পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট — মর্মান্তিক ও শোকাবহ ঘটনাবলি – এবাদত আলী

(পুর্র্ব প্রকাশের পর) (৭)
(১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট। ভোর প্রায় ৫টা ৫০ মিনিট। দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই সিঁড়ির মুখে মেজর হুদাকে দেখে বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে ওঠেন, ‘‘ তোরা কি চাস? তোরা কি আমাকে মারতে চাস?’’ মেজর হুদা বলে ‘আামি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’ বঙ্গবন্ধু বলেন ‘‘ তুই আমাকে মারতে চাস? কামাল কোথায়? তোরা কামালকে কি করেছিস? উত্তরে হুদা বলে ‘ স্যার কামাল তার জায়গায়ই আছে আর আপনি তুই তুই করে বলবেননা। আপনি বন্দি, চলুন।’ এবার গর্জে উঠলেন বঙ্গবন্ধু ‘‘ কি তোদের এত সাহস! পাকিস্তানি আর্মিরা আমকে মারতে পারেনি। আমি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি। বাঙালি আমাকে ভালোবাসে কেই আমাকে মারতে পারেনা।’’ )।

১৯৭৫ সালের পৈশাচিক সেই ঘটনার বিষিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও সুত্র হতে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও তখন বিভেদ ছিলো। জিয়াউর রহমানের জেড ফোর্স এবং খালেদ মোর্শারফের ও কে এম শফিউল্লাহর ‘কে’ ও ‘এস ফোর্সের’ সদস্যদের মধ্যে বনিবনা ছিলোনা।
১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজেিবর ঘনিষ্ঠ সহযোগী রেডক্রসের চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফা ও একজন সামরিক কর্মকর্তা মেজর শরিফুল হক ডালিমকে ঘিরে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায়। ঢাকা লেডিস ক্লাবে মেজর ডালিমের খালাতো বোন তাহমিনার বিয়ে হচ্ছিলো কর্নেল রেজার সাথে , সেখানে এই ঘটনা ঘটে। কথা কাটাকাটির জের ধরে গোলাম মোস্তফা, মেজর ডালিম, তার স্ত্রী নিম্মি, কর্নেল রেজার মাকে অপহরণ করে রেডক্রিসেন্টের মাইক্রোবাসে রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তর হয়ে শেখ মুজিবের বাস ভবনে নিয়ে আসে। তবে ইতোমধ্যে ডালিমকে অপহরণে বেঙ্গল লেন্সার্স গোলাম মোস্তফার বাড়িটি আক্রমণ করে এবং সবাইকে জিম্মি করে। সারা শহরে সেনা বাহিনীর চেকপোষ্ট বসানো হয় ডালিমদেরকে খুঁজে উদ্ধারের জন্য। শেষ পর্যণÍ সেনাপ্রধানকে ডাকিয়ে তার সামনে সেখানে শেখ মুজিবুর রহমান বিষয়টি মিমাংসা করে দেন। সেদিন ডালিম ও মোস্তফা মিষ্টি খেয়ে প্রায় মাঝ রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরে গিয়েছিলেন।

কিন্তু এ মিমাংসায় সন্তুষ্ট না হয়ে সেদিন মধ্য রাতে ডালিম সেনানিবাস থেকে এক ট্রাক সৈন্য এনে গাজীর নয়াপল্টনস্থ বাড়ি ভাংচুর করে। এ নিয়ে তদন্ত অনুষ্ঠিত হয় এবং তদন্তের পর শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে মেজর ডালিমকে বরখাস্ত করা হয়। বেঙ্গল লান্সার্স এবং মেজর শরিফুল হক ডালিমসহ জড়িত ক্ষুব্ধ অফিসারেরা অনেকেই পরবর্তীতে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যায় অংশ নিয়েছিলেন।
সিরাজ শিকদারের উত্থান ও মৃত্যু: ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে মাওবাদী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিস্তৃতির এক পর্যায়ে পুর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি নামে একটি সশস্ত্র দলের মাওবাদী নেতা সিরাজ শিকদার আলোচিত হয়ে ওঠেন। এটি ছিলো একটি উগ্র বামপন্থী দল যার বিরুদ্ধে গুপ্ত হত্যা, রাহাজানি, আইন শৃঙ্খলা বক্ষা বাহিনীতে সশস্ত্র হামলা, পাটও খাদ্য গুদামে অগ্নি সংযোগ খাদ্যদ্রব্য বহনকারি পরিবহন ধ্বংস ইত্যাদি সহিংস নাশকতামুলক ও অন্তর্ঘাত মুলক তৎপরতার অভিযোগ ছিলো। তার দলের বিভিন্ন বিক্ষুব্ধ ও সশস্ত্র কার্যক্রমকে সরকার আক্রমণাত্বক অস্থিতিশীল বলে বিবেচনা করা শুরু করে এবং বিভিন্নভাবে তাকে ও তার দলকে আটক ও প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই সরকার এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়।

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে সিরাজ শিকদার আত্মগোপন করেন। পরবর্তীকালে সিলেট থেকে চট্রগ্রাম যাবার পথে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে বিমানযোগে ঢাকায় নিয়ে আসে। পরদিন শেরেবাংলা নগর থেকে সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যরা তাকে হত্যা করে। অপর একটি সুত্র মতে সিরাজ শিকদারকে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় ঢাকাস্থ রমনা রেসকোর্সের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। তারপর ২ জানুয়ারি ১৯৭৫ গভীর রাতে এক নির্জন রাস্তায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। সিরাজের ছোট বোন শামীম শিকদার তার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য শেখ মুজিবকে দায়ী করেছিলেন।

রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে বৈষম্যের কারণে সেনাবাহিনী পুর্ব থেকেই শেখ মুজিবের প্রতি অসন্তষ্ট ছিলো। তবে বিদেশী সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার ‘‘বাংলাদেশ রক্তের ঋণ’’ গ্রন্থে শেখ মুজিবের প্রতি চুড়ান্ত অসন্তোষের পেছনে একি নির্দিষ্ট ঘটনাকে প্রভাবক হিসেবে উল্লেখ করেন, যে ঘটনাটি কর্নেল ফারুক রহমান কর্তৃক বর্ণিত তা হলো: টঙ্গীর মোজাম্মেল হক নামক এক সমসাময়িক আওয়ামী লীগ তরুন নেতা যে সে সময় টঙ্গী আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান ছিলো সে এক নব বিবাহিত গৃহবধুকে গাড়ি থেকে তুলে নিয়ে তার ড্রাইভার ও স্বামীকে হত্যা করার পর তাকে অপহরণপুর্বক গণধর্ষন করে তিন দিন পর তার রক্তাক্ত লাশ রাস্তায় ফেলে যায়। এতে মেজর নাসের নামে ব্যাঙ্গল ল্যান্সারের একটি কোম্পানির অধিনায়ক মোজাম্মেলকে আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করলে অনতিবিলম্বে সে ছাড়া পায়। তখন অনেকেই মনে করেন, শেখ মুজিবের হস্তক্ষেপেই সে অপরাধের শাস্তি হতে মুক্তি পেয়েছিলো। মাসকারেনহাসের বর্ণনামতে এ ঘটনা সেনাবাহিনীতে বিশেষত কর্নেল ফারুকের ভেতরে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বৃদ্ধি করে। শেখ মুজিবকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জীবিত বা মৃত যে কোন অবস্থায় উচ্ছেদ করার পরিকল্পনার পেছনে অন্তিম মুহূর্তের চুড়ান্ত প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমদ অঘোষিতভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে মোশতাক অনেক পুর্ব থেকেই মুজিবের বিরুদ্ধে চক্রান্তে জড়িত ছিলেন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ মুজিব মন্ত্রীসভার মন্ত্রী ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্কার মোশতাক আহমেদ আওয়ামী লীগে প্রতিষ্ঠালগ্নে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন। শেখ মুজিব পরবর্তীতে আওয়মী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হন।

মুজিব নগর সরকার গঠিত হলে মোশতাক পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রী হন। অনেকের মতে যদিও তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং সর্বোপরি মুজিবকে স্বল্পশিক্ষিত বলে মনে করতেন। অনেক বিশ্লেষকের মতে মোশতাক মুজিবের প্রতি ঈর্ষা পোষন করতেন। কারণ শেখ মুজিবের মত জনপ্রিয়তা তার ছিলোনা বলে। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট
Comments (0)
Add Comment