করোনাভাইরাস সংক্রমণ আমাদের দেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে। ২৩ মার্চ যেখানে সংক্রমণ তথ্য ছিল মাত্র ছয়, এক মাসের ব্যবধানে একই সময়ে এপ্রিলে বেড়ে তা হলো চার হাজারের ওপর। আক্রান্তদের মধ্যে চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন ও সংবাদকর্মীরাও থাকছেন বেশ বড় সংখ্যায়। অন্যদিকে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় শারীরিক ও সামাজিক দূরত্বসহ অন্য সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে ব্যাপক শিথিলতা, অমনোযোগিতা ও অসতর্কতায় প্রশাসন, গণমাধ্যম ও গণমানুষ সর্বত্র ক্ষোভ ও হতাশা। কর্মহীন, বেকার ও আয়-উপার্জনবিহীন মানুষের জন্য সরকার ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেছে। সেখানেও যথাযথ শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হয়নি। তার ওপর টেনশন বাড়াচ্ছে কিছু অসাধু-দুর্নীতিবাজ মানুষ, যা নিয়ে সব মিলিয়ে সর্বত্র এক ধরনের টেনশন এবং এক ধরনের আহাজারি রয়েছে। প্রথমেই যেটি বলব, সংবেদনশীল যেকোনো মানুষ এ অবস্থায় সম্পূর্ণ স্থির, অবিচল ও নিরাবেগ থাকবেন, এটি ভাবা ঠিক নয়। তার পরও যারা দায়িত্বশীল, তারা তো বসে থাকতে পারেন না। তারা যথাসম্ভব নিরাবেগ হয়ে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করবেন এবং করছেন। যারা নীতিনির্ধারণ করছেন এবং যারা মাঠে আছেন, সবার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই সবিনয়ে কয়েকটি বিষয়ে কিছু বলতে চাই। এরই মধ্যে আরো বেশকিছু লেখায়ও কিছু কিছু লিখেছি।
সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য তিনটি কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা যেকোনো কারণে শুরু করতে দেরি হয়েছে। এক. বিদেশ প্রত্যাগতসহ সর্বত্র লকডাউন এবং ব্যাপক সংক্রমণ চিহ্নিতকরণ পরীক্ষা পরিচালনা; দুই. কঠোর লকডাউনের মাধ্যমে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব ব্যবস্থাকে স্বাস্থ্যবিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং তিন. মানুষকে নিজ নিজ অবস্থানে রাখার জন্য দক্ষ ত্রাণ তত্পরতা। আমরা অনেকেই সত্যিকার অর্থে করোনার ভয়াবহতা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে (২০২০) সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি। রাজনীতি ও প্রশাসনের লোকজন বিষয়টির ব্যাপকতা প্রথম অবস্থায় হয়তো বুঝতেই পারেননি। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য প্রফেশনাল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের কেউ কি জানুয়ারিতে সরকারের কাছে করোনা মোকাবেলার প্রস্তুতি এবং কর্মপরিকল্পনা বিষয়ে কোনো সুপারিশ করেছিলেন? আমাদের জানা নেই। যাই হোক, ‘গতস্য সূচনা নাস্তি!’ এখন পরীক্ষাগারের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে, তাই বর্ধিত হারে ও সংখ্যায় সংক্রমণ দেখতে পাচ্ছি। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের এবং স্বাভাবিকভাবে সরকারেরও উত্কণ্ঠা বাড়ছে। আমাদের ভঙ্গুর ও নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বর্তমান কাঠামোর আওতায় আগামী মে, জুন ও জুলাই মাসব্যাপী বর্ধিত সংক্রমিত রোগীদের সেবা দেয়ার মতো সক্ষমতা তৈরি করতে পেরেছি কিনা। এ সক্ষমতা সব অর্থে, যেমন হাসপাতাল, চিকিৎসক, অন্যান্য চিকিৎসাকর্মী, ঔষধপত্র, প্রয়োজনীয় অন্যান্য সরঞ্জাম ইত্যাদি। চিকিৎসক ও সর্বস্তরের চিকিৎসাকর্মী ও সহায়ক স্টাফ, তাদের সবার সুরক্ষা এক্ষেত্রে প্রধান অগ্রাধিকার হতে পারে। যেমন একজন ক্লিনার, আয়া, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার, লিফটম্যান, প্রহরী, বিদ্যুৎ-পানি সচল রাখার মেকানিক, তারা হয়তো সরাসরি স্বাস্থ্যকর্মী নন; কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন স্বাস্থ্যসেবার জন্য তাদেরও প্রয়োজন। একজন অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারের কাছে শোনা গেল, তাকে বাড়িওয়ালা বাড়িতে ঢুকতে দেন না, চা-দোকানি চা দিতে চান না; কারণ তার কাছ থেকে করোনা সংক্রমিত হতে পারে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য প্রশাসনকে এদের সবার বাসস্থান, খাদ্য ও নিরাপদ যাতায়াতের বিষয়ে বিশেষ যত্নবান হতে হবে। গত এক মাসের অভিজ্ঞতার নিরিখে এবং সংক্রমণের বর্ধিত হার ও সংখ্যাকে বিবেচনায় নিয়ে অন্তত আগামী তিন মাসের (মে, জুন ও জুলাই) চাহিদা সরকারের যথাযথ দপ্তরকে জানিয়ে দিতে হবে। এখানে অর্থ, বর্ধিত জনবল, চিকিৎসা ও চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট সব সামগ্রীর প্রয়োজনকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখায় শিথিলতা বা মানুষের মরিয়া হয়ে ঘরের বাইরে চলে আসার প্রবণতাকে কিছু সুশীল মানুষ বারবার ‘সচেতনতা’র অভাব হিসেবে চিহ্নিত করছেন। বিষয়টির মধ্যে স্ববিরোধিতা রয়েছে। আমার ধারণা, যারা এ ‘সচেতনতা’ প্রত্যয়টি ব্যবহার করছেন, তাদের সচেতনতার দৃষ্টিভঙ্গিটি খণ্ডিত। তথাকথিত শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের তার নিজের জীবন ও জগৎ নিয়ে এক ধরনের সচেতনতা থাকে। কোনো মানুষই তার জীবন-জগৎ নিয়ে অচেতন নয়। চেতনা বা সচেতনতা প্রত্যেকের স্ব-স্ব অবস্থানগত। তার কর্ম, জীবিকা ও পারিপার্শ্বিকতার যে সংস্কৃতি, তারই আবহে লালিত হয় তার চিন্তা ও চেতনা। ঘরে বসে থাকতে বলছেন, খুশি মনেই তো ঘরে বসে থাকার কথা। রাস্তায় বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ কেন করেন। এটি তার জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত চেতনার প্রতিফলন। ক্ষুধা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে একজন কর্মক্ষম নারী কিংবা পুরুষের ঘরের বাইরে আসা সচেতনতার অভাব নয়, নিরেট বাস্তবতা; সমস্যা অন্যখানে। একই রকমভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়ের জন্যও মানুষকে বাইরে আসতে হবে। এ ব্যবস্থা নিশ্চিত না হলে ‘লকডাউন’ পরিপূর্ণভাবে কাজ করবে না। তাই একদিকে শ্রমের মজুরি পাওয়ার নিশ্চয়তা, কাজের নিশ্চয়তা, দক্ষ ত্রাণ তত্পরতা, অন্যদিকে সীমিতভাবে নিত্যপণ্যের অভিগমন ও বাজারগুলোকে সচল রাখতে হবে। এটি নীতিনির্ধারক ও মাঠ প্রশাসন দুই পক্ষের জন্যই চ্যালেঞ্জ।
ত্রাণ তত্পরতা বিষয়ে যেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হচ্ছে কিছু নীতিগত ও কিছু মাঠ পর্যায়ে বিতরণ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক। আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন দেয়ার ব্যাপারে একটি প্রণোদনা প্যাকেজ এরই মধ্যে সরকার ঘোষণা করেছে, তার আশু বাস্তবায়ন প্রয়োজন। ইনফরমাল সেক্টরই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ । এক্ষেত্রে একদিকে সীমিতভাবে বাজার, কৃষি উৎপাদন এবং পণ্য পরিবহনের যানবাহন চালু রাখার বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। অন্যদিকে ত্রাণ, ত্রাণের ক্ষেত্রে একটি প্রধান বিষয় সম্পদ সংগ্রহ, সম্পদের জোগান বা বিতরণ। এক্ষেত্রে বিদেশী বা বহির্সম্পদ, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাশ্রয়কৃত অর্থ, প্রধানমন্ত্রীর তহবিল, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, খাদ্য, স্থানীয় সরকার, বাণিজ্য প্রভৃতি মন্ত্রণালয়ের সম্পদ ও সমর্থতা যাচাই প্রয়োজন।
মাঠ তথা ইউনিয়ন পর্যায়ে একটি বরাদ্দপত্র দেখে মনে হয়েছে সম্পদ মোটামুটি প্রয়োজন মেটানোর মতো দেয়া হয়েছে। একেবারে অপ্রতুল তা বলার অবকাশ কম। কিন্তু মাঠে অভিযোগের শেষ নেই। এ অভিযোগগুলো কি ভিত্তিহীন? একেবারে ভিত্তিহীন নয়। তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা দুটো স্থানে। সংরক্ষণের গুদাম, গুদাম থেকে বরাদ্দ ও পরিবহন এবং সর্বশেষ বিতরণ কেন্দ্র থেকে সুবিধাভোগীর হাত পৌঁছানো। জেলা পর্যায়ে চাল, ডাল, তেল ইত্যাদি গ্রহণ ও বণ্টন তালিকা সঠিক ও স্বচ্ছ রাখতে হবে। বণ্টনের পর সরবরাহ কেন্দ্র থেকে বিতরণ কেন্দ্র পর্যন্ত পরিবহন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি জেলায় ত্রাণ পণ্য পরিবহনের জন্য একটি নিজস্ব পরিবহন পুল বা ট্রাক ফ্লিট তৈরি রাখতে হবে। পরিবহন ব্যয় পণ্য গ্রহণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দায় হবে না। তা যদি হয় তাহলে অস্বচ্ছতার অবকাশ সৃষ্টি হবে। বিতরণ বা বণ্টন কেন্দ্র হবে একটি একক প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। একাধিক কেন্দ্র হলে সমন্বয় সমস্যা হবে। গ্রামে সে কেন্দ্র হবে ইউনিয়ন পরিষদ, শহরে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড। শিল্পাঞ্চল ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোর জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা হতে পারে। সরকারি-বেসরকারি সব ত্রাণ বিতরণ একক প্রতিষ্ঠানের তালিকায় থাকতে হবে। এক্ষেত্রে বেশকিছু সমস্যা এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে। প্রথম ও প্রধান সমস্যা বিশ্বাসযোগ্যতার। দ্বিতীয় সমস্যা তাদের ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার অভাব। এ দুই সমস্যা সত্ত্বেও এর ভালো বিকল্প নেই। বিশ্বাসের ঘাটতি পূরণের জন্য উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা, পুলিশ, সেনা সদস্যদের উপস্থিতি যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন অদলীয় স্বেচ্ছাসেবকের সম্পৃক্ততা। এ অদলীয় স্বেচ্ছাসেবকরা হবেন স্থানীয় স্কুল মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম এলাকার কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি। তালিকা তৈরি নিয়ে কিছু সমস্যা দেখা যাচ্ছে। কমবেশি গড়ে হাজারখানেক ব্যক্তি বা পরিবার ইউনিয়ন পরিষদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির তালিকাভুক্ত আছে। তার বাইরের অনেক খানাকে এ সময়ে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন পড়বে। এদের অনেকে হতে পারে ওই এলাকায় অভিবাসী, এলাকার ভোটার নন। কেউ হয়তো চাকরিজীবী বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিংবা রাজনৈতিক বিবেচনায় বিপক্ষীয়। কোনো কোনো চেয়ারম্যান-মেম্বার তাদের বাদ দিতে চান। এজন্যই সরকারি কর্মকর্তা ও এলাকার কিছু অদলীয় ব্যক্তির সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। এতে বিশ্বাসের ঘাটতি কিছুটা কমতে পারে। বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পেতে পারে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জির মতো আমারও বিশ্বাস, এটি একটি অস্থায়ী আয়োজন, এখানে প্রয়োজন দ্রুততার সঙ্গে সবার হাতে কিছু না কিছু পৌঁছানো। তাই তালিকা নিয়ে জটিলতা নয়, আগে বিতরণ এবং বিতরণ করতে করতে তালিকা হবে বিতরণের হিসাব পাওয়ার জন্য। সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ বিতরণের সুনির্দিষ্ট একক কেন্দ্র না থাকায় শক্ত-সমর্থরা দৌড়াদৌড়ি করে বা রাজনৈতিক বা ভোটার পরিচয় কাজে লাগিয়ে একাধিক উেসর ত্রাণ নিয়ে নিয়েছেন। অনেকে জোর করেও নিয়েছেন। বয়স্ক, অক্ষম, নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী তারা বাদ পড়ে যেতে পারেন। তাই ওয়ার্ডভিত্তিক জনসম্পৃক্ততা এক্ষেত্রে অবস্থার কিছুটা গুণগত পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তার পরও মাঠের বাস্তবতা হচ্ছে, এখানে জরুরি অবস্থার কারণে ১৫-২০ শতাংশ অনিয়ম অজান্তেই হয়ে যেতে পারে। এটিকে সহনীয় পর্যায়ের অনিয়ম বা সিস্টেম লস ধরে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ‘শূন্য দুর্নীতি তত্ত্ব’ মাথায় থাকবে, কিন্তু অবস্থার বাস্তবতায় বেশি কিছু করার নাও থাকতে পারে।
এ সময়ে ব্র্যাক দুই লাখ মানুষের মধ্যে ত্রাণকাজ করতে গিয়ে যে একটি সৃজনশীল পদ্ধতি অনুসরণ করছে, সেটিও ভেবে দেখা যায়। তারা প্রথমে দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে শুরু করে। তারপর ওই আগের বিতরণ তালিকা ধরে এখন নগদ অর্থ দিচ্ছে। তাতে বিতরণ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। আবার এ অর্থ বাজার ব্যবস্থা ও উৎপাদন ব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
রেশন কার্ড দেয়ার বিষয়ে কিছু পূর্ব অভিজ্ঞতা বিনিময় করা প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে রেশন ডিলার নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। আবার রেশন কার্ড দেয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি করে রাতারাতি প্রচুর ভুয়া রেশন কার্ড ইস্যু হয়ে যাওয়া রোধ করতে হবে। ১৯৭৩-৭৫ সাল সময়ে তৃণমূলে জনঅসন্তোষের একটা অন্যতম কারণ ছিল রেশন কার্ড-রেশন ডিলার, টিসিবির ন্যায্যমূল্যের দোকান ও ইউনিয়ন রিলিফ কমিটির দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও দলবাজি। এখন ২০২০ সালে ওই বিষয়টি স্মরণে রেখে এ রেশন ব্যবস্থায় যাওয়া উচিত। ভারতে রেশনিং চালু আছে। তাদের বিতরণ নেটওয়ার্ক, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ও আমলাতন্ত্রের গুণগত অবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক সুগঠিত। মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থাও প্রতিযোগিতামূলক। আমাদের সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক অবকাঠামো তাদের সমতুল্য নয়। প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনুপস্থিত। কেরালা রাজ্যের করোনা মোকাবেলায় কেরালার গ্রাম পঞ্চায়েতের ভূমিকা বিশ্বনন্দিত হচ্ছে। ২০১০ থেকে ভারতে ২৪ এপ্রিল জাতীয়ভাবে ‘পঞ্চায়েত দিবস’ পালিত হয়। এ বছরের পঞ্চায়েত দিবসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতবর্ষের ২ লাখ ৪৬ হাজার পঞ্চায়েত ও তাদের ৩৯ লাখ পঞ্চায়েত প্রতিনিধিকে এ মহাদুর্যোগে উপযুক্ত ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। ওইসব সফল অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বিষয় আমাদের এখানে প্রয়োগ করা যায়।
কর্মসংস্থান ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে কিছুটা গতিসঞ্চারে কৃষিবান্ধব কিছু নীতির বিষয় ভেবে দেখা যায়। সরকার এরই মধ্যে কৃষি খাতে ৫ হাজার কেটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। তা ব্যবহারের বিস্তারিত বিধিবিধান দ্রুত জারি হওয়া প্রয়োজন। কৃষিপণ্য পরিবহন এ মুহূর্তে খুব জরুরি। সরকারি-বেসরকারি ভ্যান ও ট্রাকের স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পরিবহন পুল করা য়ায়। এখানে বিচ্ছিন্নভাবে পুলিশের ট্রাক-ভ্যান রিকুইজিশন বন্ধ করতে হবে। ট্রাক শ্রমিকদের বেতন ও অন্য সব সুরক্ষা এ মুহূর্তে যা দরকার, তা দিতে হবে। কৃষিপণ্য বিশেষত সবজি পরিবহন ও বিপণনে সহায়তা করলে কৃষিতে কিছুটা প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে। আগামী ১৫ দিনে ধান কাটা ও মাড়াই শেষ করার একটি কার্যক্রম নিতে হবে। কৃষি বিভাগ ফসল কাটা ও মাড়াই যন্ত্র প্রচুর সংখ্যায় ভর্তুকি দিয়ে সরবরাহ করতে পারে। তারপর খাদ্য বিভাগ দ্রুত সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করে মিলে সরবরাহ করতে পারে। ফড়িয়া ও মিল মালিকের বদলে সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করলে ভালো হয় এবং সে ধান মিলারদের কাছে দিয়ে বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে টার্গেট পরিমাণ চাল গ্রহণ করবে। মিলাররা সরকারের কাছ থেকে ধান নিয়ে তা থেকে টার্গেট পরিমাণ চাল সরবরাহের জন্য মণ বা টনপ্রতি মিলিং খরচ বা সার্ভিস চার্জ পাবেন। চাষীদের সরকার ক্রয়মূল্যের সঙ্গে পরিবহন ব্যয় দিয়ে দিলে তারাই ধান সরকার নির্ধারিত দিনে মিল প্রাঙ্গণে নিয়ে আসবেন। তবে এজন্য এখনই কৃষকদের কাছে ধানের গুণগত মান সুরক্ষার নির্দেশনা চলে যেতে হবে এবং মিল মালিকদের সঙ্গে চাল সরবরাহের চুক্তি করার প্রস্তুতি নিতে পারে। এভাবে এ মৌসুমের ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম আগাম শুরু হতে পারে। মিলাররা পৃথকভাবে ধান ক্রয় করতে পারেন। তবে সরকার মিলারের কাছ থেকে নয়, কৃষকের কাছ থেকে কিনুক।
দেশে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ থাকাটা এ মুহূর্তের সংকটকালকে অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে। তাই যেকোনো মূল্যে আগামী দিনে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও তথ্যপ্রবাহ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হবে। আশা করা যায়, আগামী তিন মাসের একটি স্মার্ট প্ল্যান আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গতিপথকে মসৃণ করতে সাহায্য করবে।
লেখক : ড.তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ ।
ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ।