পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট — মর্মান্তিক ও শোকাবহ ঘটনাবলি – এবাদত আলী

(পূর্ব প্রকাশের পর) (৯)
(১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট। ভোর প্রায় ৫টা ৫০ মিনিট। দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই সিঁড়ির মুখে মেজর হুদাকে দেখে বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে ওঠেন, ‘‘ তোরা কি চাস? তোরা কি আমাকে মারতে চাস?’’ মেজর হুদা বলে ‘আামি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’ বঙ্গবন্ধু বলেন ‘‘ তুই আমাকে মারতে চাস? কামাল কোথায়? তোরা কামালকে কি করেছিস? উত্তরে হুদা বলে ‘ স্যার কামাল তার জায়গায়ই আছে আর আপনি তুই তুই করে বলবেননা। আপনি বন্দি, চলুন।’ এবার গর্জে উঠলেন বঙ্গবন্ধু ‘‘ কি তোদের এত সাহস! পাকিস্তানি আর্মিরা আমকে মারতে পারেনি। আমি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি। বাঙালি আমাকে ভালোবাসে কেই আমাকে মারতে পারেনা।’’ )।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পৈশাচিক- মর্মান্তিক ও শোকাবহ ঘটনাবলী সংঘটিত হবার পর পরই ঐ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণাদি দেশের মানুষের নিকট রহস্যাবৃতই থাকে। আস্তে আস্তে সেই ঘটনা বিভিন্নভাবে প্রকাশ হতে থাকে। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধ’ হত্যা মামলায় দেওয়া বিভিন্ন জনের সাক্ষ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আব্দুল হামিদের বই ‘‘ তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’’ এবং অন্যান্য লেখকের লেখা থেকে বিস্তারিত বিবরণ জানা যায়, যা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো: বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত ঘাতকেরা শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্বংশ এবং বাংলাদেশ থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলতে চেয়েছিলো।

এই দুই প্রধান উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে পরিবার স্বজন সবাইকে একই সময় হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ মণি ও আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসাসহ একেক বাসয় নেতৃত্বে ছিলো একেকজন। সিদ্ধান্ত হয় ৩২ নম্বর বাড়িটিকে ঘিরে দুটো বৃত্ত তৈরি করা হবে। ভেতরের বৃত্তের সদস্যরা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করবে।

হত্যাকান্ড সংঘটিত হবার দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগদান করবেন বলে সারা ঢাকা শহরে আগে থেকেই সাজ সাজ রব ওঠে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও বেশ সতর্ক। এরই মধ্যে ঘটনার আগের দিন ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে ঘাতকেরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার মহড়া দিতে থাকে। সক্রিয় হয়ে ওঠে সেনাবাহিনীর টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের কামানবাহী শকট যানগুলো। রাত ১০ টায় বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংকগুলো রাজকীয় ভঙ্গিতে এসে জড়ো হলো বিমান বন্দরের বিস্তিীর্ণ বিরান মাঠে। জড়ো হলো ১৮ টি কামান ও ২৮ টি ট্যাংক। রাত সাড়ে ১২ টায় পরিকল্পনা ব্রিফিং করে মেজর ফারুক। ফলে সবাই জানতে পারলো যে, সে রাতেই হত্যা করা হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর ৪ টার দিকে ঘাতক ফারুক রহমানের সহযোগী এবং অনুগত সৈন্যরা পরিকল্পনা অনুযায়ী সংগঠিত হতে থাকে। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে রাতের আঁধারে এত বড় ধরনের প্রস্তুতি গোয়েন্দারা টের পায়নি কেন সেটি আজো এক বিরাট প্রশ্ন। জড়ো হওয়ার আধা ঘন্টার মধ্যেই ফারুক রহমান তার বাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করে।

বিদেশী সাংবাদিক মাসকারেণহাস এর বর্ণনামতে গন্তব্যের পথে ফারুক ক্যান্টনমেন্টের গোলাবারুদের সাব-ডিপোর সামনে থামে। ধারণা করা হয়েছিলো সেখানে ট্যাংকের গোলা বারুদ এবং মেশিনগানের কিছু বুলেট পাওয়া যাবে। কামানের ব্যরেলের ধাক্কায় ডিপোর দরজা খোলা হয়। কিন্তু সেখানে গোলাবারুদ বা মেশিনগানের বুলেট কিছুই পাওয়া যায়না।

মাসকারেণহাস লিখেছেন, সুতরাং ধোকা দিয়ে কার্য সিদ্ধি করা ছাড়া আর কোন গতি রইলোনা। ফারুকের ট্যাংক বহর যখন এগিয়ে যাচ্ছিলো তখন ৪র্থ এবং ১ম বেঙ্গল পদাতিক বাহিনীর একদল সৈন্যের সাথে তার দেখা হয়। এসময়ে তারা ভোরের পিটি করতে বের হয়েছিলো। কিন্তু ফারুকের ট্যাংক বহর প্রশিক্ষণ এলাকা ছাড়িয়ে শহরের মুল সড়কের দিকে গেলেও কারো মনে কোন প্রশ্ন জাগেনি।

ফারুক রহমানসহ ঘাতকদের অনেকের মনেই তৎকালীন রক্ষীবাহিনী নিয়ে উদ্বেগ ছিলো। তারা ভেবেছিলো মুজিবকে হত্যা করতে গেলে রক্ষীবাহিনীর তরফ থেকে প্রতিরোধ আসতে পারে। সেজন্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংকের বহর নিয়ে বের হয়ে ফারুক রহমান গিয়েছিলো শেরে বাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে। আরেকটি দল শেখ মুজিব, শেখ ফজলুল হক মনি এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে।

তখন রক্ষীবাহিনীর উপ পরিচালক ছিলেন আনোয়ার উল আলম। ২০১৩ সালে তার লেখা ‘রক্ষী বাহিনীর সত্য-মিথ্যা’’ বই প্রকাশিত হয়। সে বইতে তিনি লিখেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের টেলিফোনে তার ঘুম ভাঙে। শেখ মুজিবুর রহমান তাকে বলেন, ‘‘ শহীদ মণির (শেখ মণির) বাসায় কালো পোশাক পরা কারা যেন অ্যাটাক করেছে। দেখতো কি করা যায়।’’ এরপর বিভিন্ন মারফত তিনি জানতে পারেন যে, রাষ্ট্রপতির বাসায় হামলা হয়েছে। তার বাড়ির পাশেও একটি গোলা এসে পড়ে। আনোয়ার উল আলম লিখেছেন, ঢাকা বিমান বন্দরের দেয়াল ভেঙে কয়েকটি ট্যাংক রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়েছে। আমরা বুঝতে পারি সেনা বাহিনীর একটি অংশ বিদ্রোহ করেছে।

আমরা সঙ্গে সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর সবাইকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেই। সরোয়ার (তৎকালীন রক্ষী বাহিনীর উপ পরিচালক) দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের তৈরি থাকতে বলেন। আনোয়ার উল আলমের বর্ণনা অনুযায়ী ঢাকায় প্রতিরোধ গড়ার মত কোন শক্তি রক্ষী রাহিনীর ছিলোনা।

তখন ভোর সোয়া ৫টা। আক্রান্ত হয়েছে ধানমন্ডি। চারদিকে ছুটছে বুলেট। ভোর ৫ টা ১০ মিনিটে রিসালদার মোসলে উদ্দিন দুই ট্রাক সৈন্য নিয়ে উপন্থিত হয় ধানমন্ডির শেখ মণির বাসার গেটে।

প্রতিদিনকার অভ্যাসমত তখন ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন শেখ ফজলুল হক মণি। ড্রইং রুমে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। খোলা দরজা দিয়ে সটান ঢুকে পড়ে মোসলেম। কিছু বলতে চাইছিলেন শেখ মণি। কিন্তু সে সুযোগ না দিয়ে গর্জে উঠলো মোসলেমের হাতের স্টেনগান। লুটিয়ে পড়লেন শেখ মণি। চিৎকার শুনে এগিয়ে এলেন তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। ব্রশ ফারায়ারে প্রাণ হারালেন তিনিও। কেবল প্রাণে বেঁচে যান শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস। রক্ষা পায়নি চার বছরের বাবু ও। ।

(চলবে)
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট ।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট
Comments (0)
Add Comment