বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংযোগ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য এবং শিল্পকলা সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে যেমন মিল রয়েছে তেমনি এই বিষয়গুলোর প্রতি দুই দেশের মানুষের আবেগও প্রায় একইরকম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ভারত বাংলাদেশের জন্য সরাসরি যুদ্ধে জড়ালেও, তাদের সীমান্ত খোলা রেখেছিল পাকিস্তানিদের দ্বারা বাঙালিদের গণহত্যার শুরু থেকেই। নিষ্ঠুরতা থেকে বাঁচতে দেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারত সরকার নানা অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধে নিপীড়িত মানুষদের দীর্ঘ ৯ মাস আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে তার প্রতিবেশী ভারতের সম্পর্কের সূচনা হয় ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধীর কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও আদর্শিক নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে সেই সম্পর্ক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছায়। ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকবে। বিশ্বের কোনো শক্তিই পারবে না এই মৈত্রীতে ফাটল ধরাতে।’ বঙ্গবন্ধু দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি গড়েছিলেন, একে অপরের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখ-তা, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে। বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত কূটনৈতিক সম্পর্কের পথেই চলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কৌশলগত পরিস্থিতির কারণে একে অন্যের বৈদেশিক নীতিতে দুই দেশই অগ্রাধিকার পেয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালে পরিবারের সব সদস্যকে হারিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ভারতের আশ্রয় ছিলেন ছয় বছর। শেখ হাসিনা সরকারের সফল কূটনৈতিক তৎপরতায় ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত স্থলসীমানা ও সমদ্রসীমা শান্তিপূর্ণভাবে নির্ধারিত হয়েছে। ২০১১ সালে সীমানা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ-ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করে, যা তিন বিঘা করিডর চুক্তি নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশি নাগরিকদের তিন বিঘা করিডোর দিয়ে ২৪ ঘণ্টা যাতায়াতের পক্ষে সম্মত হয়। ২০১৫ সালে ভারতীয় সংসদ, সর্বসম্মতভাবে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থলসীমানা চুক্তি অনুমোদন করে যার ফলে দুই দেশের সীমানা নিয়ে বিবাদ শেষ হয়। ২০১৫ সালে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে ৫০ হাজার বিচ্ছিন্ন নাগরিক, যাদের কোনো জাতীয়তা ছিল না, তারা ভারত অথবা বাংলাদেশের নাগরিক হন। ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে তৎকালীন ১১১টি ভারতের ছিটমহল বাংলাদেশের এবং বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে যায়। বাংলাদেশ পায় ১৭ হাজার ২৫৮ একর এবং ভারত পায় ৭ হাজার ১১০ একর ভূমি।
দুই পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণ করে এবং সুষমভাবে চুক্তিটি যদি সম্পাদন করা যায় তবে তা দুই দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য সুফল বয়ে নিয়ে আসবে। অভিন্ন ইতিহাস একই ধরনের মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, শিল্প, সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই ধরনের পারস্পরিক উন্নয়নের সদিচ্ছা থাকা স্বাভাবিক। দ্বিপক্ষীয় উন্নয়নের সদিচ্ছার পাশাপাশি বাস্তবায়নেও জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশ-ভারত পরস্পরের ভৌগোলিক সীমারেখা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। দুই দেশই পরস্পরের উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে বেশ সক্রিয়। ২০১১ ও ২০১৪ সালে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ভারত বাংলাদেশকে ঋণসহায়তা দেয়। বিভিন্ন ঋণচুক্তির আওতায় (২০২০ সাল পর্যন্ত) বাংলাদেশকে ৮০০ কোটি ডলারের সহায়তা দিয়েছে ভারত, যা একক কোনো দেশকে দেওয়া সর্বোচ্চ সহায়তা। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সামরিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। এক দশক আগে শুরু হওয়া ঐ ঋণ চুক্তির বাস্তবায়ন নানা কারণে ধীর হলেও আশা করা যায় দ্রুতই গতির সঞ্চার হবে।
বিশ্বায়নের যুগে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্ক তৈরিতে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। গত কয়েক বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি, অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল রুট-সম্পর্কিত প্রটোকল, ঢাকা-গুয়াহাটি-শিলং এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার-সম্পর্কিত সমঝোতা স্মারকসহ বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা দেশ দু’টির আন্তঃযোগাযোগ সম্প্রসারণে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে। আখাউড়া আগরতলা রেল সংযোগ, খুলনামোংলা রেল সংযোগ এবং মিতালি এক্সপ্রেস চালু হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন হয়েছে। সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সব স্থল ও নৌ সংযোগগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ সুদৃঢ় হয়েছে। পদ্মা রেললিংক ও খুলনা-মোংলা রেলপথ দুই দেশের যোগাযোগের জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মানুষে মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থার অগ্রগতি বিশাল ভূমিকা রাখবে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ বিবেচনায় ১৯৯৬ সালে দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যৌথ নদী কমিশনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাতটি নদীর পানিবণ্টনের রূপরেখা চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত আগেই হয়েছে এবং আটটি নদীর পানির তথ্য-উপাত্ত বিনিময়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া যৌথ নদী গঙ্গার পানির সর্বোচ্চ ব্যবহারেও একটি যৌথ সমীক্ষার বিষয়ে সম্মত হয়েছে দুই দেশ। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তবে তা পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে সমাধান করা সম্ভব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে পারস্পরিক সহযোগিতায় জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে মোকাবিলা করা যায় এবং অভিন্ন নদীগুলোর পানি সম্পদের সুষম ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তা আলোচিত হলে উভয় দেশই লাভবান হবে।
বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই সন্ত্রাসবাদ নিরসনে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে ভূমিকা রাখছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ৯৬ দশমিক ৭ কিলোমিটার, যা বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘ সীমান্ত। দুই দেশের বন, নদী, গ্রাম এবং কৃষিজমির ওপর এই সীমান্ত বিস্তৃত, তাই দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীদের জন্য সীমান্তের ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্ত হত্যা কমে এলেও, সীমান্তে নিরস্ত্র লোকজনের হত্যা পুরোপুরি বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের আরো কাজ করতে হবে। সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মানব, মাদক ও সব ধরনের চোরাচালান বন্ধ করতে চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে উপযুক্ত পদক্ষেপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব একটি সংকটকাল পার করছে। ফলে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারসাম্য রক্ষা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ সমর্থ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন জরুরি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় খাদ্যসামগ্রী, ভোজ্য ও জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়াতেও ব্যাপকভাবে পড়ছে। এই বৈশ্বিক বাস্তবতায় জ্বালানি খাতে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতায় মনোযোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ, কারণ ভারত জ্বালানি খাতে তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নেই। যুদ্ধের কারণে বিশ্ব যে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে সেখান থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্বস্ত প্রতিবেশী হিসাবে বাংলাদেশ এবং ভারতের একে অপরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে।
ধর্মনিরপেক্ষতা, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর থেকে অনেক এগিয়ে আছে। তবে বাংলাদেশ কিংবা এই উপ-অঞ্চলের কোনো দেশ একা টেকসই সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না।
দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারসাম্য রক্ষা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন জরুরি। শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল আঞ্চলিক পরিস্থিতি ও নিরাপদ প্রতিবেশী উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে অবশ্য প্রয়োজনীয়। ভারত আর বাংলাদেশের উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি অনেকটা একই রকম। আবার আমাদের আপামর জনগণের জন্য উন্নত জীবনের আকাক্সক্ষাও প্রায় অভিন্ন। একে অন্যের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার, জ্ঞান বিনিময়ের এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার অসংখ্য সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের অনুসৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে নিরপেক্ষ নীতি দুই দেশের সৌহার্দপূর্ণ ভবিষ্যতের জন্য অপরিমেয় ভূমিকা রাখতে পারে। প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর বর্তমান বৈশ্বিক সংকটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি পারস্পরিক উন্নয়ন, আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা আরো সুসংহত করবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি মাইলফলক অগ্রগতি সূচিত হয়েছে সম্প্রতি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন’ উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পরপরই আসামের নুমালিগড় থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের পার্বতীপুরের ডিপোতে ডিজেল আসা শুরু হয়েছে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১০ লাখ টন তেল আমদানি করতে পারবে। এতে সড়ক বা রেলপথে তেল পরিবহণে যে বিপুল ব্যয় ও সময়ের প্রয়োজন হয়, তা সাশ্রয় হবে। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় ডিজেলের স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে দুই দেশই কীভাবে উপকৃত হতে পারে, একের পর এক তারই নজির সৃষ্টি হচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার ওপর পাশ্চাত্যের নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অনেক দেশই প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল সংগ্রহ করতে পারছে না। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৭০ থেকে ৭২ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ডিজেলেরই চাহিদা রয়েছে ৪৮ থেকে ৪৯ লাখ মেট্রিক টন, যার ৮০ শতাংশই সরকারকে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বর্তমান প্রক্ষাপটে এই পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করা রীতিমতো দুরূহ হয়ে উঠেছে। তদুপরি আমদানি করা তেল পরিবহণে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সময়ও লাগছে অনেক বেশি। এমন পরিস্থিতিতে কম খরচে নতুন উৎস থেকে ডিজেল আমদানির পথ খুঁজছিল সরকার। ভারত থেকে পাইপলাইনে ডিজেল আমদানি সেই বিকল্প উৎস হিসেবেই কাজ করবে। আগে ভারত থেকে জ্বালানি তেল আসত মূলত রেলপথে। বছরে আমদানি করা তেলের পরিমাণ ছিল ৬০ থেকে ৮০ হাজার টন, যা আমাদের জ্বালানি চাহিদায় বিশেষ কোনো ভূমিকাই রাখত না। আবার জাহাজে আসা তেল চট্টগ্রাম বা মোংলা থেকে সড়ক বা নদীপথে উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত নিয়ে যেতেও অনেক সময় ও অর্থের প্রয়োজন হতো। এখন তা অনেক সাশ্রয়ী হবে। উভয় দেশ শুধু নয়, নেপাল, ভুটানসহ উপ-আঞ্চলিক সমৃদ্ধির জন্যও পারস্পরিক সহযোগিতা একান্তভাবে প্রয়োজন। বাংলাদেশ ভারত থেকে বর্তমানে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। ভারত বাংলাদেশে ট্রানজিট সুবিধা পাচ্ছে। উপ-আঞ্চলিক জোট বিবিআইএনভুক্ত চারটি দেশই অদূর ভবিষ্যতে উন্নততর কানেক্টিভিটির আওতায় আসবে, এমনটিই আশা করা হচ্ছে। এতে সব ক’টি দেশই ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে। বর্তমান যুগে একা চলার কিংবা দ্বার রুদ্ধ করে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। আর সে কারণেই দুই দেশের মধ্যকার সহযোগিতামূলক সম্পর্ক দ্রুত এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দু’টি প্রতিবেশী রাষ্ট্র। দুটি দেশ একই সঙ্গে সার্ক, বিমসটেক, আইওয়া এবং কমনওয়েলথের সাধারণ সদস্য। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক উদারীকরণের সূত্রপাতের সঙ্গে তা বৃহত্তর প্রবৃদ্ধি ও বাণিজ্যের উদ্ভব ঘটায়। বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই সন্ত্রাসবাদবিরোধী কৌশলগত অংশীদার হিসেবে ভূমিকা রাখছে। তারা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় এলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কেও ক্ষেত্রে নবদিগন্তের সূচনা হয়। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ঐতিহাসিক ভিত্তি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ যা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় চেতনাকে বেগবান করা। ফলে দুই দেশের নীতি-নির্ধারকদের কাছে সম্পর্কের আস্থা সুসংহত করে বিদ্যমান বিরোধগুলোকে সহনশীল মাত্রায় নামিয়ে আনা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এ সম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থা ও সহযোগিতার মাধ্যমে আরও গভীর হবে- তাতে দুই দেশের মানুষই ভালো থাকবে। বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্ক দুই দেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। কোনো ষড়যন্ত্র বা ভুল বোঝাবুঝি যেন দুই দেশের সম্পর্ক দুর্বল না করতে পারে সেদিকে সবাইকে নজর রাখতে হবে।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক