বিশিষ্ট সাংবাদিক মীর্জা শামসুল ইসলাম ১৯৪০ সালে পাবনা জেলার বেড়া থানার আমিনপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জস্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম ডা. আবু সাঈদ। তাঁর পরিবার এলাকায় মির্জা পরিবার হিসেবে সুপরিচিত ছিলো। মীর্জা শামসুল ইসলামকে এলাকার লোকজন দুলাল মীর্জা হিসেবেই জানতেন।
তিনি বেড়া থানার ধোপাখোলা করোনেশন হাইস্কুল থেকে ১৯৫৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং পরে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। পাবনা শহরের পৈলানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি পাবনা শহরের প্রাইমারি স্কুল পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।
পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়ণকালে কলেজ ম্যাগাজিনে তাঁর একটি লেখা ছাপা হয়। কলেজের তৎকালিন সহকারি অধ্যাপক আব্দুল হামিদ তাঁর লেখাটির প্রসংশা করেন এবং তাঁর সম্পাদনায় ১৯৫২ সাল হতে পাবনা থেকে বাংলা ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় একযোগে প্রকাশিত সাপ্তাহিক “আমাদের দেশ” পত্রিকায় মির্জা শামসুল ইসলামকে সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব দেন।
১৯৬১ সালের ১ মে পাবনা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠিত হলে প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সাংবাদিক একেএম আজিজুল হক এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বিশিষ্ট কলামিস্ট রণেশ মৈত্রের সান্নিধ্যে এসে তিনি সংবাদ কর্মি হিসেবে নিজেকে জড়িয়ে নেন। তখন একেএম আজিজুল হকের সম্পাদনায় ‘পাক হিতৈষী’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা পাবনা থেকে প্রকাশিত হতো। এ পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমেই সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি সাংবাদিকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৬৩ সালে তৎকালিন ‘দৈনিক পাকিস্তান’ প্রকাশিত হলে ঐ পত্রিকায় তিনি তাঁর লেখনির মাধ্যমে নিজের অবস্থান সৃষ্টি করেন এবং পাবনাস্থ নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।
তৎকালিন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় তাঁর মেধা, যোগ্যতা ও প্রতিভার প্রকাশ ঘটান। সেসময় তাঁর একটি দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রতিবেদন সারা পাকিস্তানে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। পাবনা মাসসিক হাসপাতালের মানসিক রোগি, রোগ এবং আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানসিক ভারসাম্যহীনদের মানবেতর ও দুর্বিসহ জীবনকে সুনিপুণভাবে উপস্থাপন করেন। দীর্ঘ ১৫১ সংখ্যা বিশিষ্ট এ ধারাবাহিক প্রতিবেদনের নাম ছিলো ‘যারা নিজেকে হারিয়ে খোঁজে’।
১৯৬৭ সালের ১৬ মার্চ বিষাক্ত ভুট্টার আটার রুটি খেয়ে পাবনায় একজন রিকসা চালকের মৃত্যু ঘটে এবং দোগাছি ইউনিয়নের বেশ কিছু লোক অসুস্থ হয়ে পাবনা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষ শহরে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। তৎকালিন এমএনএ পাবনা শহরের রূপকথা রোড়ের ক্যাপ্টেন আজগর হোসেন জায়েদীকে এ ঘটনার জন্য দায়ি করে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে ছাত্র-জনতা তার বাড়ি আক্রমণ করে।
এতে তিনি ছাত্র-জনতার উপর গুলি বর্ষণ করলে এক ব্যক্তি নিহত হয়। এ ঘটনায় সারা শহর ফুঁসে ওঠে এবং উপস্থিত জনতা আজগর হোসেন জায়েদীর বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠি চার্জসহ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এ ঘটনায় বেশ কিছু লোক আহত হয়। জনতা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহরের দিকে ফিরে যাবার সময় শহরের আব্দুল হামিদ রোডের দু’টি আগ্নেয়াস্ত্রের দোকানে হামলা চালায় ও দোকান থেকে অস্ত্র লুট করে নেয়। পাবনার জেলা প্রশাসক কে এম হেদায়েতুল হক ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে উত্তেজিত জনতা তার জিপগাড়ি লক্ষ করে গুলি বর্ষণ করে। এতে তিনি অক্ষত থাকলেও তাঁর জিপের ড্রাইভার গুলিবিদ্ধ হন এবং অডার্লি হাবিবুর আহত হন।
এ সংবাদ দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলে সংবাদ পরিবেশনের দায়ে দৈনিক আজাদের পাবনা সংবাদদাতা আনোয়ারুল হক ও সাংবাদিক হাসনাতুজ্জামান হিরাকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠানো হয়। সে সময় মীর্জা শামসুল ইসলাম অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে পাবনার সকল নিউজ পরিবেশনসহ আটককৃত সাংবাদিকদের মুক্তির জন্য জনমত গঠন করেন। জনমতের চাপে বিলম্বে হলেও সাংবাদিকগণ কারাগার হতে নিঃশর্তভাবে মুক্তি লাভ করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে দৈনিক পাকিস্তানের পরিবর্তিত নামকরণ করা হয় দৈনিক বাংলা। দৈনিক বাংলার সম্পাদক স্বনামখ্যাত কবি ও সাংবাদিক হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর সাহসিকতাপুর্ণ কাজের মূল্যায়ন করে তাঁকে পত্রিকার ষ্টাফ রিপোর্টার হিসেবে পদোন্নতি দেন। পাবনার সাংবাদিকতার ইতিহাসে তিনিই প্রথম জাতীয় পত্রিকার ষ্টাফ রিপোর্টার। আমৃত্যু তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের পাবনাস্থ সংবাদদাতা।
পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও তাঁর দক্ষতা ছিলো অনন্য। তিনি ১৯৬৯ পাবনা শহরে জাতীয় মানসম্পন্ন সাপ্তাহিক ‘প্রবাহ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি সর্বপ্রথম পাবনায় আধুনিক প্রযুক্তির কম্পিউটারাইজড পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক নয়া রাজনীতি’ সম্পাদক হিসেবে প্রকাশ করেন। যদিও ঐ পত্রিকায় তাঁর নাম উপদেষ্টা হিসেবে উল্লেখ ছিলো। এ ছাড়াও তিনি পাবনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক নির্ভর পত্রিকার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিথযশা এই সাংবাদিক মীর্জা শামসুল ইসলাম ১৯৯৯ সালের ৩ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি। তাঁর মেজ ছেলে উৎপল মীর্জা পাবনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং বর্তমানে মাছরাঙা টেলিভিশনের উত্তরাঞ্চলীয় ব্যুরো চীফ হিসেবে কর্মরত।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)