হীরেন পণ্ডিত : সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে করে নানামুখী কার্যকলাপ শুরু ও জোট গঠন করা হয়েছিলো। এসবের সঙ্গে সঙ্গে গুজব ছড়ানোও শুরু হয় ব্যাপক হারে, যা এখনো চলছে, হয়তো বা ভবিষ্যতেও চলবে। দেশে গুজব ও অপপ্রচার বেড়েছে, আরও বাড়বে বলেই সকলের ধারণা। রাজনীতি আর গুজবকে অনেকে একাকার করে ফেলেছেন। দলের জনসমর্থন থাকলে গুজব বা মিথ্যাচারের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু জনগণকে আকৃষ্ট না করে গুজবের অস্ত্র ব্যবহার প্রতিদানে ভালো কিছু দেয়না এবং ভবিষ্যতেও হয়তো দেবেনা।
গুজবকে নতুন ধরনের সন্ত্রাসবাদ বললে ভুল হবে না। গুজবের বিরুদ্ধে আইনকে আরও কার্যকর করতে হবে। তবে আইনের অপব্যবহার যাতে না হয় সেদিকেও নজর রাখতে হবে। তবে এগিয়ে যাওয়া, না গুজব, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জনগণও তাঁদের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন গত নির্বাচনে।
আমাদেরকেও সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে হবে কোনও কিছু বিশ্বাস করা বা প্রচারের আগে। গুজব মিথ্যাচারের রাজনীতি দলকে পিছনে ঠেলে দেয়, এসব সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করলে রাষ্ট্র মেরামতের চটকদার ফর্মুলা বেশি দূর গড়াতে পারবে না।
ডিজিটাল বাংলাদেশের যুগে সবার হাতে হাতে মোবাইল। ঘরে ঘরে ইন্টারনেট। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে সহজেই দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ রাখছে মানুষ। চারপাশে, কী ঘটছে, কী শুনছে সেগুলো ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে পেয়ে যাচ্ছে সবাই। বাংলাদেশে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ মানুষের রয়েছে ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট। দেশে বর্তমানে ফেইসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ-ছয় কোটি কোটি। আর ইউটিউবের দর্শকের সংখ্যা ৩ কোটিরও বেশি। এই সুযোগ কেউ ভালো কাজে ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করছেন। আবার কেউ কেউ এর ফায়দাও লুটছে। বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠেছে ‘হ্যাকার চক্র’।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন গুজব আর মিথ্যাচারে ভরপুর। বিশেষ করে সরকার বা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ানো হয় প্রতিদিন। এসব গুজবে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতিসহ রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সেলিব্রেটিদের নাম জড়ানো হয়। কোনো গুজবে সশস্ত্র বাহিনীর মতো সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানের নামও জড়ানো হয়। মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার বিষয়বস্তু বা কনটেন্ট ছেড়ে দেওয়া হয়। আর তা দেখছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। অনেকে তা বিশ্বাসও করছে! কারণ মূল ধারার গণমাধ্যম ছাড়া এসব খবরের কোনো বিশ্বাস যোগ্যতা নেই, তা অনেকের অজানা। তাছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের পক্ষে সেসব তথ্য সত্য-মিথ্যা যাচাই করাও সম্ভব নয়। আর এই সুযোগটি নিচ্ছে একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র।
গোয়েন্দা বিভাগের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ বলছে, যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায় তারাই মূলত এমন কাজগুলো করে থাকে। তাই এসব খবর বিশ্বাস না করতে পরামর্শ দিয়েছে সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। তারা পরামর্শ দিয়ে বলেছে- যেকোনো খবর শুনেই প্রতিক্রিয়া না দেখাতে, আগে যাচাই করতে বলেছেন ঘটনা সত্য কিনা।
এক গবেষণায় উঠে এসেছিলো যে গুজব ছড়ানোকেই একদল মানুষ পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। এর জন্য অবশ্য তারা উভয়মুখী অর্থ পেয়ে থাকে বলে জানানো হয়।
এক ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিরোধী পক্ষ, দুই অনলাইন প্ল্যাটফরম। বৈশ্বিকভাবেই এটা হচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের এক বছরেরও কম সময় সামনে আছে। বৈশ্বিক এবং দেশীয় গুজব ব্যবসায়ীদের জন্য এটা এখন ব্যবসা অর্থ উপার্জনের পথ। তাদের ভাড়া করতে যাওয়া ক্রেতারাও আগ্রহী ও উৎসাহী। কি দেশের জন্য মঙ্গলজনক নাকি প্রতিপক্ষের প্রচ্ছন্ন ব্র্যান্ডিং?
একটি গ্রুপ এটিকে সাময়িক পেশার মতো করে দেশে-দেশে নির্বাচনী কাজ করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৩০টি সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের একটি কনসোর্টিয়াম অনুসন্ধান চালিয়ে এই কাজ সম্পর্কে অবহিত হয়। তিনজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক গ্রাহক সেজে এসবের বিস্তারিত তথ্য উঠে আসে। তাদের মূল কাজ হলো হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিষোদগার, গুজব, অপবাদ ছড়ানো এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে জনমত গড়তে কাজ করে। এখন পর্যন্ত এই গ্রুপ বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩০টির বেশি নির্বাচনে প্রভাব রেখেছে বলে দাবি করা হয়।
এই সমস্ত কার্যক্রমের নেতৃত্ব দেন ছদ্মনাম ব্যবহারকারী কিছু ব্যক্তি। ছদ্মবেশী ব্যক্তিরা সাংবাদিকদের বলেন, বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা, রাজনৈতিক প্রচারণা এবং বেসরকারি কোম্পানি, যারা জনমত নিজেদের পক্ষে নিতে চায়, তাদের হয়ে কাজ করেছেন তাঁরা। আফ্রিকা, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বিভিন্ন গ্রাহককে তাঁরা সেবা দিয়েছেন।
এই টিম অত্যাধুনিক সফটওয়্যার প্যাকেজ অ্যাডভান্সড ইমপ্যাক্ট মিডিয়া সলিউশনস ব্যবহার করে ফেসবুক, টুইটার, লিংকডইন, টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, জি-মেইল, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবে হাজার হাজার ভুয়া অ্যাকাউন্ট রাখে। এমনকি অনলাইনে পণ্য কেনাবেচার বৈশ্বিক প্ল্যাটফরম অ্যামাজনেও তাদের অ্যাকাউন্ট আছে। এভাবেই জি-মেইল, টেলিগ্রামসহ অনলাইন যোগাযোগের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তথ্য হাতিয়ে নেয়। পরিকল্পিতভাবে বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশের ব্যবস্থা করে। পরে সেগুলো অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। কৌশলের মধ্যে প্রতিপক্ষের প্রচারণা ব্যাহত করা বা অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করার বিষয়ও যুক্ত। অনেক রাজনীতিবিদের ব্ল্যাকমেইল করে পারিবারিকভাবে তাঁদেরকে বিপর্যস্ত করার বিস্তর উদাহরণ আছে তাদেও কাছে। অর্থাৎ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করাই লক্ষ্য হয়ে উঠে।
এই বছরের শুরুতেই অনুষ্ঠিত হলো আরেকটি নির্বাচন। যেখানে আওয়ামী লীগ ধারাবহিকতা রক্ষার জন্য জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছে। কারণ ধারাবাহিক সরকারব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য ভীষণভাবে প্রয়োজন ছিলো। সুষ্ঠু একটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। শেখ হাসিনার সেই বিজয়রথের যাত্রাকে আরো বেগবান করার জন্য গুজব ও অপ্রচার রোধে ভূমিকা নিতে হবে। অনলাইনকেন্দ্রিক কিছু কার্যক্রম দেখা যায়, আরো নতুন নতুন বিষয় ও সৃজনশীল বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন-অর্জন নিয়ে কোনো কথা আলাদা প্রয়োজন নেই। শুধু তিনি যা করেছেন সেটা জেনে দেশবাসী ও বিশ্বের মানুষ বিস্মিত। বিশ্ব সংবাদমাধ্যম সকাল-সন্ধ্যা বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক নীতি ঠিক ছিল, শেখ হাসিনার উন্নয়নচিন্তা অসাধারণ এসব নিয়ে মত প্রকাশ করছে।
শেখ হাসিনার সুনাম বিশ^ব্যাপী। তিনি দুর্নীতি, লোভ, মৌলবাদসহ অসংখ্য সমস্যার সঙ্গে লড়াই করছেন। কাজেই তাঁর এসব অর্জনের বিপরীতে গুজব প্রতিরোধে সৃজনশীল উদ্যোগ প্রয়োজন। বিকেন্দ্রীকরণ এই উদ্যোগের সঙ্গে উন্মুক্তভাবে তরুণদের যুক্ত করতে হবে।
গুজবের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণ কী, তা সমাজবিজ্ঞানীরা ভেবে দেখবেন। কিন্তু এর পেছনে একটি পরিষ্কার রাজনীতি আছে। আর এই রাজনীতিটি করছে একদল চিহ্নিত মানুষ, যারা চায় না দেশ এগিয়ে যাক, সমাজে একটি সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা ফিরে আসুক। বিশ্বায়নের এই যুগে মানুষ এগিয়ে চলেছে আর আমাদের দেশের মানুষের পিছিয়ে থাকার কোন সুযোগ নেই। গুজবের ধরণ ভিন্ন হলেও এর বিস্তৃৃতি ছিল আগেই।
সমাজের আনাচা-কানাচে গুজবের চর্চা দেখা যেত। তবে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আসার পর মনে হচ্ছে, এর ভয়াবহতার মাত্রা ছাড়িয়েছে। গুজবের কারণে আগুন দিয়ে ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে হয়েছে বিভিন্ন সময়, ভাঙচুর করা হয়েছে। তাণ্ডব চলে বিভিন্ন জায়গায়। ছেলেধরা বলে প্রচার করে কেমন করে একজন মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে একদল উন্মাদ লোক। ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার নামে বানানো স্ট্যাটাস দিয়ে বিভিন্ন সময় অনেকেই নাজেহাল হয়েছেন। কোটা আন্দোলন বা নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনেও চালানো হয়েছিল এই গুজবের ট্রাম্প কার্ড। সেসব গুজবে অংশ নিয়েছে সমাজের উচ্চশিক্ষিত মানুষজনও। আমরা দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, ফেসবুক সেলেব্রিটি যারা আমাদের কাছে সচেতন ও জাগ্রত মানুষ হিসেবে পরিচিত, তারাও অংশ নেয় এসব গুজবের নাটকে।
সমালোচনা আর মিথ্যাচার কখনো এক নয়। যেকোনো ব্যক্তি বা সরকারের যেকোনো কাজের সমালোচনা করা যায়, কিন্তু সেটা করতে হবে নিজের মত প্রকাশের মাধ্যমে শালীনতার মাধ্যমে। অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের ইচ্ছা মত চলাই স্বাধীনতা ও অন্যেও মত প্রকাশের রাস্তাকে বন্ধ বা আক্রমণ করে নয়। অথচ আমরা এমন মানুষকেও এসব গুজবের প্রচারণায় অংশ নিতে দেখি, যারা নিজেরা হরহামেশা মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করেন লেখালেখি করেন। বক্তব্য দেন বা প্রচার করে থাকেন। কিন্তু আরেক জনের কোনো কাজ যখন তাদের মতের সাথে না মেলে, তখনই দেখা যায় সেই বিষয়কে কেন্দ্র করে মিথ্যা একটি অবস্থানকে সমর্থন করতে।
আধুনিক প্রযুক্তি যেমন নতুনতর গুজব ছড়াতে সহযোগিতা করছে। মুহূর্তেও দ্রæত ছড়িয়ে যায় গুজব। অনেকেই মিথ্যা বানাচ্ছে ও ইচ্ছাকৃত মিথ্যা ছড়াচ্ছে। ইচ্ছাকৃত এসব অসত্য, ভ্রান্ত বিষয়, গল্প এখন লোকমুখে না ছড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়া, এমনকি গণমাধ্যমকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। তার চেয়েও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, একশ্রেণির তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ এসব ব্যবহার করছে, অপরকে বিশ্বাস করাতে ছড়াচ্ছে নানাভাবে। একটা শ্রেণি আবার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেও এসব ভ্রান্ত অসত্য তথ্য, গল্প বা ফেক ভিডিও ছড়াতে ব্যবহার করছে।
এই দেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা এমন কল্পকথা, মিথ্যাচার ছড়ানো হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। নিয়মিত বিরতির পর পর সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে এসব মিথ্যা ছড়ানো হচ্ছে। এতে মূলত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করা হয়। মানুষ যাতে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে আস্থা হারায় তার জন্যই এসব মিথ্যাচার। এসব সংঘবদ্ধ হীন উদ্দেশ্যে মিথ্যাচার ছড়ানোই হলো গুজব। গুজবের নানান ব্যাখ্যা আছে। সমাজবিজ্ঞানীরা উপযুক্ত সংজ্ঞায়নও করেছেন। গুজব উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং অসৎ উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয়, কোনও পক্ষকে ঘায়েল করা বা কাউকে বা কোনও গোষ্ঠীকে হেয় করা বা ক্ষতি করার লক্ষ্যে গুজব ছড়ানো হয়। অসত্য ও ভুল তথ্য বা বিষয় একটা শ্রেণিকে দিয়ে নানাভাবে ছড়ানো হয় এবং বিশ্বাস করানো হয় যে যা ছড়ানো হয়েছে তা ঘটেছে বা ঘটবে; যদিও এর পুরোটাই ভ্রান্ত ও মিথ্যা।
গুজব ছড়ানো হয় মানুষকে ভুল বোঝাতে বা জনমতে ভীতি তৈরি করতে। কিছু অনিশ্চয়তাকে পুঁজি করে গুজবের ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, গুজব হলো প্রচারণা, একটি উপসেট। আমাদের দেশে কয়েকটি বিরোধীদল এই উপসেটকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। রাজনৈতিক গুজবগুলোর উৎস কোথায় বা কী করে এসব তৈরি করে ছড়ানো হচ্ছে তা কমবেশি আমরা সবাই জানি-বুঝি ও অনুমান করতে পারি। নিয়মিত এসব মিথ্যাগল্প ও গুজব নিয়ে পড়ে থাকে বেশ কিছু রাজনৈতিক কর্মী, যেন এসবই তাদের কাজকর্ম।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিনির্ভরশীলতায় লাইক কমেন্ট শেয়ারে বন্দি হয়ে গেছে মানুষের জীবন। যাপিত জীবনের সিংহভাগ সময় জুড়েই থাকছে সবুজ আর নীল আলোর হাতছানি। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, টুইটার, ইমো আর টিকটকের মতো অ্যাপে সীমাহীন আসক্তির পরিধিতে অবধারিতভাবেই ঢুকে যাচ্ছে যেন আট থেকে আশি বয়সের সবাই। ভার্চুয়াল দুনিয়ার দুর্নিবার আকর্ষণে খেই হারাচ্ছে গোটা দুনিয়া। সত্যি বলতে আমরা সবাই যেন আজ এই সোশ্যাল মিডিয়ার ক্রীড়নক হয়ে কাজ করছি।
পুরোনো ভিডিওতে বর্তমান সময়ের কথা ব্যবহার করে নতুন ঘটনার জন্ম দেওয়া এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে একজনের চেহারায় তার আর্টিফিসিয়াল ভয়েস যুক্ত করে ডিপ ফেক প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন একটি ভুয়া ভিডিও তৈরি করে গুজব ছড়ানো হয়। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এড়িয়ে সংবাদের প্রসঙ্গ বদলে ফেলে বানোয়াট তথ্যকে সত্য বলে প্রচারের মাধ্যমেও গুজব ছড়িয়ে থাকে। বিভিন্ন সময় স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞের বক্তব্যের ভুল বা বিকৃত অনুবাদ ও মতামত উপস্থাপনের মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়ে থাকে। মূলধারার গণমাধ্যম থেকে কাল্পনিক উদ্ধৃতি, সত্য খবর পাল্টে ফেলা, অখ্যাত গণমাধ্যম বা বøগের খবর ব্যবহার করে কোনো গবেষণার ফলাফলের ভুল ব্যাখ্যা ও অকার্যকর তুলনার মাধ্যমেও গুজব ছড়ানো হয়ে থাকে।
জনসাধারণকে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য এবং গুজবের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে সাহায্য করতে মিডিয়া লিটারেসি শিক্ষাদানে স্কুল-কলেজ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো এমন প্রোগ্রাম গ্রহণ করতে পারে, যা তাদের সমালোচনামূলক চিন্তার দক্ষতা এবং ফ্যাক্ট চেকিংয়ের কৌশল শেখাবে। দেশপ্রেম, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার আলোকে সোশ্যাল মিডিয়ার দায়িত্বশীল ব্যবহার এই প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে মিথ্যা তথ্যের বিস্তাররোধে সহায়তা করতে পারে।
অন্যদের সাথে শেয়ার করার পূর্বে বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে ও ফ্যাক্ট চেকিংয়ের মাধ্যমে সর্বদা তার বিশ্বাসযোগ্য সূত্র যাচাই করে দায়িত্বশীল শেয়ার করতে হবে। পাশাপাশি তার পেছনে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীর স্বার্থ আছে কি না তা যাচাই করতে হবে। অযাচাইকৃত বা চাঞ্চল্যকর বিষয়বস্তু অনলাইন প্ল্যাটফর্মসহ বিভিন্ন মাধ্যমে শেয়ারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।
সাধারণ বিবেচনায় গুজব ছড়ানো একটি অত্যন্ত অনৈতিক ও গর্হিত কাজ। এটি সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও সহানুভূতির নীতিকে লঙ্ঘন করে। যে সমাজ নৈতিক ও দায়িত্বশীল কমিউনিকেশনকে মূল্য দেয়, সেখানে গুজব ছড়ানো একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের নীতির বিরুদ্ধে যায়। অনেক সময় গুজব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং তা অনিচ্ছাকৃত পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়ে শত্রুতা উসকে দিতে পারে, দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতাকে উসকে দিতে পারে। সর্বোপরি মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর ফলে আইনি পরিণতি বরণ করতে হতে পারে।
এ ধরণের ভিডিওগুলোতে বলা হচ্ছে শিগগিরই নবগঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর বা বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আসছে। কখনও এ ধরণের ভিডিওগুলোতে ভিসা নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়, কখনও বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। ভিডিওগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যদিও স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেকারদের ভূমিকা এখানে দেখা যায় না। একটিও স্বনামধন্য ফ্যাক্ট-চেকার অথবা ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা ইউটিউবের এইসব বিভ্রান্তিকর ভিডিওগুলির বিষয় নিয়ে কোনো কাজ করেনি। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বিদেশি গণমাধ্যম বা সংস্থাগুলোর ভুল বা ফ্যাক্ট চেক করতে সক্ষম হলেও ইউটিউবে হাজার হাজার ভিউ হওয়া বিভ্রান্তিকর এ সব তথ্যের ফেক্ট চেক করার জন্য এগিয়ে আসেনি দেশের কোন ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান।
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে যে অপপ্রচার চালানো হয় তা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমেই রোধ করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান তিনি। তিনি উল্লেখ করেন, ‘বিদেশে বসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর অপতথ্য প্রচার করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সরাসরি কোনো এখতিয়ার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের না থাকলেও মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে বসে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বা অন্তর্ঘাতমূলক কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে তা দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।’
‘গুজব প্রতিরোধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত যেকোনো তথ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে গুজব বলে নিশ্চিত হলে প্রকৃত তথ্যসহ তাৎক্ষণিক তথ্যবিবরণী জারি করে তা সব মিডিয়ায় প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দেশে ও বিদেশে বসে দেশবিরোধী অসত্য তথ্য, বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার ও গুজবরোধে বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিতভাবে টিভিসি, স্পট ও ফিলার প্রচার করে থাকে।’
২০১৪ সালেও গুজব ছড়িয়ে দেশে সহিংসতা করা হয়। যদিও পরে সহিংসতাকারী ও অবরোধকারীরা পিছু হটে। কয়েক হাজার নিরীহ মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়। ব্যাংকে টাকা নেই বলে গুজব ছড়ানো হয়, সেগুলো আবার একটি দলের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করলো। পরে ঠিকই গুজব সৃষ্টিকারীরা আটক হলো।
বাংলাদেশে রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে গত কয়েক বছর ধরে গুজবের মাধ্যমে সরকার বা আওয়ামী লীগকে বিব্রত করার অপচেষ্টা চলেছে এখনো চলছে। রাজনীতিতে পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে, জনগণের কল্যাণে রাজনীতি। নীতিগত মতপার্থক্য রাজনীতির বৈশিষ্ট্য, কিন্তু ভালোকে ভালো বলার মানসিকতা বাদ দিয়ে, রাজনীতির চলমান রীতি বা রেওয়াজ বাদ দিয়ে অশুভ গুজব নির্ভরতা একাধারে হাস্যকর ও দেশের জন্য ক্ষতিকর। কিছু হলে যৌক্তিক সমালোচনা বাদ দিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এমনকি এক্ষেত্রে ধর্মকে বাদ দেওয়া হচ্ছে না, ধর্মের অপব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার এই অপকর্ম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক