অস্থায়ী সরকারের সফল নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। ঘোষণাপত্র রচিত হয় ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার ভিত্তিতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান বাহিনী গ্রেফতার করে। ওই রাতেই বাঙালির প্রাণের নেতা শেখ মুজিবকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। তারা ভেবেছিল হয়তো শেখ মুজিবকে বন্দি করলেই বাঙালিকে রুখে দেওয়া যাবে। কিন্তু একাত্তরে মুক্ত মুজিবের চেয়েও বন্দি মুজিব বাংলার মানুষের কাছে হয়ে ওঠেন পাহাড়সম প্রেরণার উৎস। তাই তো ধর্ম-বর্ণ, নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক দাবি-বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দৃপ্ত শপথ নেয় বাঙালি জাতি।
১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে গঠন করা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। নবজাত রাষ্ট্রের এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জনগণকে তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে অদম্য স্পৃহায় মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টি ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নবগঠিত এই সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এই সরকারের যোগ্য নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধ দ্রুততম সময়ে সফল সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যায়।
মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মূলত এই সরকারের নেতৃত্বেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর নানা দিক থেকেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হয়েছে। মেট্রোরেল চালু হয়েছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা সূচকেও পাশ্ববর্তী দেশগুলো থেকে এগিয়ে বাংলাদেশ। এই অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বজায় রাখতে হবে এবং নতুন প্রজন্মকে মুক্তযুদ্ধের চেতনায় শাণিত হতে হবে। প্রতিরোধ করতে হবে যে কোন ইতিহাস বিকৃতির। ঘোষণাপত্রে সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া তাজউদ্দীন আহমদ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী নিযুক্ত হন।
অপরদিকে জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রব চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। প্রথমে ৭টি মন্ত্রণালয় নিয়ে সরকার গঠিত হয় এবং ৪ জন মন্ত্রী এই ৭টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৭ এপ্রিল খুব ভোরে কলকাতা থেকে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা মেহেরপুরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তাঁদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেয় বিএসএফ। মেহেরপুর সীমান্তবর্তী মহকুমা। সকাল ১১টা নাগাদ ছোট একটি গাড়ি বহর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মেহেরপুরে প্রবেশ করে সীমান্তসংলগ্ন আম্রকুঞ্জ বৈদ্যনাথতলায় অবস্থান নেয়। স্থানীয় একটি গির্জা থেকে কিছু টুল-টেবিল এনে বানানো হয় একটি ছোট মঞ্চ। সামনে বিদেশি সাংবাদিকদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। অনুষ্ঠানের পরিচালক সংসদ সদস্য এম এ মান্নান অনুষ্ঠান সম্পর্কে সবাইকে ব্রিফ করেন। খুবই সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে প্রথমে সংসদ সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। তারপর বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে
একটি চার সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। সেখানে স্বাধীনতার মূল ঘোষণা আদেশ পাঠ করেন গণপরিষদের স্পিকার ইউসুফ আলী। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও উপরাষ্ট্রপতিকে শপথ বাক্য পাঠ করান অধ্যাপক ইউসুফ আলী। কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। অনুষ্ঠান শেষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত জনগণ ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। তাঁরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা ও সমর্থন দেওয়ার আহবান জানান।
স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন প্রধানত নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানের সুবিধার্থে মুজিবনগর সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতার ঐতিহাসিক থিয়েটার রোডের ৮নং বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজনৈতিক, সামরিক এবং কূটনীতিক বিষয়গুলো পরিচালনা করা হয়েছিল। ভারত সরকারের সঙ্গে সমন্বয়, নিজেদের মধ্যে বিভেদ সামাল দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক জনমত গঠন এসব কিছু একসঙ্গে করতে হয়েছে অস্থায়ী সরকারকে। বহির্বিশ্বে সরকারের বিশেষ দূত নিযুক্ত হয়েছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েন।
ইতিহাসের পাতায় ‘মুজিবনগর দিবস’ হিসেবে চিরস্মরণীয়। জাতির বীরত্বগাথা সৃষ্টির এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত ছিল দিনটি। কত শত সংগ্রাম, আন্দোলন, ত্যাগ-তিতিক্ষা, বিদেশি ও ঔপনিবেশিক এবং দখলদার শাসকের জেল-জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, ত্রাসন সয়ে বাঙালি যে তার স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল- এই দিনটি সেই আনুষ্ঠানিকতাকে ধারণ করে মুক্তির লড়াইকে ত্বরান্বিত করেছিল মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে। যার ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশ, পরবর্তীকালে যা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, কূটনৈতিক ও প্রচার ক্ষেত্রে বিশ্বজনমত গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল অস্থায়ী সরকার। এই সরকারের দক্ষতার ফলেই মাত্র ৯ মাসে বাংলাদেশ হানাদার পাকিস্তানিদের দখলমুক্ত হতে পেরেছিল।
পঁচাত্তরপরবর্তী সময় থেকে দেশে যে ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসব শুরু হয়, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, মানবতা বিরোধী অপরাধীদের সরকারের অংশ বানিয়ে জাতীয় ইতিহাসের প্রকৃত নায়কদের কৃতিত্ব মুছে ফেলার অপপ্রয়াস অব্যাহত রাখে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এর রয়েছে দীর্ঘ
আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতা। এই দীর্ঘ প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজন ছিল অবিচল রাজনৈতিক নেতৃত্ব। সেই সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধের ৯ মাস তিনি সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও ছিলেন সাড়ে সাত কোটি মানুষের সত্তায়, ছিলেন মূল চালিকাশক্তিস্বরূপ। সেই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে। যেখানে তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে নেতৃত্বে নিয়ে গঠিত হয় বিপ্লবী সরকার। শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ধারণ করেই সেই সরকার হয় মুজিবনগর সরকার। মুজিবনগর সরকারের তাৎপর্য এখানেই।
বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বানে স্বাধীনতাকামী বাঙালি প্রথমে দেশের ভেতরেই প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলে। পাকিস্তানি সেনারা যখন প্রতিটি শহরে ও গ্রামে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে, দেশের ভেতরে থেকে যুদ্ধ করা কঠিন হয়ে পড়ে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। মার্চের শেষ দিকে ঝিনাইদহের সে সময়কার এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমেদ পিএসপি এবং মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরী সিএসপি-এর সহযোগিতায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ সহযোগী আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে সীমান্ত পার হন এবং ৩ এপ্রিল দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত সরকারের সহযোগিতা চান। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেছিল সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করা হবে।
এ সামরিক বিচারের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের সব রাষ্ট্রনেতার কাছে বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষার আবেদন জানান। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে মস্কোর একটি সভাতে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যা ঘটছে তাকে এখন আর ওই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। প্রায় ১ কোটি মানুষ আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। ওই মানুষগুলোর কি নিজের দেশে বসবাস করার বা কাজ করার অধিকার নেই? এখন বিশ্বের রাষ্ট্রনেতাদের দেখতে হবে যাতে এই অসহায় মানুষগুলো নির্ভয়ে নিজের দেশে ফিরে যেতে পারে।’ ৭ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ভারতে আসেন। বাংলাদেশ পরিস্থিতি আলোচনায় কিসিঞ্জার জানালেন বাংলাদেশকে কেন্দ্র কওে কোনো যুদ্ধে ভারত অগ্রসর হলে আমেরিকা ভারতের পাশে দাঁড়াবে না। কিসিঞ্জার ভারত থেকে পাকিস্তান হয়ে গোপনে চীনে গিয়েছিলেন।
ইন্দিরার পরামর্শদাতা পিএন হাকসার, ডিপি ধর, টিএন কল এবং এলকে ঝা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৎকালীন ভারতের রাষ্ট্রদূত) প্রধানমন্ত্রীকে সোভিয়েত রাশিয়ার সহায্য নিতে পরামর্শ দিলেন। কিসিঞ্জারের চীন-বৈঠকের এক মাস পর ‘রুশ-ভারত মৈত্রী’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ৯ আগস্ট ১৯৭১। এর ফলে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসির আদেশ দিতে ভয় পেয়ে যায়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম ভূমিকা পালন করে মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন। অভ্যন্তরীণ প্রশাসন ছিল সামরিক ও বেসামরিক এই দুই ভাগে বিভক্ত। সামরিক প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত হতো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের সমগ্র যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে অধিনায়ক নিযুক্ত করা ও যুদ্ধ পরিচালনা তদারকি করা ছিল এ মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ। বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সাধারণ প্রশাসন এবং তথ্য ও বেতার বিভাগ। শরণার্থী সমস্যা, আঞ্চলিক সামরিক বেসামরিক বিষয়াবলির সুষ্ঠু সমন্বয় ইত্যাদি ছিল আঞ্চলিক প্রশাসনের প্রধান কাজ। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। মুজিবনগর সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্বে বিশেষ দূত নিয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বহির্বিশ্বে সমর্থন ও জনমত আদায়ের চেষ্টা করেন। এ ধরনের তৎপরতার ফলে ওইসব দেশে মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে সংবাদ শিরোনাম প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বিচারপতি চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর শারীরিক সুস্থতা ও প্রাণহানির আশঙ্কায় ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন। ১৪ মে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সে সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব পাস হয় যে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রিটেনের যে প্রভাব রয়েছে তা প্রয়োগ করে পাকিস্তানকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারে বাধ্য করা ব্রিটিশ সরকারের কর্তব্য।
লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনে নিয়োজিত দ্বিতীয় সেক্রেটারি মহিউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের চাকরি হতে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ১ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন ওয়াশিংটনে পাকিস্তানি দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলর এএমএ মুহিত। ৪ আগস্ট ওয়াশিংটনে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাস ও নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ দফতরে পাকিস্তানি মিশনের মোট ১৫ জন বাঙালি কূটনীতিক একযোগে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের ডিরেক্টর অব অডিট ও অ্যাকাউন্টস লুৎফুল মতিন। বঙ্গবন্ধুর বিচারের প্রতিবাদে ১১ আগস্ট লন্ডনের হাইড পার্কে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ৪ অক্টোবর নয়াদিল্লিস্থ পাকিস্তানি দূতাবাসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী প্রকাশ্যে বাংলাদেশ আন্দোলনে যোগদান করেন।
মুজিবনগর সরকার ২৪ মে বিচারপতি চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে যান। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি নরওয়ে, সুইডেন, মিসর, ইরাক, জর্ডান, সিরিয়া, সৌদি আরব, আলজেরিয়া প্রভৃতি দেশের রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘে অবস্থিত বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করেন। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিভিন্ন দেশ পরিষ্কার ধারণা লাভ করে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদা পেতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত পাকিস্তান বাহিনীর অধিনায়ক লে. জেনারেল নিয়াজী পূর্বাঞ্চলে নিয়োজিত ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর যৌথ কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নিকট বিকাল ৪.৩১ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। মুজিবনগর সরকার ছিল জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়েই গঠিত সরকার। মুক্তিযুদ্ধের ওপর এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তার ঠিক ২১৪ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আরেক আম্রকাননে যেন বাংলার সেই অস্তমিত সূর্য আবারও উদিত হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক