হীরেন পণ্ডিত : সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মহান স্থপতি। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, বঙ্গবন্ধু একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, রাষ্ট্রের স্থপতি, স্বাধীনতার প্রতীক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর সম্পদ নন। বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীন দেশ, বঙ্গবন্ধু মানে ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রাম- যার চূড়ান্ত পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু মানে ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয়। বাঙালির চিরায়ত অবয়বে, ব্যক্তিত্বে, উচ্চতায়, উঁচু তর্জনীতে, কণ্ঠে, সাহসে, লক্ষ্য অর্জনের দৃঢ়তায়, আপাদমস্তক
অসাম্প্রদায়িক, বাংলা ও বাঙালির প্রতি চিরবিশ্বস্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির দীর্ঘকাল লালিত স্বপ্নের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সারথি।
বঙ্গবন্ধু তাঁর কর্ম,ত্যাগ, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, সাহসিকতা,সততা ও সাংগঠনিক দক্ষতা, সর্বোপরি বাংলাদেশ ও
বাঙালির প্রতি অতুলনীয় ভালোবাসায় নেতা থেকে বাঙালির পরম আত্মীয়ে পরিণত হয়েছেন। জাতীয় জীবনে আমাদের গৌরবের, আমাদের অহঙ্কারের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার কেন্দ্রীয় নির্যাস বঙ্গবন্ধু । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ একই সূত্রে
গাঁথা। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্বে জেগে উঠা এদেশের সাহসী সূর্য সন্তানদের জন্য। ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা বোনের সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে।
মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় প্রত্যয় যার দিশারী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪৭ সাল থেকেই তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির প্রধান আকর্ষণ। বাঙালি
জাতির মুক্তির ইতিহাস তাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে।
তরুণ শেখ মুজিব ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন বাঙালি জাতির
মুক্তিদাতা। নতুন রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা নিয়ে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৪৯ সালে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমেই রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা হয়। এরপর ১৯৫২ এর মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৫৮ এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৬৬ এর ঐতিহাসিক ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা।
১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র জনতার পক্ষ থেকে
তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালিরা দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের কারণে একাত্তরের মার্চ মাসের শুরুতেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অনিবার্য। তাই তিনি একাত্তরের ৭ মার্চ বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এ ভাষণে বাঙালির প্রতি পাকিস্তানিদের হত্যা-নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র মূর্তহয়ে উঠে। শত্রুর মোকাবিলায় তিনি বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন;তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে
প্রস্তুত থাকো এই সম্মোহনী ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
৭ মার্চের মাত্র ১৯ মিনিটের এই পৃথিবী কাঁপানো বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক জ্বালাময়ী ভাষণ ছিল বাঙালির হাজার বছরের আবেগ, স্বপ্নের বাণী, আকাক্সক্ষার প্রতিফলন, যা ছিল বাঙালিকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। দীপ্তকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন;রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।
এ ঐতিহাসিক ভাষণই মুক্তিপাগল বাঙালি জাতিকে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে এবং এই ভাষণের মধ্য দিয়েই বাঙালির ভবিষ্যৎ ভাগ্য স্পষ্ট নির্ধারিত হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত প্রতীকী স্টাইলে ভাষণটি দিয়েছিলেন। একদিকে মুক্তিকামী মানুষকে দীর্ঘ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন, অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বমাপের
কূটনীতিবিদ। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি সবকিছুকে প্রকাশ করেন একজন কূটনীতিবিদের মতো। তিনি বলেন,বিগত ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস।
তিনি ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর নির্বাচন, ১৯৫৮-এর সামরিক শাসন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচনসহ তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালি বঞ্চনার কথা জানান,
অন্যদিকে যুদ্ধকৌশলও বলে দেন এবং একটি সাজানো গোছানো অলিখিত ভাষণ দেন।
অনেকে বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। কখনও তারা বিচার করেন না, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত স্বাধীন দেশের অভ্যন্তর থেকে বিদেশি হানাদার-শত্রুদের বিতাড়িত করার একটি যুদ্ধ। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের ৯ মাস সময় লেগেছিল ওই শত্রুদের বিতাড়িত করতে। আমরা তা করতে সক্ষম হই ১৬ ডিসেম্বর তাই এ দিবস আমাদের বিজয় দিবস।
২৬ মার্চ বাংলাদেশের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, ওই ঘোষণাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তি, এই ঘোষণাকে ভিত্তি ধরে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ ঘোষণাপত্র বা সংবিধানের মাতৃকোষ ঘোষিত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। এই ঘোষণাপত্রের ওপর
ভিত্তি করেই বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ সংবিধান রচিত হয়।
১৯৭০ এর নির্বাচনের ভেতর দিয়ে আসা বাংলাদেশের ওপর গণহত্যা শুরু ও যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার পরেই বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত নেতা হিসেবে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সেটাকেই স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সব জনপ্রতিনিধি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে বৈধ ঘোষণা হিসেবে মেনে নেন।
আর বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীন দেশের জন্য সরকার গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুকে ওই সরকারের প্রধান অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বৈধ সরকার তখন দেশের ওপর ওই ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সব আইন প্রণয়ন ও রাজস্ব-সংক্রান্ত সব অধিকার পায়। এই পথে দু’টি মাত্র বাধা থাকে। প্রথম হলো দেশের অভ্যন্তরে বেশ কিছু স্থান তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দখলে ছিলো এবং দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের জন্য অন্য রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দরকার।
এই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য দু’টি বিষয় জরুরি ছিল। প্রথমত যারা এই রাষ্ট্র গঠন করেছে তাদের প্রমাণ করতে হবে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী নয় এবং দ্বিতীয়ত রাষ্ট্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে কি না? কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অন্য
একটি গণতান্ত্রিক নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে গেলে প্রথমেই দেখতে হয় যারা নতুন রাষ্ট্র গঠন করেছে বলে দাবি করছেন, তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী কি না? যদি তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রমাণিত না হয় তাহলে স্বীকৃতি পাওয়ার বেশির ভাগ শর্ত তারা পূরণ করেন।
বাংলাদেশের এই পাকিস্তানি হানাদার বিতাড়িত করার যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু যদি পালিয়ে যেতেন বা আন্ডার গ্রাউন্ডে গিয়ে বিপ্লবীদের মতো যুদ্ধ পরিচালনা করার চেষ্টা করতেন, তাহলে পাকিস্তানের সামরিক শাসক তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে প্রমাণ করার যথেষ্ট সুযোগ
পেত। কিন্তু দেশ আক্রান্ত হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু নিজ বাসভবনে
বসেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
তিনি দেশের জনগণকে আক্রমণকারীদের প্রতিহত করার আহ্বান জানান এবং বিশ্ববাসীর কাছে ওই নতুন রাষ্ট্রের জন্য স্বীকৃতি চান।
এই ঘোষণা ও স্বীকৃতি চাওয়ার কাজটি ছিল প্রকাশ্যে এবং নির্বাচিত নেতা হিসেবে।
তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে তখন তারা একটি স্বাধীন দেশের নির্বাচিত সরকার প্রধানকে গ্রেপ্তার করে। তিনি বা তাঁর দল বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে এভাবে গ্রেপ্তার হওয়ার ভেতর দিয়ে, স্বাধীনতা ঘোষণার পরে এই দেশটির আর বাকি যে বিজয় অর্জন করার ছিল তার বেশির ভাগ তিনি একাই করেন। অর্থাৎ তিনি বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করেন,
তিনি ও তাঁর দল বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, তাঁরা মূলত নিজস্ব ভূমি থেকে হানাদার মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছেন।
১৯৭১-এর ৯ মাসে পাকিস্তানের জেলে থেকে তিনি যেমন বেশির ভাগ যুদ্ধে জিতিয়ে দেন বাঙালিকে, তেমনি জেলে বসেও তিনি আগরতলা মামলার মতো নিজেকে রূপান্তরিত করেন; তাঁর আকৃতি আরও বিশাল হয়।
গণতান্ত্রিক বিশ্ব প্রশ্ন করে এই নির্বাচিত নেতাকে গ্রেপ্তার করার অধিকার পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষেও রয়েছে কিনা? মার্কিন প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের পক্ষ নিলেও সিনেটে বার বার বাধাগ্রস্ত হন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থানের জন্য। সবাই বলেন একমাত্র বঙ্গবন্ধুই তাঁর দেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী। পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ নয়। তাই মুক্তিযুদ্ধে যেমন বজ্রকণ্ঠের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেলে, মাইন, গ্রেনেডে সবখানে ছিলেন বঙ্গবন্ধু, তেমনি আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রায় এককভাবে লড়াই করেন গ্রেপ্তার হওয়া নেতা বঙ্গবন্ধু।
যে কোনো মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম যেমন দেশের মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে হয়, তেমনি তার সঙ্গে সহযোদ্ধা হিসেবে পাশে দাঁড়ায় সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ। সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষকে সেদিন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর নায্যতা দিয়েছিলেন
বঙ্গবন্ধু।
কূটনীতিতে সেদিন ইয়াহিয়াকে পরাজিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করে, সশস্ত্র পথে হানাদার তাড়ানোর যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কূটনীতির কাছে হেরে যায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। বিজয়ী হন বঙ্গবন্ধু, রূপান্তরিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে। অনেকেই ভুল করে বলেন, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। ইচ্ছে করলেই একজন নেতা একটি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন না। স্বাধীনতা ঘোষণা করার অধিকার থাকতে হয়। যিনি ঘোষণা করবেন, তাঁর প্রতি দেশের এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন থাকতে হবে। স্বাধীনতার ডাক দিলেই
জনগণ এতে সমর্থন দেবে না। সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী দলের নেতা হিসেবে একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার অধিকার ছিল।
বাংলার অনেক সূর্য সন্তান হয়তো বাঙালি জাতির শৃঙ্খল মোচনের স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করেছেন ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। তাই বলা যায় বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু এক ও অভিন্ন, একে অপরের পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে কল্পনা করা যায় না।
বঙ্গবন্ধু নিজ আদর্শ আর কর্তব্যের প্রতি আস্থাবান ছিলেন। এই বিশ্বাসেই বঙ্গবন্ধু এগিয়ে গেছেন সামনের দিকে। এবং সেই একই বিশ্বাসের জোরে বিজয়ী বীরের মর্যাদায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসতে পেরেছিলেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, তাঁর
স্বপ্নের ভূমি- স্বাধীন বাংলাদেশে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র একটি প্রথাগত যুদ্ধ ছিল না। এটি বাঙালির হাজার বছরের শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন- নির্যাতন-আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে শিকল ভাঙার গান, প্রতিবাদের কাব্যগাথা, সংগ্রামী চেতনার দীপ্ত অগ্নিশিখা।
সংগ্রামী বাঙালি জাতি অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনও মাথা নত করেনি। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার পণ বারবার বঙ্গবন্ধুকে করেছে উদ্দীপ্ত। সারা জীবন তিনি বাংলার সাধারণ মেহনতি কৃষক-শ্রমিক-জেলে-তাঁতি- আপামর জনগণের সার্বিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম
করেছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের-বাঙালির ইতিহাস হয় না। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ একাকার। ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করলে কার্যত বাংলাদেশকে অস্বীকার করা হয়।
বঙ্গবন্ধু নামটি মুক্তিসংগ্রামের স্মারক, শোষিত-বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের শৃঙ্খল ভাঙার হুঙ্কার। বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ না করলে আমরা হয়তো পরাধীনতার শৃঙ্খল কখনই ভাঙতে পারতাম না। বিজয়ের ৫২ বছরে বাংলাদেশের ইতিহাস ক্ষতবিক্ষত হয়েছে বেশ কয়েকবার। যে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সেই দিন একজন মহান ব্যক্তি নয়, একটা দেশকে বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা করা হয়েছিল।
বাঙালি জাতির পরাধীনতার পুনরুত্থান ঘটানোর অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। যে লক্ষ্য, আদর্শ ও উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জন সেটাকে নসাৎ করার এক মহা-ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত ছিল সেই নির্মম ঘটনাটি। সেই কলঙ্কিত ঘটনার পরবর্তী অবস্থার মধ্য দিয়ে নিজেদের মতো করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা, বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে ফেলা, বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে গুরুত্ব না তৎকালীন সরকারের কাজ।
সেই আমলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত না হওয়া, ছবি প্রদর্শিত না হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে না, বিজয়কে সম্মানিত করে না।
হাজার বছরের বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ধারক ও বাহক বঙ্গবন্ধু নিজের বুকের তাজা রক্তে বাংলার মাটি রঞ্জিত করেছেন কিন্তু তাঁর ওপর অর্পিত ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে আপস করেননি। তাইতো তিনি মহাকালের মহামানব বাঙালির স্বাধীনতার রূপকার- আমাদের জাতির পিতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক