চিরচেনা সেই সুমধুর গান দিয়ে প্রতিবছর ঘুরে আসে বাংলা বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর লেখা এই গান, বাংলা বছরের প্রথম দিনটিকে আরও সুন্দর করে তোলে। সকল গ্লানি মুছে দেয় এই পহেলা বৈশাখ। ঢাকায় বছরের প্রথম দিন শুরু হয় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দিয়ে। সারা দেশের আনাচে-কানাচে নিজস্ব নিয়ম বা ঢংয়ে শুরু হয় এই বৈশাখ উদযাপন। ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় প্রত্যক বছর মঙ্গল শোভাযাত্রা। দিনভর সব জায়গায় থাকে উৎসব মুখর পরিবেশ, সাথে থাকে অনেক জায়গায় মেলা এবং ছোট ছোট উৎসব। এই উৎসব যে শুধু ঢাকাতে সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়, গ্রামগঞ্জেও পালা করে চলে নানা রকম মেলা, যাত্রা, গানের আয়োজন। বসে নানা রকম পসরা। হরেক রকম মিষ্টি, বাতাসা, মুড়কি, নিমকি, ইত্যাদি। বসে চরকি, নাগরদোলা, বায়োষ্কোপ আরও অনেক রকম মজার সব খেলা। গ্রামে সেই সাথে যুক্ত হয় বলী খেলা, নৌকা বাইচ। এই ধরনের বৈশাখী মেলা চলে পুরো মাসব্যাপী, সেই সাথে থাকে নানা রকম বৈশাখী আয়োজন।
গ্রাম বাংলার পালা পার্বণ থেকে শহরের পালা পার্বণ অনেকটা ভিন্ন। শহরের বৈশাখী আয়োজনগুলো আবার একটু ভিন্ন আঙ্গিকের হয়। ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের আগের দিন আয়োজন করা হয় চৈত্র সংক্রান্তি, যেখানে সন্ধার পর চারুকলার বটতলায় বসে নানা আয়োজন। চলে নাচ, গান, আবৃত্তিসহ আরও অনেক কিছু। এছাড়াও সংসদে ভবনের সামনে মানিক মিঞা এভিনিউতে রাতভর আঁকা হয় আলপনা। আলপনায় ফুটিয়ে তোলা হয় বৈশাখের পটভূমি। সেই আলপনা আঁকা দেখতে অনেকই ভীড় করেন সেখানে। অনেক সময় আয়োজন করা হয় সারা দেশব্যাপী। পুরো বাংলাদেশের সকল বিভাগ এক সংগে ও একই দিনে আঁকে। যা কিনা বাংলাদেশের জন্য এক গর্ব ও ভালোলাগার দিক।
পহেলা বৈশাখ যেহেতু বাঙলা মাসের প্রথম দিন, তাই এই দিনটিকে কেন্দ্র করে চলে খাওয়া- দাওয়ার এক ধুম। শহর এবং গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে ভাল-মন্দ, কম-বেশী রান্না হয়, যা সবাই একটি পালা-পার্বণ কিংবা একটি উৎসবের দিন হিসেবে পালন করে থাকে। মিষ্টি বাঙালির যে কোনো উৎসবের প্রধান আর্কষণ হয়ে থাকে, আসলে মিষ্টি ছাড়া আমাদের বাঙালির যে কোনো উৎসব বা অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয় না বা জমে না। আর সাথে থাকে মাছ, র্ভতা। পান্তা ইলিশ আরো অনেক কিছুই জায়গা নিয়েছে এই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের তালিকায়। নানা পদের র্ভতা এবং মাছ এই দিনে রান্না করা হয়ে থাকে।
মাছের মধ্যে প্রধান র্আকষণ থাকে ইলিশ মাছ এবং বাজারে এই দিন টিকে কেন্দ্র করে সব রকম মাছের দাম বাড়িয়ে দেয় মাছ ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে ইলিশ মাছের দাম। পহেলা বৈশাখের কয়েক দিন আগেই এই মাছের দাম বাড়তি থাকে। তবে সাধ্য মতন সবাই কেনার চেষ্টা করে থাকে। আর সাথে থাকে দই মিষ্টি।
বিশেষ এই দিনটি কেন্দ্র করে নতুন জামাকাপড় কেনার একটি আগ্রহ সবার মাঝে দেখা যায়। থাকে পোশাকে কিছু প্রধান রং, লাল-সাদা বা শুধু লাল বা শুধু সাদা থাকে প্রথম পছন্দ। আগেও এই প্রথা ছিল বটে তবে আজকাল এটি ফ্যাশন পরিণত হয়ে গেছে। এই দিন বেশির ভাগ ছেলে-মেয়ে, পুরুষ-মহিলা সকলেই যে পোষাক পরে না কেন, তারা লাল বা সাদা রং বেছে নেয়। ছেলেরা বেশির ভাগ পরে পাঞ্জাবী এবং বেশীর ভাগ মেয়েরা পরে শাড়ি। সেদিন সারাদিন দেখতে পাওয়া যায় রঙিন এক বৈচিত্র্যময় পোশাক। সবাই সুন্দও সেজে পরিপাটি হয়ে বের হয় এই দিনটি পালন করতে।
আমাদের এই বাংলাদেশে সব মানুষই প্রথা অনুযায়ী এই দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ও তাদের নতুন বছর যা কিনা ফুল বৈষাবী এই সময় পালন করে থাকে। তিন দিন তারা এই উৎসব পালন করে থাকে। আমাদের পহেলা বৈশাখের মতন এটিও তাদের একটি অন্যতম উৎসব। সকাল বেলা ভোরে নানা রঙের ফুল নদীতে ভাসিয়ে তারা এই দিন টি শুরু করে থাকে। তারপর দিনভর চলতে থাকে নানা আয়োজন। দিনটিতে আমরা সকল বাঙালিরা সব ভেদাভেদ ভুলে একসাথে দিনটি পালন করে থাকি, একসাথে সবাই আনন্দে মেতে উঠি, পুরোনো দিনগুলো ফেলে রেখে, নতুন দিনের পথচলা শুরু করি, তাই কবিগুরু বলেছিলেন “মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।” তাই নতুন বছর, নতুন দিন এবং নতুন একটি বছর সবাই শুরু করি মঙ্গলময়ভাবে।
পহেলা বৈশাখ বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ হিসেবে পালনের রেওয়াজ মোগল স¤্রাট আকবরের সময় থেকে। আরবি বা হিজরি চান্দ্রবর্ষের সৌরবর্ষ সংস্করণ হলো বাংলা সন। তারপর থেকে বছরের শেষ দিন অর্থাৎ ৩০ চৈত্রকে চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ হিসেবে পালন করা হয় সাড়ম্বরে। নববর্ষ পালন মানব সভ্যতারই অনুষঙ্গ। মানব সমাজে বর্ষবরণ উৎসবের শুরু সম্ভবত চার হাজার বছর আগে। মনে করা হয়, ব্যাবিলনে বর্ষবরণের সূত্রপাত ঘটে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা পাড়ের মানুষও হাজার হাজার বছর ধরে বর্ষবরণ পালন করে আসছে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার দিনপঞ্জি হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু হলেও গ্রামীণ সমাজে বাংলা বর্ষপঞ্জির গুরুত্ব এতটুকু কমেনি। কালের বিবর্তনে গ্রামীণ সমাজেও গ্রেগরীয় দিনপঞ্জির ব্যবহার বেড়েছে। তারপরও কৃষক সমাজ আজো বাংলা সনকে সামনে রেখে তাদের ফসলি কার্যক্রম চালায়। দেশের সবচেয়ে বড় উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে বিজড়িত বাংলা সনের সম্পর্ক। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও হালখাতার মাধ্যমে বাংলা নববর্ষকে চিরঞ্জীব করে রেখেছে। বাংলা নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। নববর্ষের বৈশাখী মেলা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
বাঙালির নববর্ষ আসে কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়ার মাতম তুলে। জরাজীর্ণ যা কিছু তাকে উড়িয়ে দিয়ে নববর্ষে নতুনের অভিষেক হয়। নববর্ষে বাঙালি অতীতের দুঃখ-ব না-ব্যর্থতা ভুলে সামনে এগুনোর শপথ নেয়। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ- সবখানেই রয়েছে পহেলা বৈশাখের হার না মানা প্রত্যয়। নববর্ষ বাঙালির সর্বজনীন সংস্কৃতির বাহন বলে বিবেচিত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। হালখাতা, বৈশাখী মেলা এবং শহুরে পান্তা-ইলিশের রমরমা- আধুনিকতার এই যুগেও নিজেদের বাঙালি হিসেবে ভাবার সুযোগ করে দেয়।
শুভ নববর্ষে বিদায়ী বছরের জীর্ণ পুরাতন, বিষাদঘন স্মৃতি ভেসে যাক। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে প্রাণে প্রাণে লাগুক শুভ কল্যাণের দোলা, ‘নবআনন্দ বাজুক প্রাণে’। মঙ্গলকামনায় নববর্ষের প্রথম প্রভাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বজনীন আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠে মানুষ। দেশবাসী সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সুন্দর ও কল্যাণের জয়গানে স্বাগত জানায় নববর্ষকে।
রমনার ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা, পুরান ঢাকায় হালখাতা, শেরেবাংলা নগর, ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবর, বনানী ও গুলশানসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বৈশাখী মেলায় ঢাকা পরিণত হয় উৎসবের নগরীতে। দিনভর অনুষ্ঠিত হয় গান-বাজনা, খেলাধুলা, শোভাযাত্রা, প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নাগরদোলা-লাঠিখেলা কোনো কিছুই বাদ যায় না।
বর্ষবরণের উৎসবে মেতে উঠে বাংলাদেশের মানুষ। পদ্মা মেঘনা যমুনাপাড়ের এ দেশে বর্ষবরণের ঐতিহ্য বেশ পুরনো। বছরের শেষ দিন অর্থাৎ ৩০ চৈত্রকে চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ হিসেবে পালন করা হয় সাড়ম্বরে। বাংলা নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। বৈশাখ মাসকে বলা হয় মেলার মাস। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে যে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয় তা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। বাঙালির নববর্ষ আসে কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়ার মাতম তুলে। জরাজীর্ণ যা কিছু পুরান তাকে উড়িয়ে দিয়ে নববর্ষে নতুনের অভিষেক হয়। নববর্ষে বাঙালি শপথ নেয় অতীতের দুঃখ-ব না-ব্যর্থতা ভুলে সামনে এগুনোর। নববর্ষ বাঙালির সর্বজনীন সংস্কৃতির বাহন বলে বিবেচিত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। হালখাতার অনুষ্ঠান, বৈশাখী মেলা এবং শহুরে পান্তা-ইলিশের রমরমা আধুনিকতার এই যুগেও নিজেদের বাঙালি হিসেবে ভাবার সুযোগ করে দেয়।
হীরেন পণ্ডিত : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট