হীরেন পণ্ডিত : ছাত্রজীবনে অনেক প্রিয় শিক্ষকের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। পরে তাঁদের ছাত্র হিসেবে পাঠ গ্রহণ করেছি এবং তাঁদের নিজ নিজ বিদ্যাপীঠের পাঠ শেষ করে বা দরোজা পার করে এগিয়ে চলেছি এবং ছাত্রজীবন শেষ করেছি। এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেক গুণী শিক্ষকের সাথে পরিচিত হয়েছি।
১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আমরা শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম অত্যন্ত গুণীজনদের। তাঁদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক ড. সৈয়দ মকসুদ আলী, অধ্যাপক ড. এমাজ উদ্দিন আহমদে, অধ্যাপক ড. ডালেম চন্দ্র বর্মণ, ড. মোস্তফা চৌধুরি, অধ্যাপক সরদার ফজুলল করিম, অধ্যাপক নাজমা চৌধুরী, অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক ড. শওকত আরা হোসেন, অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুন, অধ্যাপক আব্দুল ওয়াদুদ ভূইয়া, অধ্যাপক আমিনুর রহমান, অধ্যাপক শরিফুল্লাহ ভূঁইয়া, অধ্যাপক হারুন অর রশীদসহ আরো অনেকে। যাঁরা অত্যন্ত গুণী ব্যক্তি ছিলেন তাঁদের সাথে ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছি এখনও তাঁদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনাগুলো কানে বেজে উঠে এবং চোখে ভেসে উঠে।
অধ্যাপক ড. ডালেম চন্দ্র বর্মণ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রোথিতযশা শিক্ষক, গবেষক এবং শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৬৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৬৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি ভারতের রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
অধ্যাপক ড. ডালেম চন্দ্র বর্মণ আমাদের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এরপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় থেকে পরে আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন পরে ২০২১ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন।
বেশ কিছুদিন যাবত বার্ধক্যজনিত কারণে নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। ৫ জুন ২০২৪ সকাল ১১:১০ ঘটিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইহলোক ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। স্যার এর স্মৃতির প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা।
অধ্যাপক ড. ডালেম চন্দ্র বর্মণ ছিলেন আদিবাসী অধিকার আদায়ের আন্দোলনের একজন সম্মুখ কাতারের যোদ্ধা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের একজন অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক। স্যারকে পেয়েছিলাম মাস্টার্সে তিনি আমাদের আফ্রিকান পলিটিকসের ক্লাস নিতেন। স্যার সবসময় ছাত্রদের আপনি বলে সম্বোধন করতেন। শত বলার পরও উনাকে আপনি থেকে তুমিতে আনতে পারিনি আমরা। শিক্ষার্থীদের সাথে সহজেই মিশতে পারতেন এবং সহযোগিতা করতেন। অসম্ভব বিনয়ী ছিলেন। স্যারের বাড়ি গাজীপুরের কালিয়াকৈর।
আশা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুবার গিয়েছি কথা হয়েছে, একদিন গিয়ে শুনলাম, উনি একজনকে বলছেন সম্ভবত বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সাহেব এসেছিলেন কোন বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য। তিনি অফিস সহকর্মীকে আমার জন্য চায়ের অর্ডার দিয়ে, রেজিস্ট্রার সাহেবের সাথে বলছেন “দেখেন বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু আমাকে গাড়ির সুবিধা দেয়, তাই বেতনের সাথে যে যোগাযোগ ভাতাও দেয়া হচ্ছে, সেটি যেন কেটে রাখা হয়”। এই রকম অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে স্যারের পক্ষে।
স্যার অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ডিজএ্যাবল্ড রিহ্যাবিলিটেশন এন্ড রিসার্চ এসোসিয়েশন (ডিআরআরএ) নামক একটি সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ছিলেন, আমিও সেটির সাথে দীর্ঘদিন জড়িত, সংস্থার নির্বাহী কমিটির মিটিং বা সাধারণ সভায় আসা-যাওয়া বাবদ যে যাতায়াত ভাতা বরাদ্দ থাকতো স্যার কোনদিন তা নেননি, বলতেন এই টাকা প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নে ব্যয় করা হোক। আজকাল ভোগবাদী এ সমাজে আমরা যখন সবাই নীতি, নৈতিকতা ও আদর্শ বিসর্জন দিতে ব্যস্ত তখন স্যার হতে পারেন আমাদের জন্য আদর্শের একজন প্রতীক। আপনার সততা আমাদের সবসময় মুগ্ধ করেছে, স্যার আপনার মতো মানুষের এ সমাজে বড় প্রয়োজন।
দেশের নানা ক্রান্তিলগ্ন দেশি-বিদেশী চক্রান্ত ও স্বাধীনতা, দেশ ও দেশ মাতৃকার যে কোন সমস্যায় স্যার থাকতেন সামনের সারিতে। দেশের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সপক্ষের একজন বুদ্ধিজীবী হিসেতে সবাইকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন।
আদিবাসীদের নিয়ে অনেক গবেষণা রয়েছে স্যারের। দেশ নিয়ে ভাবনা, দেশের অগ্রযাত্রা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদিবাসী মানুষসহ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা সত্যিই বিমোহিত করে আমাদের। জাতির যে কোন ক্লান্তিলগ্নে বীরদর্পে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, সুনামগঞ্জের শাল্লা, কুমিল্লার শহরের ঘটনা, পাবনার সাঁথিয়া, রংপুরের গঙ্গাছড়া, যশোরের ঋষিপাড়াসহ সাম্প্রদায়িক দুঃখজনক ঘটনাগুলোতে তাঁর মন কেঁদে উঠেছে সমানভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে স্যার অনেক জনপ্রিয় ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বও পালন করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে।
আমাদের বিদ্যমান সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে হৃদয় ও বুদ্ধি দিয়ে বুঝে নিয়েছেন প্রতিনিয়ত, আমাদের সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করে করেছেন। জীবনে চলার পথে তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, সততা ও দৃঢ়তাই স্যারের প্রগতিশীল ভাবনার একমাত্র অবলম্বন। জীবনে কোনো কিছু চাওয়ার ছিলোনা ও পাওয়ার ছিলোনা অতি অল্পতেই সন্তুষ্ট ছিলেন।
অসাম্প্রদায়িক, উদার ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন এই গুণী শিক্ষক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবসময় ধারণ করতেন। তিনি ছিলেন একজন সজ্জন, নম্র ও বিনয়ী মানুষ। দেশবিদেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে তার অসংখ্য গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মনে করতেন, গুণগত শিক্ষা মানবিক সমাজ গড়ার পূর্বশর্ত, দারিদ্র্য ও মানবিক দারিদ্র্য দূর করে যে শিক্ষা মানব উন্নয়ন ঘটায়, তা টেকসই জ্ঞানভিত্তিক সমাজের জন্য অপরিহার্য।
গুণগত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ছাত্ররা এদেশের লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হবেন এবং দেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত করতে ভূমিকা রাখবেন এটাই ছিলো তাঁর বিশ্বাস। চরিত্র গঠনের ওপরে গুরত্বারোপ করতেন তিনি। তিনি আরো বলতেন, বাংলাদেশের ভিশন হচ্ছে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ। দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি ও নৈতিক মূল্যবোধের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ও জনগণের ক্ষমতায়নে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। দারিদ্র্যমুক্ত এবং সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়তে শিক্ষার্থীদের নিজেদের নিয়োজিত থাকতে হবে। আমাদের লক্ষ্য এমন একটি সমাজ বিনির্মাণ শিক্ষার্থীরা গুণগত মানের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ গ্রহণের পর তা দেশের উন্নয়নে কাজ লাগাবে।
অধ্যাপক ড. ডালেম চন্দ্র বর্মণ একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে সমাজকে নিয়ে গভীর চিন্তা করতেন এবং বিশ্লেষণ করতেন সামাজিক সহিংস ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ করতেন এবং বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন আমাদের সবাইকে কেন সামাজিক সংকটে বাড়ছে সহিংস কর্মকাণ্ড আমাদের সমাজে। নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে মানুষ। তুচ্ছ কারণে আপনজনকে হত্যা করছে। ভাই ভাইকে, বাবা ছেলেকে মারছে। ছেলে আগুন দিচ্ছে বাবার গায়ে। মা হত্যা করছে মেয়েকে। এ এক সামাজিক সংকট। সামাজিক অস্থিরতা, হতাশা এবং আস্থার সংকট সৃষ্টি হলেই মানুষ হয়ে ওঠে ঘাতক।
এই সহিংস আচরণগুলোকে সার্বিক সামাজিক অস্থিরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে উল্লেখ করেন। স্বজনঘাতী সহিংসতার যে ঘটনাগুলো আমাদের সমাজে ঘটছে এগুলো সে অর্থে ঐক্যবদ্ধ বা কালেকটিভ সহিংসতা নয়। এগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ের দ্বন্দ্ব যা মাঝে মধ্যেই সহিংস রূপ নেয়। এগুলো কোনটা ব্যক্তিগত হলেও কোনোভাবেই এগুলোকে সমাজ থেকে আলাদা করা যায় না। ব্যক্তিরাও সমাজের অংশ। ব্যক্তিগত পর্যায়ে দ্বন্দ্বগুলো নিরসন করতে না পারলে মানুষ সালিশ-বিচারের ব্যবস্থা করে। সালিশতো সমাজই। সুতরাং, এই সহিংস আচরণগুলোর অবসান ঘটাতে হলে সার্বিকভাবে আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। মা-ছেলের মধ্যে যখন দ্বন্দ্ব লাগে তখন দেখতে হবে, আমাদের মায়েরা তাদের ওপর অর্পিত সামাজিক দায়িত্ব পালন করছেন কিনা, আবার সন্তানেরা তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করছেন কিনা তাও দেখতে হবে। বেশি দামের মোবাইল কিনে না দেয়ায় ছেলে বাবার ওপর আক্রমণ করেছে। আমাদের আকাঙ্ক্ষা তৈরির পেছনে বাইরের সমাজের প্রভাব থাকতে পারে।
বিদেশি সংস্কৃতির ভূমিকাকেও অনেকে দায়ী করেন। আমাদের শিশু-কিশোররা বিদেশি অনুষ্ঠান, কার্টুন কিংবা গেমস-এর মাধ্যমেও সহিংসতা শিখতে পারে বলেও মনে করতেন তিনি। সমাজে এই ধরনের ঘটনাগুলো ঘটে মূল ছোটখাটো স্বার্থের বিষয়ে ছাড় দেয়ার মানসিকতা না থাকার কারণে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং পারিবারিক বন্ধন কমে গেলেও এগুলো ঘটে। আগে মানুষ বড় পরিবারে সবাই মিলে এক সঙ্গে বসবাস করতো।
তবুও এইসব সংঘাত কম হতো। এখন মানুষ ছোট ছোট পরিবারে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, সামান্য কারণে প্রিয়জনকেও আক্রমণ করছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সামাজিক মূল্যবোধের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাগুলো পুনর্গঠনের দিকে জোর দিতে হবে।
অপরাধমুক্ত সমাজের জন্য সামাজিক মূলনীতিগুলোকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। সমাজের এই ধরনের সংঘাতগুলো একেবারে নতুন নয়। আগেও ছিল। সাধারণত মানসিক চাপের কারণে মানুষ এরকম প্রতিক্রিয়া দেখায়।
দেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিশেষ করে শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন শিক্ষার প্রসার ও গবেষণায় এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান শিক্ষক আমাদের প্রিয় স্যার স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট