বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভৌগোলিক দুর্গমতার কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোকে জাতীয় গ্রীডলাইনে বিদ্যুতের আওতায় আনা আগামি কয়েক দশকে সম্ভব নয়। পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম এলাকায় শত শত বছর ধরে শত শত মানুষ দুর্গম জঙ্গলের গহীনে পাহাড়ের কোলে বসবাস করে আসছে। ছোটো ছোটো পাড়া গড়ে তোলে সেখানে ২০ থেকে ৮০ পরিবার বসবাস করছে। পার্বত্য অঞ্চল যুগের পর যুগ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। সরকারের সামাজিক সেবাগুলোর মধ্যে বিশেষ করে বিদ্যুৎ সেবা দুর্গম পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের কাছে সহজে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য তিন জেলার ২৬টি উপজেলায় বিদ্যুৎ সুবিধা বঞ্চিত ৪০ হাজার মানুষের জন্য সোলার হোম সিস্টেম সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বিতরণ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া কমিউনিটি সিস্টেমে পাড়াকেন্দ্র, ছাত্র হোস্টেল, অনাথ আশ্রম কেন্দ্র ও এতিমখানায় সোলারের আলো পৌঁছে দেওয়ারও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
সোলার প্যানেল হলো ছোটো আকারে একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ কেন্দ্র। সোলার প্যানেল বিভিন্ন ফটোভোল্টাইক (পিভি) ভোল্টেজ ও ওয়াটজে বিভক্ত থাকে। সোলার হোম সিস্টেম একেকটি ১০০ ওয়াট পিক ক্ষমতা সম্পন্ন হয়। সোলার কমিউনিটি সিস্টেম ৩০০ ওয়াট পিক ক্ষমতাসম্পন্ন। সোলার প্যানেল সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। ২০ বছরের ওয়েরেন্টিসহ সোলার প্যানেল বিদ্যুৎ উৎপন্ন ও বিতরণ এর জন্য একটি চার্জ কন্ট্রোলার আছে। চার্জ কন্ট্রোলারটি চার্জার ব্যাটারি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। চার্জার ব্যাটারির ওজন ২৫ থেকে ২৬ কেজি হয়ে থাকে। ব্যাটারিটি জেলযুক্ত থাকে। এটাতে পানি দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। সোলার হোম সিস্টেম প্যানেলের সাহায্যে ৪টি এলইডি বাল্ব, একটি পাখা, একটি টিভি ও একটি মোবাইল চার্জার চালানো যায়।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর তত্ত্বাবধানে সোলার প্রকল্পের মাধ্যমে ৪০ হাজার সোলার হোম সিস্টেম এবং ২ হাজার ৫শ’টি প্রতিষ্ঠানকে কমিউনিটি সোলার প্যানেল বিতরণ কাজ ২০২৩ সালের জুন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হচ্ছে। ৩ জুন ২০২৩ খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী দুর্গম এলাকায় ৯৫৪ পরিবারের মাঝে সোলার হোম সিস্টেম বিতরণ করা হয়। নির্বাচিত উপকারভোগীদের মাঝে বান্দরবান জেলায় ১৪ হাজার পরিবার, রাঙ্গামাটি জেলায় ১৩ হাজার পরিবার এবং খাগড়াছড়ি জেলায় ১৩ হাজার পরিবারকে সোলার হোম সিস্টেম বিতরণ করা হয়েছে। একইভাবে বান্দরবান জেলায় ৯০০টি প্রতিষ্ঠান, রাঙ্গমাটি জেলায় ৮০০ প্রতিষ্ঠান ও খাগড়াছড়ি জেলায় ৮০০ প্রতিষ্ঠানকে সোলার কমিউনিটি সিস্টেম বিতরণের জন্য বিভাজন করা হয়েছে। সকল উপকারভোগীদের মাঝে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সোলার প্যানেল বিতরণ করা হয়েছে। সোলার প্যানেল সঠিকভাবে পরিচালনা ও ব্যবহার পদ্ধতি আয়ত্তে রাখার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী প্রত্যেক পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ৬৫০ টাকা ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। ২১৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০২০ সাল থেকে জুন ২০২৩-এর মধ্যে সোলার প্যানেল প্রকল্পটির ২য় পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন হবে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গিকার ও নির্দেশনাকে বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেন সোলার প্যানেলের মাধ্যমে আলোর হাট বসেছে। সোলার প্যানেলের আলো দেখতে পেয়ে পাহাড়ি দুর্গম এলাকার মানুষ অনেক খুশি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সবখানেই আলোর ঝলসানি। পাহাড়ি সহজ সরল বৃদ্ধ, নবীন সবাই এখন অন্ধকারের বুকে আলো জ্বলতে দেখছে। বিনামূল্যে সৌর বিদ্যুতের সুবিধা পেয়ে পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের জীবন মান আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। যার সুফল দেশের অর্থনীতির গতিকেও সম্প্রসারিত করেছে। আগে যেখানে সন্ধ্যে নামলেই পাহাড়িরা কুপি, হারিকেন আর জোনাকি পোকার নিভু নিভু আলো দেখতো, এখন সেখানকার মানুষ সোলার প্যানেলের আলোর ঝলসানো ফোয়ারা দেখছে। সৌর আলোয় মানুষ রাতে এখন আগের চেয়ে কর্মে বেশি মনোনিবেশ করছে। আলোয় আলোয় এখানকার মানুষের জীবন সুখ ও আনন্দে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। রেডিও, টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল, ডিশ এ্যান্টেনাসহ প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এখানকার কিশোর, কিশোরী, যুবক, যুবতীরা মেতে ওঠেছে সর্বত্রই।
কমিউনিটি সিস্টেমের মাধ্যমে বিদ্যুত বঞ্চিত পাড়াকেন্দ্র, ছাত্র হোস্টেল, অনাথ আশ্রম কেন্দ্র ও এতিমখানায় অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনায় আগের চেয়ে অনেক ভালো করছে। তারা জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিজয় ছিনিয়ে নিচ্ছে। সোলার প্যানেলের আলো পেয়ে উপকারভোগীদের মধ্যে আনন্দের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার ওয়াগ্গা ইউনিয়নের বল্টুগাছেমন পাড়া গ্রামের মিতা চাকমা উচ্ছাসের সাথে বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের পাহাড়িদের জন্য বিদ্যুতের সুবিধা করে দিয়েছেন। কই আগের কোনো সরকারই তো পাহাড়ি জনগণের জন্য কিছু করে নাই। ঘরে সোলার বিদ্যুত পাওয়ায় আমার ৩ ছেলে মেয়ে পড়াশুনায় আগের চেয়ে অনেক মনোযোগী হয়েছে। স্কুলে তারা ভালো করছে। রাতে আমাদের কাজকামে অনেক সুবিধা হচ্ছে।”তিনি প্রধানমন্ত্রীকে এজন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এ ছাড়া ভুলানগাছ, মনপাড়ার জুম চাষি জয়ধন তঞ্চংগা, রূপন, বিমল চন্দ্র, সূর্য মনি তঞ্চংগা, কলুইতলীর বৃদ্ধা যতীন মালা সোলারের আলো পেয়ে বেজায় খুশি। সবাই দেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ূ কামনা করেন। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বালুখালী ইউনিয়নের খারিক্রং নিশিপাড়ার হৃদয় রঞ্জন, নোয়ামনি পাড়ার হৃশিতাসহ বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি ও খাগড়াছড়ির মানিকছড়ির বাটনাতলী ইউনিয়নের উপকারভোগীরা সোলার প্যানেল পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি একই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক দুর্গম গ্রাম রয়েছে, যেখানে কখনও বিদ্যুৎ পৌঁছানো সম্ভব নয়। সেসব গ্রামের সুবিধা বঞ্চিত বাসিন্দাদের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বিনামূল্যে সোলার প্যানেল সিস্টেম দিয়ে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি পাহাড়ি প্রত্যন্ত মানুষদের কাছে প্রধানমন্ত্রীর উপহার সোলার প্যানেলগুলো পৌঁছে দিচ্ছেন। সরকারের একজন মন্ত্রী পাহাড়ি দুর্গম এলাকাগুলোতে প্রধানমন্ত্রীর উপহার নিয়ে ছুটে চলেছেন, এতে এলাকাবাসী বেজায় খুশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছার কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকার মানুষ আজ বিদ্যুতের সুবিধা সম্পূর্ণ বিনামূল্যেপাচ্ছে। প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গিকার নিয়েছিলেন তিনি, তারই বাস্তবায়ন এটি।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়
পিআইডি ফিচার