শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর এশিয়ার উদীয়মান জায়ান্ট চীনের সঙ্গে তিন দশকেরও বেশি পুরোনো দ্বিপক্ষীয় ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে উদ্ভাবনী উপায় বের করার প্রয়াসে ২০১০ সালে শেখ হাসিনা ও চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাওর মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে ‘সহযোগিতার ঘনিষ্ঠ বিস্তৃত অংশীদারত্ব’ গড়ে তোলার একটি সংকল্প গৃহীত হয়।
চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েব জিয়াবাও শেখ হাসিনাকে সব ক্ষেত্রে সার্বিক সমর্থন ও সহযোগিতার আশ্বাস দেন। বিশ্লেষকদের মতে, বেইজিংয়ের সঙ্গে ‘ব্যাপক অংশীদারত্ব’ অর্জনে শেখ হাসিনার উচ্চাকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই যুগান্তকারী আলোচনায় উভয় দেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। উন্নয়ন প্রকল্প, কৃষি ও বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতায় চীনের আর্থিক সহায়তা ও কারিগরি সহায়তার জন্য শেখ হাসিনার আহ্বানে চীন ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে আরো দুবার প্রধানমন্ত্রী চীনে সরকারি সফর করেছেন।
চীন বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার। বর্তমানে চীন বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। চীনের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেশি। বাংলাদেশে চীন থেকে ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য সামগ্রী আমদানির বিপরীতে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন সহযোগী উল্লেখ করে বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মূল কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত দুই দেশের আরও উন্নয়ন। দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত আমরা দেশকে কীভাবে আরও উন্নত করতে পারি।
চীন বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন খাতে বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও হাইটেক সহযোগিতা জোরদার করতে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে আরও সহযোগিতার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ চীনের উদ্যোক্তাদের জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি বরাদ্দ করেছে এবং তারা সেখানে শিল্প স্থাপন করতে পারে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের সময় বৃহৎ শক্তির মধ্যে রাশিয়া ছিল বাংলাদেশের পক্ষে এবং চীন ও যুক্তরাষ্ট্র ‘পিং-পং কূটনীতি’র নামে ‘বিরোধী’ অবস্থান নিয়েছিল। চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুকে তাদের তৎকালীন মিত্র পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ী করেছিল। ১৯৭৫-পরবর্তী বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ ছাড়াই বেইজিং ধারাবাহিকভাবে ঢাকার বন্ধুতে পরিণত হয়। কিন্তু দূরদর্শী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালে এই সম্পর্কের বরফ গলাতে প্রথমবারের মতো চীন সফর করেন। সে সফরে বেইজিং নেত্রীর প্রতি ব্যতিক্রমীভাবে উষ্ণ ছিল এবং ইঙ্গিত দিয়েছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে তার দৃঢ় সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তারা তাকে সম্মান করছে।
এ সময় এসে এক যুগ পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন। সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে মোট বাণিজ্যের প্রায় ১৪ শতাংশই হয় চীনের সঙ্গে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য হয়েছিল ৬৭৭ কোটি ডলারের। প্রায় এক দশক পর ২০২১-২২ অর্থবছরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য তিন গুণ বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩ কোটি ডলার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চীনের সঙ্গেও বাণিজ্য বাড়ছে। বাংলাদেশের ব্যবসা- বাণিজ্য বিকাশে আপাতত চীনের কোনো বিকল্প নেই বলেও তাদের দাবি।
এক দশক পর ২০২১-২২ অর্থবছরে চীন থেকে ১ হাজার ৯৩৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। একই সময়ে দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্যের অর্থমূল্য ছিল ৬৮ কোটি ডলার। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরেও সে ধারা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিসিআই)।
কর্ণফুলী টানেল পার্শ্ববর্তী চীনা অর্থনৈতিক শিল্পাঞ্চলে আগামী বছর থেকেই বড় ধরনের চীনা বিনিয়োগের আশা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।অঞ্চলটিতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, সৌর ব্যাটারি, সৌর প্যানেল, বৈদ্যুতিক গাড়ি, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানসহ সম্ভাবনাময় কিছু প্রকল্প হবে। চীন শুধু বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়িক অংশীদারই নয়, চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানির গন্তব্য বাংলাদেশ। ভারতের উদ্বেগ সত্ত্বেও বাংলাদেশকে দু’টি অত্যাধুনিক সাবমেরিন দিয়েছে চীন।
বাংলাদেশ সরকার চীনকে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ, পদ্মা সেতু নির্মাণে কারিগরি সহায়তা, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে সহায়তা, কোভিডকালীন সিনোফার্ম ভ্যাকশিন সহায়তাসহ চীন সর্বদা বাংলাদেশের পাশে থেকেছে।
চীনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার ধারাবাহিকতা রক্ষায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের মতো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ তারা পছন্দ করছে না। দক্ষিণ এশিয়ায় ভূ-রাজনীতির সমীকরণ দিনে দিনে জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। বাংলাদেশ-চীনের সম্পর্কের ক্রমেই নিবিড়করণ বিশ্বের অনেক পরাশক্তি ভালোভাবে দেখছে না। তবে শেখ হাসিনা
জানেন কীভাবে দ্বিমত পোষণের মধ্যেও সবচেয়ে ভালো মতটি গ্রহণ করা যায়। বিশ্ব রাজনীতিতে আগামী ৭-৮ বছরের মধ্যে চীন সুপার পাওয়ার হিসেবে অধিষ্ঠিত হতে পারে বলে অনেক আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ মনে করেন। হতে পারে তখন বঙ্গবন্ধু কন্যার সিদ্ধান্তের যথার্থতা বিশ্ব বুঝতে পারবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দুর্বল হওয়া মানে বাংলাদেশে চীনের আসন আরো মজবুত হওয়া। আর প্রতিবেশী বন্ধু দেশ ভারতও কখনোই চাইবে না যে বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাক। ভারতও তাই বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতিতে অনেকটা কৌশলী ভূমিকা নিয়েছে। বাংলাদেশ যেমন মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়াডে যোগ না দিয়ে চীন, রাশিয়ার কাছে সম্পর্ক বজায় রেখেছে, অন্যদিকে পশ্চিমাদের কাছে বাংলাদেশকে মুক্তবিশ্বের একটা গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচয় করে দিয়েছে। তবে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা। এ চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে পারলেই দক্ষিণ এশিয়ায় এমন কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই যে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে পারে।
সম্প্রতি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল শাম্মী আহমেদ, ‘আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলির সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খানের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য খালেদ মাসুদ আহমেদ, তরুণ কান্তি দাস ও সুমন কুন্ডু ঘুরে এসেছেন। সাউথ এশিয়ান একটি কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার জন্য চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে এই প্রতিনিধি দল গিয়েছিলেন বলেও জানান প্রতিনিধি দলের সদস্যবৃন্দ। সফরকালে আওয়ামী লীগের নেতারা চীনের ক্ষমতাসীন পার্টির নেতাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। সেখানে সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয় ছাড়াও রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়। এর আগে গত ২২ মে ফারুক খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল চীন সফরে যায়। এরপর জুলাইয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলও চীন সফর করে। সেখানে নেতৃত্ব দেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকেই দ্রুতগতিতে এগিয়েছে বাংলাদেশ চীন মৈত্রী। ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার ভিন্নতা সত্ত্বেও এই দুই দেশের মধ্যকার চমৎকার কূটনৈতিক সম্পর্ক সত্যিকার অর্থেই একটি রোল মডেল। এ দু’দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক ‘উইন উইন’ সম্পর্কের একটি আদর্শ উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশি রাজনীতির ধারাবাহিকতায় ঢাকায় যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বেইজিং এর সঙ্গে সম্পর্ক সব সময়ই দৃঢ় ও মজবুত থেকেছে।
দু’দেশের বন্ধুত্বের নিদর্শন হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই আশির দশক থেকে একের পর এক নির্মিত বাংলাদেশ- চীন মৈত্রী সেতুগুলো। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দুই দেশ পরস্পরকে সমর্থন করেছে। ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কের পাশাপাশি চীন এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার ও উন্নয়ন সহযোগী। এটি এখন আর অজানা নয় যে, ভারত মহাসাগরের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত ও ভূ-অর্থনৈতিক অবস্থান আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ১৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যার বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে পরিণত করেছে। এমনকি বৈশ্বিক কৌশলগত সহযোগিতার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ থেকেই সার্ক এর শেষ এবং আসিয়ানের শুরু বিধায় বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগ-সেতু হিসেবে বিবেচিত।
সে হিসাবে ১৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যার বাংলাদেশই বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজারে প্রবেশের চাবি। এসব কারণেই চীনের ‘এক অঞ্চল এক পথ’ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ উদ্যোগের অতি গুরুত্বপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। এমনকি পৃথিবীর প্রায় ১৫০টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত গোটা উদ্যোগে থাকা সর্বমোট ছয়টি অর্থনৈতিক করিডোরের একটি, বাংলাদেশ- ভারত-মিয়ানমার-চীন অর্থনৈতিক করিডোরটিও সরাসরি গেছে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে।
বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার সহযোগিতার সম্পর্কটি আসলে প্রতিদিনই পরিণত হচ্ছে, পাচ্ছে বহুমাত্রিকতার ছোঁয়া। আশির দশকে যে সম্পর্কটি কেবলই ছিল কিছু প্রকল্প সহযোগিতাকেন্দ্রিক সেটি এখন ডালপালা মেলেছে আরও অনেক বিভাগে। সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি একটি বড়
সংখ্যক বেসরকারি চীনা বিনিয়োগকারীও এদেশে আছেন। এটা একটা ভালো দিক, কেননা ‘এক অঞ্চল এক পথ’ উদ্যোগের পাঁচটি মৌলিক উদ্দেশ্য রয়েছে সেখানে পঞ্চম ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো ‘পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধিকরণ’।
কেবলমাত্র সরকারি উদ্যোগকে ভিত্তি করে দু’দেশের মানুষে মানুষে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করা কঠিন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসম্ভবও। এক্ষেত্রে উভয় দেশের বেসরকারি খাতকেই সামনে এগিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি চীনা বিনিয়োগকারীরা সেই পথে যাত্রাটি শুরুও করেছেন। বাংলাদেশ সরকারও এক্ষেত্রে সাগ্রহে এগিয়ে এসেছে, সরকার সারাদেশে একশোটি ইপিজেড নির্মাণের পাশাপাশি চট্টগ্রামে একটি চীনা শিল্পাঞ্চলও নির্মাণ করছে। নিঃসন্দেহে এই পদক্ষেপগুলো সার্বিকভাবে দেশের বেকার সমস্যা সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। সম্পর্কের বহুমাত্রিকতার আরেকটি উদাহরণ হলো দু’দেশের মধ্যকার কোভিড-১৯ প্রটোকলের আওতাধীন সহযোগিতা।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাথমিক টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনা হবে। এর অর্থ হলো সাড়ে ১৩ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনা। তাদের সবাইকে দুই ডোজ করে টিকা দিতে ২৭ কোটি ডোজ দরকার ছিল। একটা পর্যায়ে কোভিড-১৯ সংক্রমণ অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়ে টিকা কূটনীতির শিকার হয়ে প্রায় কোণঠাসা অবস্থায় পড়ে আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ঠিক সেই সময়ই বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে আসে চীন। চীনের সিনোফার্মের টিকা এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের কোভিড-১৯ প্রতিরোধ টিকার প্রধান উৎস হয়ে আছে।
বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখানে সহযোগিতার একটি ভালো সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও সার্বিক দারিদ্র্য বিমোচনেও চীনের অভিজ্ঞতাও কিন্তু কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ। করোনা পরবর্তী সময়ে চীন সরকারের নেওয়া অর্থনৈতিক প্যাকেজগুলোর কারণেই বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর ভেতর এখনও সতেজ রয়েছে কেবল চীনের অর্থনীতি। বাংলাদেশ নিজেও এই কাজটি এখন পর্যন্ত বেশ সফলতার সঙ্গেই করতে পেরেছে।
গ্রামাঞ্চল পুনরুজ্জীবিতকরণ কর্মপরিকল্পনার আলোকে সরকার হাতে নেয় ‘টার্গেটেড পোভার্টি এলিভিয়েশন’ প্রজেক্ট। মূলকথা হলো দারিদ্র্য দূরীকরণে নানাবিধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও দেখা গেছে কিছু লোক এর সুফল ভোগ করা থেকে বঞ্চিতই পথকে যাচ্ছে। বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠীর জন্য আসলেই কোথাও তেমন কোনও পরিকল্পনা নেওয়া হয় না, আবার কখনও কখনও ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলা হয় কিছু লোকের নিয়তিই হয়তো দরিদ্র অবস্থায় থাকা।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত জ্বালানি অপ্রতুল, তার ওপর বিগত কয়েক দশকে পশ্চিমা জ্বালানি কোম্পানির খামখেয়ালীপনা, অদক্ষতা ও অপচয়ের দরুন বিপুল পরিমাণ জ্বালানি স্রেফ নষ্ট হয়ে গিয়ে বাংলাদেশ এখন কার্যত বিপদে। উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ অত্যাবশ্যক, আবার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চাই জ্বালানি-যে জ্বালানি আবার যেন তেন হলে চলবে না, হওয়া চাই পরিবেশবান্ধব।
নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক প্রকল্পগুলো একটি ভালো পদক্ষেপ হতে পারে। আমরা আশান্বিত যে বাংলাদেশ চীন উভয়েই এ বিষয়ে সচেতন এবং চীনের সহযোগিতায় বেশ কিছু সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বর্তমানে চলমান। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে চীন তিনটি বিষয় মাথায় রাখে সেগুলো হলো ‘সমন্বিত আলোচনা, সমন্বিত বিনির্মাণ ও শেয়ারিং। তাছাড়া আমাদের দেশের দক্ষ অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই কেবল একটি প্রকল্পকে গ্রিন সিগন্যাল দিলেই কেবল চীনা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করে।
বাংলাদেশ সরকারের পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) নীতির আলোকে অংশীদারিভিত্তিক প্রকল্পগুলোতে যৌথভাবেই প্রকল্প পরিচালনা হচ্ছে বিধায় এখানে সেসব ঝুঁকির বালাই নেই। কাজেই বাংলাদেশের উচিৎ হবে চীনের কাছ থেকে সেই পথ সম্পর্কে যত বেশি সম্ভব জ্ঞান আহরণ করে নেওয়া। আমি মনে করি, বাংলাদেশের উন্নতির পথে বাংলাদেশ ও চীনের ভেতরকার সহযোগিতাকে একটি বা দু’টি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না রেখে আরও সম্প্রসারিত করলে তা উভয় দেশের জন্যই সুবিধা বয়ে আনবে, পাশাপাশি উভয় দেশের বন্ধুত্বকে আরও নিবিড় করে মানুষে মানুষে ‘পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করে’ সফল করে তুলবে ‘এক অঞ্চল এক পথ’ উদ্যোগেটিকে।
চট্টগ্রামে চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ এগিয়ে চলছে। চীনের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলটি হবে তার চেয়ে একেবারে আলাদা। এটি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা নয়, একটি অর্থনৈতিক শিল্পাঞ্চল হবে। সেখানে কিছুসংখ্যক তৈরি পোশাককারখানা হয়তো থাকবে, কিন্তু সেটাই মূল শিল্প হবে না। এই অঞ্চলটিতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, সৌর ব্যাটারি, সৌর প্যানেল, বৈদ্যুতিক গাড়ি, তথ্যপ্রযুক্তির মতো বিষয়গুলোতে প্রাধান্য দেব। এসব খাতে চীন যথেষ্ট ভালো এবং এগুলোর সম্ভাবনাও বেশি।
বিআরআইকে খুব সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ দেখে বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। বিআরআই মানে শুধু সংযুক্তি, অবকাঠামো এবং হার্ডওয়্যার নয়, এটি কিন্তু নীতির সমন্বয়, বাণিজ্য সুবিধা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং জনগণের বিনিময় বোঝায়। সমঝোতা স্মারকের দিকে নজর দিলে চীনের হ্রাসকৃত ঋণে এবং কিছু প্রকল্পের অর্থায়ন অন্য প্রক্রিয়ায়। আবার ওই তালিকার কিছু প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশকে দায়িত্ব নিতে হবে।
এক দশক ধরে দুই দেশের জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিনিময় লক্ষ্য করেছি, ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত চীনের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভাষার কোর্স চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশের ১৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী চীনে পড়াশোনা করছেন। চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি প্রাদেশিক সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিচ্ছে। শেখ হাসিনার জাদুকরী কূটনীতিতে তা সম্ভব হচ্ছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক