হীরেন পণ্ডিত : শুদ্ধতার কবি একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ অসীম সাহা ১৮ই জুন ২০২৪ মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৪টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)-তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
১৯৪৯ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি মামাবাড়ি নেত্রকোণা জেলা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার কর্মসূত্রে মাদারীপুরেও কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে পড়াশোনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্য বিভাগে। সামগ্রিকভাবে সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।
আমাদের শিল্প, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতায় দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে কথা বলতেন সব সময়। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সংবাদপত্রে সময় দিতে চেয়েছিলেন আরো বেশি করে। নিজের সম্পাদনায় দৈনিক চিরদিন নামে একটি দৈনিক বের করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ফাইন্সারদের সাথে ব্যাটে বলে হয়নি তাই এই স্বাদ অপূর্ণই থেকে গেল।
কাজ নিয়েছিলেন বিভিন্ন দৈনিকে, কিন্তু অসম্মানজনক শর্ত ও বেতন ভাতার কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা আমাদের বলতেন সবসময়, হয়তো আমাদের কোন কিছুই করার ছিলোনা এই নষ্ট সমাজে দাঁড়িয়ে। শেষ দিকে চিকিৎসার খরচ মেটাতেই লড়াই করতে হয়েছে অনেক। সরকারের পক্ষ থেকেও সহায়তা করা হয়েছে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রেও যোগদান করেছিলেন প্রভাবশালী আমলার দাপটে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পেরে রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে ও অভিমানে ছেড়ে আসেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। তবুও সসম্মানে, আত্মসম্মানবোধ রেখে বিদায় নিতে পেরছেন এখনকার দিনে এটাই বা কম কিসে?
কবি অসীম সাহা এদেশের অন্যতম একজন প্রধান ও শুদ্ধতার কবি। বাবা দার্শনিক অখিল বন্ধু সাহার যোগ্য সন্তান। তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। পিতৃপুরুষের ভিটে মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় থানার তেওতা গ্রামে। সৎ, আদর্শ নিষ্ঠা যেন অনেকটা পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছিলেন। তাঁর শৈশবের চার-পাঁচ বছর তিনি যমুনা নদী তীরের এই ছোট্ট গ্রামে এক আনন্দোচ্ছল জীবন কাটান। কিন্তু দার্শনিক পিতা অখিল বন্ধু সাহার কলেজের চাকরি-সূত্রে ১৯৪৮ সালে মাদারীপুর চলে গেলে, তার কয়েক বছর পর সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
১৯৬৫-তে মাধ্যমিক পাশ করার পর মাদারীপুর নাজিমুদ্দিন মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭-তে উচ্চমাধ্যমিক, ১৯৬৯-এ স্নাতক পাশ করে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে মুক্ত করার আন্দোলন। সেই আন্দোলনে প্রতিদিন রাজপথের একজন সৈনিক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত পরীক্ষা হবার কথা থাকলেও অসহযোগ আন্দোলন এবং পরে ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পরে সে-পরীক্ষা আর অনুষ্ঠিত হয়নি। পরে ১৯৭৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কবি অসীম সাহার লেখালেখির জীবন শুরু হয় ১৯৬৪ সালে, যখন তিনি মাদারীপুরে দশম শ্রেণির ছাত্র।
১৯৬৫ সালে ঢাকার পত্রিকায় ছোটদের জন্য লেখালেখি দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে লেখালেখির শুরু। সেই থেকে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছড়া, কিশোর কবিতা, গান প্রভৃতি রচনায় সিদ্ধহস্ত কবি অসীম সাহা অব্যাহতভাবে লিখেছেন। সাহিত্যের সকল বিষয়ে তুখোড় এই লেখক ছিলেন ঋদ্ধতায় বিশ্বাসী বলে সময়কে নিয়ে যেভাবে ভেবেছেন সেভাবেই কাজ করেছেন। স্ত্রী কবি অঞ্জনা সাহা ও দুই পুত্র অভ্র সাহা ও অর্ঘ্য সাহাকে নিয়েই সুখের সংসার ছিলো তাঁর।
কবি অসীম সাহা মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করেছেন পরিণত চেতনায়। ষাটের দশকে বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উত্থান এবং জাতীয় বীরের গৌরব অর্জন ষাটের তারুণ্যকে উদ্বেল করেছে, প্রাণিত করেছে। অংশগ্রহণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন আন্দোলনে। ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ এর বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে একজন সফল সংগঠক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। কবি অসীম সাহা ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো অসভ্যতার বিরুদ্ধে যেমন তিনি সোচ্চার ছিলেন, একইভাবে মানবতার পক্ষে সবসময় বলতেন নিজের অঙ্গীকারের কথাও। নানা অসঙ্গতি অনাচারে রক্তাক্ত একজন সংবেদনশীল কবির সাহসী উচ্চারণ তাই কবিতার পাশাপাশি ইতিহাসেরও অংশ হয়ে যায়। অন্ধকার সময়কে উপস্থাপন করেছেন তিনি বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায়।
তিনি উদ্বাস্তু লিখে দেশহীন মানুষের কথা উচ্চারণ করেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে। ১৯৯২ সালের বাবরী মসজিদ ধ্বংসের পর এদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ও নির্যাতন হয়েছিলো তার প্রতিবাদে এদেশের বিবেকবান মানুষদের নিয়ে শুরু করেন ‘সম্প্রীতি ও মানবাধিকার আন্দোলন’। ২০০১ সালে সাধারণ নির্বাচনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যে বর্বর নির্যাতন হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং লেখনীর মাধ্যমে এদেশের মানুষের মাঝে তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের যে কোন সুস্থ ধারার আন্দোলনে তিনি এগিয়ে যান সবসময়। সাংবাদিকতা ও মুদ্রণ শিল্পের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন পেশার তাগিদে। একসময় আনন্দপত্র ম্যাগাজিন পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন এবং দৈনিক পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। নতুন ধারার পত্রিকা‘আমাদের নতুন সময় এর সংযুক্ত সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এক সময়।
আমার সাথে কবি অসীম সাহার পরিচয় ১৯৮৭ সালে। তখন আমি তখন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের একজন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। একদিন নীলক্ষেতের ইত্যাদিতেই দাদার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। এর পর নীলক্ষেতের সেই ইত্যাদি হয়ে উঠে আমার অলিখিত ঠিকানা এবং নিয়মিত আড্ডা একটি অবধারিত বিষয় ছিলো। কবি অসীম সাহা লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত থাকতেন সবসময়। এর মধ্যে একটি ছিলো বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি (বিজিএস)। জার্মান নাগরিক ও বাংলাদেশের নাগরিকদের সেতুবন্ধনের একটি সংগঠন। প্রফেসর কবীর চৌধুরী ছিলেন সভাপতি, লেখক আহমদ ছফা ছিলেন সাধারণ সম্পাদক এবং কবি অসীম সাহা ছিলেন সাংস্কৃতিক সম্পাদক। এরপর বিজিএস-এর সাথে সম্পৃক্ত হবার কারণে শ্রদ্ধেয় কবি অসীম সাহাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। একজন আদর্শবান মানুষ নিজ আস্থার সাথে এগিয়ে যাওয়াকে কাছে থেকে দেখেছি।
মা, মাটি, মাতৃভূমিকে ভালোবাসা দেখেছি তাঁর কাছে। সততা, নিষ্ঠা ও আদর্শের প্রতি এবং এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার সে প্রচেষ্টায় কোনোদিন আপোস করতে দেখিনি। এই আদর্শ ও ন্যায়নিষ্ঠার কারণে তাঁকে অনেকের বিরাগভাজন হতে হয়েছে, এমনকি অনেকের চক্ষুশূল হয়েছেন। বারবার মৃত্যু ঝুঁকিও তাঁকে তাড়া করছে। কিন্তু কোন কিছুই তাঁকে আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
আজকাল তাঁর মতো আদর্শবান মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। আজকাল আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের আখের গোছানোর যে প্রবণতা আমাদের সমাজে চলছে তিনি ছিলেন তার ব্যতিক্রম। সবসময় তিনি স্বাধীনতা বিরোধী ও মৌলবাদী শক্তির প্রথম টার্গেট ছিলেন। প্রতিটি মুহূর্তে চলেছে কবি অসীম সাহার নামে অপ-প্রচার। আমাদের সমাজে সৎ, আদর্শবান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের সবসময় এমন লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সয়ে যেতে হয়।
কবি অসীম সাহা যে আদর্শ ও আস্থার সংস্কৃতি আমাদের সামনে রেখে গেছেন তা অব্যাহত থাকুক এই কামনা সবসময়। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছড়া, কিশোর কবিতা, গান প্রভৃতি রচনায় সিদ্ধহস্ত কবি অসীম সাহা সবার মাঝে বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মের মাঝে। তাঁর প্রকাশিত তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলোর কয়েকটি হচ্ছে : পূর্ব-পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎস্নায় (১৯৮২), কালো পালকের নিচে (১৯৮৬), পুনরুদ্ধার (১৯৯২), উদ্বাস্তু (১৯৯৪), মধ্যরাতের প্রতিধ্বনি (২০০১), অন্ধকারে মৃত্যুর উৎসব (২০০৬), মুহূর্তের কবিতা (২০০৬), সৌর-রামায়ণ (২০১১), অক্টাভিও পাজ ও ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা (অনুবাদ) (২০১১), কবর খুঁড়ছে ইমাম (২০১১), প্রেমপদাবলি (২০১১), পুরনো দিনের ঘাসফুল (২০১২) (কবিতা)। প্রগতিশীল সাহিত্যের ধারা (১৯৭৬), অগ্নিপুরুষ ডিরোজিও (১৯৯০), উদাসীন দিন (উপন্যাস) (১৯৯২), শ্মশানঘাটের মাটি (গল্প) (১৯৯৫), কিলের চোটে কাঁঠাল পাকে (২০০২), শেয়ালের ডিগবাজি (২০০৭), হেনরি ডিরোজিও (২০১০)। ষাটের দশকের কবিদের অন্যতম প্রধান এ-পর্যন্ত আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৩), ময়মনসিংহ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফোরাম সম্মাননা (২০০৯), সাতক্ষীরা জাতীয় কবিতা পরিষদ কবিসম্মাননা (২০১০), কবিতাবাংলা কবিসম্মাননা (২০১০), বিন্দুবিসর্গ কবিসম্মাননা (২০১১), দিকচিহ্ন কবিসম্মাননা (২০১১), কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর কবিসম্মাননা (২০১১) এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পুরস্কার (২০১২) এবং কবিতালাপ পুরস্কার (২০১২) লাভ করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে কবি অসীম সাহা নিত্য আদর্শ ও আস্থার হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঝাণ্ডা ধরে কবিতার অঙ্গনে হেটেছেন এবং প্রতিদিন থেকেছেন আধুনিক আর সমকালীন এবং আস্থায় অবিচল। বাংলা সাহিত্যকে আরো অনেক কিছু দেবার ছিলো আপনার। আপনি যে আত্মসম্মানবোধ নিয়ে সবসময় চলতেন তা আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। ভালো থাকবেন উপরে আর আমাদের ক্ষমা করে দিবেন যারা কিছুই করতে পারিনি আপনার জন্য।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট