(পুর্র্ব প্রকাশের পর) (৮)
(১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট। ভোর প্রায় ৫টা ৫০ মিনিট। দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই সিঁড়ির মুখে মেজর হুদাকে দেখে বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে ওঠেন, ‘‘ তোরা কি চাস? তোরা কি আমাকে মারতে চাস?’’ মেজর হুদা বলে ‘আামি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’ বঙ্গবন্ধু বলেন ‘‘ তুই আমাকে মারতে চাস? কামাল কোথায়? তোরা কামালকে কি করেছিস? উত্তরে হুদা বলে ‘ স্যার কামাল তার জায়গায়ই আছে আর আপনি তুই তুই করে বলবেননা। আপনি বন্দি, চলুন।’ এবার গর্জে উঠলেন বঙ্গবন্ধু ‘‘ কি তোদের এত সাহস! পাকিস্তানি আর্মিরা আমকে মারতে পারেনি। আমি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি। বাঙালি আমাকে ভালোবাসে কেই আমাকে মারতে পারেনা।’’ )।
অনেক বিশ্লেষকের মতে মোশতাক মুজিবের প্রতি ঈর্ষা পোষন করতেন। কারণ শেখ মুজিবের মত জনপ্রিয়তা তার ছিলোনা বলে। লোকে বলতো, মোশতাকের মাথায় যত গাছি চুল ততটা দুষ্ট বুদ্ধি তার মাথায়। শত ঈর্ষার ছুরি তিনি শেখ মুজিবের ওপর বসিয়েছেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে কলকাতায় বাংলাদেশ মিশন গঠিত হয়। সে সময় মুজিবনগর সরকারের অগোচরে খন্দকার মোশতাক আহমেদ মার্কিন মধ্যস্থতায় পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি আপোষ রফার মাধ্যমে কনফেডারেশন গঠন করার গোপন পরিকল্পনা করেন।
কিন্তু আকস্মিকভাবে মোশতাকের পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলম চাষীর মার্কিন জনৈক কুটনৈতিককে লেখা একটি চিঠি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের কাছে ফাঁস হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে মোশতাককে নজরবন্দি করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরও মোশতাক মুজিব বিরোধি চক্রান্ত অব্যাহত রাখেন। এছাড়া তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মাহবুব আলম চাষী, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রমুখ খন্দকার মোশতাকের সাথে চক্রান্তে জড়িত ছিলেন। ।
কর্নেল ( সেই সময় মেজর) সৈয়দ ফারুক রহমান, খন্দকার আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, বজলুল হুদা, এস এইচ এম বি নুর চৌধুরী এবং রাশেদ চৌধুরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার ছিলেন। বিদেশী গোয়েন্দা ও মোশতাক চক্রের থেকে ইঙ্গিত পেয়ে তারা মুজিবকে হত্যা করে সরকার উৎখাত করার পরিকল্পনা করে।
কর্নেল আব্দুর রশিদ ছিলেন খন্দকার মোশতাকের ভাগ্নে। খন্দকার রশিদই মুলত ঘাতক সামরিক অফিসারগণ ও মোশতাক চক্রের সাথে সমন্বয় রক্ষা করেন। মুজিব হত্যার আরেক মুল পরিকল্পনাকারি ঘাতক কর্নেল ফারুক রহমান এক সাক্ষাতকারে বলেন, রশিদই প্রথম তাকে সরকার উৎখাতের কথা বলেছিলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকান্ড বিষয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থানরত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সংবাদাদাতা সুখরঞ্জন দাস গুপ্ত ১৯৭৮ সালে রচিত ‘‘ মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র’’ বইতে লেখেন, বাকশাল গঠনের পর তিনি (কর্নেল রশিদ) তাজ উদ্দিন আহমদের সঙ্গে তার বাড়িতে দেখা করলে তাজ উদ্দিন তাকে জানান, জিয়াউর রহমান তাজ উদ্দিনের কাছে মুজিবকে গৃহ বন্দি করার পরিকল্পনায় অংশ নেওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন যা তাজ উদ্দিন সরাসরি নাকচ করে দেন এবং তাজ উদ্দিনের মনে হচ্ছিলো জিয়া নিজ থেকে আসেননি, তাকে পাঠানো হয়েছিলো। তাজ উদ্দিন আরো বলেন, মুজিবকে এই ষড়যন্ত্রের কথা জানালে তার মনে হলো মুজিব তার কথা বিশ্বাস করেন নি। তিনি আরো বলেন, জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের পর থেকেই আওয়ামী লীগের চার পাঁচজন সদস্য এই পরিকল্পনা করে। খন্দকার মোশতাক জেদ্দায় গিয়ে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে পরিকল্পনা চুড়ান্ত করেন, এবং মোশতাক তৎকালিন বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদুত ডেভিড ফষ্টারের সঙ্গেও এ ব্যাপারে গোপনে আলোচনা করেন। মার্কিন দুতাবাস ব্যাংক থেকে তাদের কাছে তিন কোটি টাকাও আসে।
তাজ উদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, পরিকল্পনায় বিদেশি সহায়তার অন্যতম কারণ ছিলো আমেরিকা সব সময় পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো, এবং সৌদি আরব, জর্দান ও লিবিয়াসহ ইসলামি দেশগুলো ধর্ম নিরপেক্ষ হিসেবে মেনে নিতে পারছিলনা। তাদের ইচ্ছা ছিলো বাংলাদেশ ইসলামি রাষ্ট্র হোক।
বিভিন্ন তথ্য ও সুত্র মতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যায় জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা অনেকেই বলে থাকেন। অধিকাংশ বিশ্লেষকের মতে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জিয়া পরিপুর্ণভাবে অবগত ছিলেন।
লেখক পরেশ সাহা তার বাইতে বলেন, খুনি চক্রের সাথে কোন না কোন বনিবনা ছিলো। খুনি মেজরগণ প্রবাসে তাদের বিভিন্ন সাক্ষাতকারে জিয়াউর রহমানের সংযুক্তির কথা উল্লেখ করেন। সাকে তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেন, মুজিব নিজেও জিয়ার চক্রান্ত বিষয়ে অবগত ছিলেন। কর্নেল (অব.) শওকত আলি মুজিবকে বলতে শুনেছেন,‘‘ জিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা, তবে এখনো ছেলে মানুষ। দেশের অবস্থাও ভালোনা। তাই আমার উপর অভিমান করে একটু আধটু ষড়যন্ত্র করে।’’
সুখরঞ্জন দাস গুপ্ত তার ‘‘মিড নাইট ম্যসাকার ইন ঢাকা’’ বইয়ে লিখেন যে, মুজিব হত্যাকান্ডের প্রকৃত বর্ণনা সব সময় রহস্যে ঘনীভুত থাকবে। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ড একটি সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে বর্ণিত হলেও এটি সমগ্র সেনাবাহিনীর কোন অভ্যুত্থান ছিলোনা। মধ্যম সারির কয়েকজন অফিসারদের দ্বারা এই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। ততকালিন সেনা প্রধান কে এম শফি উল্লাহর মতে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ঘটনাবলীকে আমি সামরিক অভ্যুত্থান বলে উল্লেখ করতে চাইনা। যদিও এটি সামরিক অভ্যুত্থান বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আসলে সামরিক বাহিনীর একটি ছোট্ট গ্রুপ সেনাবাহিনীর ভেতরে এবং বাইরে যাদের অবস্থান ছিলো তারাই এঘটনা ঘটিয়েছে। এটি সামরিক অভ্যুত্থান নয় এটি একটি সন্ত্রাসী কাজ।
হত্যাকান্ড: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণকারিরা চারটি দলে বিভক্ত হয়। এদের একদল ছিলো মেজর হুদার অধীনে বেঙ্গল ল্যান্সারের ফার্স্ট আর্ম ডিভশন ও ৫৩৫ পদাতিক ডিভিশনের সদস্যরা যারা শেখ মুজিবের বাস ভবন আক্রমণ করে। সুখরঞ্জন দাস গুপ্ত তার বইতে লেখেন যে, মুজিবের বাসভবনের রক্ষায় নিয়োজিত আর্মি প্লাটুন প্রতিরোধের কোন চেষ্টা করেনি। এদিনের ঘটনার বিষয়ে সেনা প্রধান কে এম শফি উল্লাহ বলেন, আমি যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলি তিনি আমার গলার আওয়াজ শুনে বলে ওঠলেন, ‘‘ শফি উল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক (হামলা) করেছে। কামালকে বোধহয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’’ প্রতি উত্তরে আমি বলেছিলাম, আই এম ডুইং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউস? আমি যখন জিয়া ও খালেদ মোর্শারফকে ফোন করি তখন তাদের তাড়াতাড়ি আমার বাসায় আসতে বলি। ১৫ থেকে ২০ মিরিটের মধ্যে তারা আমার বাসায় এসে পড়ে। জিয়া ইউনিফরমড (পেশাগত পোশাক পরিহিত) ও শেভড (দাড়ি কামানো অবস্থায়)। খালেদ মোর্শারফ নাইট ড্রেসে (রাতের পোশাকে) নিজের গাড়িতে আসে।
(চলবে) ।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।