক্ষকে ভারতীয় সরকার কোনো ব্যবহারকারীর পোস্ট মুছে দেওয়া এবং ব্যবহারকারীর নাম-পরিচয় প্রকাশের অনুরোধ করতে পারবে। ঘৃণ্য ও হিংসাত্মক বিষয়বস্তু প্রকাশের কারণে সংস্থাগুলোর বৈশ্বিক টার্নওভারের ১০ শতাংশ পর্যন্ত আর্থিক দÐ ও প্রযুক্তি নির্বাহীদের জন্য তিন বছরের কারাদÐের বিধান রেখে অস্ট্রেলিয়ায় ২০১৯ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়।
২০২১ সালের নভেম্বরে কার্যকর আইনে রাশিয়াকে জরুরি অবস্থায় বিশ্বব্যাপী ওয়েব সংযোগ বন্ধ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং রাশিয়ার ডেটা আইনে সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলো কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ সার্ভারগুলোয় রাশিয়ানদের সম্পর্কে ডেটা সংরক্ষণ করতে পারবে। শিশু পর্নোগ্রাফি, হেট স্পিচ এবং বিনা সম্মতিতে কারও অন্তরঙ্গ ছবি প্রকাশ করাকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করে কানাডা সরকার কর্তৃক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইনে পুলিশ সোশ্যাল প্ল্যাটফরম এবং বক্তব্য পোস্টকারীর বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারবে।
চীন সাইবারস্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ওয়েবসাইট বন্ধ ও জুয়া খেলাসহ ক্ষতিকারক নানা মোবাইল অ্যাপ অপসারণ করে থাকে। দেশটিতে থাকা কয়েক হাজার সাইবার পুলিশের কাজ হচ্ছে সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফরম এবং সংবেদনশীল স্ক্রিন বার্তাগুলোকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা।
জগতের প্রতিটি বিষয়েরই ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় দিকই থাকে। কিন্তু যেকোনো বিষয়ের ইতিবাচক দিকগুলোকে সাদরে গ্রহণ করে সেগুলোকে আমরা কীভাবে কাজে লাগাচ্ছি সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আজকাল এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে ব্যবসা-বাণিজ্যের এক বিরাট মাধ্যমের সূচনা হয়েছে। এই যান্ত্রিক কর্মব্যস্ত জীবনে অনেকের নিজের নিত্যপ্রয়োজনীয় নানাবিধ পণ্য কিনতে দোকান, মার্কেটে যেতে পারেন না। তাদের এই ব্যস্ত জীবনে আশার আলো হয়ে এসেছে ই-কমার্স। বিভিন্ন নামীদামী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিংবা ছোটখাট ব্যবসায়ীদের বেঁচে থাকার অবলম্বন এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যার ফলে তারা নিজেদের বিক্রয়যোগ্য পণ্যের প্রচার ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। এই ই-কমার্সের সুফল ভোগ করতে বর্তমানে বহু বেকার তরুণ উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে ঝুঁকছে। এর ফলে অনেকেই এখন অনলাইন ব্যবসামুখী হচ্ছে ও সফলতার মুখ দেখছে।
আমাদের এই সত্যটি স্বীকার করে নেওয়া জরুরি যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদের বাস্তব জীবনের সম্পর্কে নেতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনছে ও আমাদের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায় তৈরি করছে। যে কারো সাথে মনের ভাব বিনিময়ের জন্য সামনে বসে বলা সর্বোত্তম। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির ফলে আমরা ভার্চুয়ালি মনের ভাব আদান-প্রদানেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রযুক্তির ওপর আমাদের এই নির্ভরশীলতা আমাদের প্রতিনিয়ত বাস্তব জীবন থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে ক্রমেই আমাদের যান্ত্রিক করে তুলছে।
মূলত প্রতিটি ধর্মের ধর্মগ্রন্থ অনুসারে এতদিনকার প্রচলিত রীতিনীতি-সমাজদর্শন-সত্য-সুন্দর-ক্যল্যাণ আনন্দের অনুষঙ্গভিত্তিক সংস্কৃতি-কৃষ্টি-ঐতিহ্যের মূলে কুঠারাঘাত করে বিকৃত চিন্তাচেতনা-ধ্যানধারণার অনুপ্রবেশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিগূঢ় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে। মিথ্যাচার-প্রতারণা-জালিয়াতি-অসংলগ্ন কর্মযজ্ঞের সমীকরণে প্রজন্ম কী পেতে যাচ্ছে, তা ভেবে দেখার এখনই উপযুক্ত সময়।
সম্প্রতি একটি বিষয় খুবই আলোচনা হচ্ছে। তা হচ্ছে ইন্টারনেটে ক্ষতিকারক কনটেন্ট নিয়ে। ক্ষতিকারক বলতে পর্নোগ্রাফি, অসত্য ও মনগড়া তথ্য সংবলিত রিপোর্ট, সমাজের সঙ্গে সঙ্গতিহীন ছবি বা ভিডিও ক্লিপ, ব্যক্তিগত মুহূর্তের ভিডিও ক্লিপ ইত্যাদি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, যেমন ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার ইত্যাদিতে প্রচার করা হচ্ছে এসব ক্ষতিকারক কনটেন্ট। যার যা খুশি লিখে দিচ্ছে। যেমন খুশি ছবি বা ভিডিও আপলোড করছে। গোপনে বা সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিডিও ধারণ কওে ছেড়ে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এসব ক্ষতিকারক কনটেন্ট আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিপথে চালিত করছে। সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে, তা গড়াচ্ছে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় পর্যন্ত। আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্তৃপক্ষের কৃপার ওপর নির্ভরশীল। তারা তাদের মতো করে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড বানায়। সেটা আমাদের মেনে নিতে হয়।
সারা দুনিয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ব্যাপক প্রসারে একদিকে যেমন মানুষ অনেক সুফল পাচ্ছে, তেমনি ক্ষতিকারক এই দিকটি নিয়ে উদ্বিগ্নও হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সকল দেশই এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। সবাই যার যার মতো করে চেষ্টা করছে এই পরিস্থিতি মোকাবেলার। সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে এখন তোলপাড় চলছে সারা দুনিয়ায়। যে কেউ যে কোন বিষয়ে যা খুশি বলে দিতে পারে। আইনের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করে না। এ কারণে সোশ্যাল মিডিয়ার রাশ টেনে ধরার চেষ্টা চলছে অনেক দেশেই। ‘সরকার চাইলেই সবকিছু করতে পারে না।’ পারে না এ কারণে যে, দেশের সকল জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কর্তৃপক্ষই বিদেশী।
আমাদের দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অশুভ ব্যবহারের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ আরোপে আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।
বিজ্ঞানের অগ্রগতি তো রুদ্ধ করার বিষয় নয়। সারা পৃথিবীই এখন ডিজিটাল যোগাযোগে নিজেদের যুক্ত রেখেছে। বিবিধ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কার্যকর রয়েছে সর্বত্র। এর সুফলও পাচ্ছি আমরা। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারের নানা সুযোগও রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে রেডিও-টেলিভিশনের চেয়ে গুগল, টুইটার, ফেসবুক, টিকটক বড়সংখ্যক মানুষের হাতের কাছে। কোটি কোটি মানুষের হাতে রয়েছে স্মার্টফোন। তাই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অপব্যবহারকারীরা বিভিন্ন বয়সের মানুষকে নানা রকম অপরাধের সঙ্গে যুক্ত করতে পারছে। যুক্ত করছে নানা আসক্তিতে। জঙ্গিবাদ ও বিভিন্ন নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীরা নিজেদের অপকর্মের হাতিয়ার বানাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে। নানা গুজব ছড়িয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তোলায় ভূমিকা রাখছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা থেকে প্রজন্মের মন সরিয়ে নিচ্ছে অন্ধকারের দিকে।
সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে দেশবিরোধী নানা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। যৌন হয়রানির মাধ্যমও এখন হয়ে উঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। টুইটার, টিকটকের মতো নানা অ্যাপ ব্যবহার করে উঠতি বয়সের কিশোর-তরুণরা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। দায়িত্বহীন পরিবারগুলো সার্থক কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। সুতরাং আইন করে এসব নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে সামনে ঘোর অন্ধকার। যে প্রচারণায় রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাকে প্রতিরোধ করা উচিত।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে আইন প্রণয়নের দিকে এগোচ্ছে সরকার। দেশের তথ্য প্রযুক্তি (আইটি) এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) সংশ্লিষ্টরা সরকারের এমন উদ্যোগকে বলছেন সময়োপযোগী।
বিশ্বের অনেক দেশের মতোই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য এমন আইন জরুরি বলেও মনে করছেন অনেকে।
আইন প্রণয়নের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধ সংঘটিত হয়ে আসছে। রাষ্ট্র ও সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি বিশেষ ও প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে ছড়ানো হচ্ছে অপপ্রচার, গুজব ও মিথ্যা তথ্য। এমনকি এসব মাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে সংঘবদ্ধ অপরাধের যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবেও।
আর এ ধরনের অপরাধ মোকাবেলায় এবং দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর জোরালো সহায়তা পাচ্ছে না সরকার। অপরাধীদের শনাক্ত করতে প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ‘দয়ার’ ওপর নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে অনেকটাই। আর এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এ বিষয়ে শক্তিশালী আইন না থাকা।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কাছে পাঠানো আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে মাত্র ৪৫ শতাংশ আবেদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণার ব্যবসাও এখন জমজমাট হয়ে উঠছে। ফেসবুকের কিছু আইডি দেখলেই বোঝা যায় সেগুলো ফেইক (নকল), বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। ওই ধরনের আইডির প্রোফাইল পিকচার ও কভার ফটো হিসাবে ব্যবহৃত ছবিগুলো যথাযথ বলে মনে হয় না। ওসব আইডিতে যেসব বিষয় পোস্ট করা হয় তাও আপত্তিকর। তা সত্তে¡ও এ ধরনের আইডি থেকে আসা ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ অনেক সচেতন ব্যক্তিও গ্রহণ করেন। শুদ্ধাচারী ব্যক্তিদের বন্ধুত্বের তালিকায় ফেইক আইডিধারীদের নাম দেখে অন্যরাও ওসব বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করেন। অনেক সচেতন মানুষও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব ব্যাপাওে বোধহীন হয়ে যান। আর ভুয়া আইডিধারীরা তো তা-ই চায়, অপেক্ষা করতে থাকে মাহেন্দ্রক্ষণের, সুযোগ বুঝে ভাব জমিয়ে আম-ছালা সবই লুটে নেয়।
যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন দশের মানুষের কাছ থেকে অহরহ ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ আসে। ওইসব বিদেশির প্রোফাইল ঘাঁটলে বন্ধু তালিকায় দু-একজন বাংলাদেশি ছাড়া তাদের দেশের বা সমাজের কারও নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। মনে প্রশ্ন জাগা উচিত-শুধু দু-চারজন বাংলাদেশিই কেন সেই বিদেশির বন্ধুত্বের তালিকায়? তাদের কি নিজস্ব কোনো সার্কেল নেই? হাজার হাজার মাইল দূরের দেশের কারও কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর কারণ কী? এ ধরনের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করার আগে আমাদের মাথায় কি এ বিষয়গুলো উঁকি দেয় না? এগুলো চিন্তায় না আনলে পদে পদে প্রতারিত হতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উপকারিতা ও উপযোগিতা বলে শেষ করা যাবে না। প্রতিনিয়ত এসব মাধ্যমের নতুন নতুন ফিচার মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ ও সাবলীল করছে। কিন্তু কারও অপরিণামদর্শী আচরণ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণে বিপদ ঘটলে যত দোষ নন্দঘোষের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আসলে যা করা উচিত তা হলো, এ মাধ্যমে বিচরণের সময় সতর্কতার বিষয়টি মাথায় রাখা। ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যতক্ষণ থাকা হবে, ততক্ষণ যেন এর মাধ্যমে ভালো কিছু করতে পারা যায়, সেই চিন্তা থাকতে হবে। এ মাধ্যমকে জ্ঞান আহরণ, পরিচ্ছন্ন বিনোদন, নির্ভেজাল ভালোবাসার মঞ্চ এবং মানুষের শুভ ইচ্ছা, সৎ চিন্তা ও মহৎ কাজগুলোকে আরও রাঙিয়ে তোলার ক্যানভাসে পরিণত করতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক