১৯৭৮’র সেই ভয়াল ২৩ শে’মে, নৌদূর্ঘটনায় “মা”কে
হারানোর লোমহর্ষক স্মৃতি আজও আমাকে কাঁদায়।
১৯৭৮ সালের ২৩ শে’মে ভয়াবহ বৈশাখী ঝরে দূপুর ২ টার দিকে পদ্মা-যমুনার মোহনায় বড়ো লঞ্চ এম,ভি,সাহানা ঝরে বিদ্ধস্থ হয় এবং ডুবে যায়!
দিনটি ছিল মঙ্গলবার ২৩ মে ১৯৭৮ । ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে যাবার পথে আষাঢ়ের অথৈজলে টালমাটাল অবস্থায় লঞ্চটি ততকালীন বিশাল যমুনা পদ্মার মাঝামাঝি নিয়ন্ত্রণ হীন! আমি মা সহ ছিলাম লঞ্চের দ্বিতীয় তলা অর্থাৎ ডিলাক্সে।
নিয়ন্ত্রণ হীন লঞ্চ এ মা আমাকে বাঁচানোর আকুতি নিয়ে আল্লাহর কাছে বিভিন্ন দোয়া দরুদ পরছিলেো। যখন লন্চ একেবারেই নিয়ন্ত্রণ হীন অবস্থায় আলোকদিয়ার চরে এসে খাড়া উচ্চ পাড়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে, আবার নদীর মাঝে চলে যেতে থাকে। ইতোমধ্যে লঞ্চ থকে অধিকাংশ যাত্রী ই বুঝে না বুঝে, জীবন বাঁচানোর জন্য পানিতে ঝাপিয়ে পড়ছে!
কোন একজনের কাছ থেকে আমি একটা “লাইফ বয়া” পেলাম। মা ছিলো সাধা ধুতি শারী পরা এবং আমি ছিলাম জাপানি পলেস্টারের হাফ সার্ট এবং প্যান্ট পরা। পায়ে ছিলো বাটার পাম্প সু! চারিদিকে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার আর চিতকার!
কোনো কিছু না বুঝেই আমি মাকে ডান হাত দিয়ে, মা আমাকে বাম হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে লাইফ বয়া টা, দুই মায় বেটা অন্য হাত দিয়ে ধরে ঝরের বিপরীতে ঝাপ দেই! দো তালা লঞ্চ প্রায় ১০/১৫ ফিট পানির উপর থেকে ঢেউয়ের উজানে ঝাপ দেয়ার, সাথে সাথে মা আমার হাত থেকে ছুটে যায়, আর আমি পানির অনেক গভীরে ডুবে যাই!
লাইফ বয়া ও হাত থেকে ছুটে যায়। অর্থাৎ আমি পুরোপুরি লঞ্চ এর তলায় আটকে যাই! আল্লাহর রহমতে কোনো এক সময় জলের স্রোত এবং প্রবল ঢেউ এ আমি লঞ্চ এর তলা থেকে বেরিয়ে ঢেউ এর তালে তালে একবার নীচে একবার পানির উপরে নিয়ন্ত্রণ হীন হাবুডুবু খাচ্ছি!
ঐ মুহুর্তে মা’কে আর পাচ্ছি না বা পাবার মতো আমার নিয়ন্ত্রণ নাই! কোনো একসময় ঢেউ এবং জলের প্রচন্ড স্রোত আমাকে চরের পারে নিয়ে আসে। কিন্তু চরের পার উচ্চ হওয়াতে, আমি যতবারই খারাপাড়ের বালু আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করি, ততবারই পরবর্তী ঢেউ এবং পানির স্রোত ও চর ভাঙ্গনে আমি বালুর চাপের নীচে পরে যাই!
অর্থাৎ আমার নিজস্ব শক্তি দিয়ে কিছু করতে পারছি না? এবং আমি অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পরেছি। চারিদিকে মাঝেমধ্যে অনেকের বাঁচার আকুতি শুনতে পাচ্ছি! এভাবে কোনো এক সময় আমার ক্লান্ত নিথর শরীর বড়ো একটা ঢেউ এসে আলোকদিয়ার চরের সমতল লেভেলে ভাসিয়ে নিয়ে উঠায়?
পরবর্তীতে ঢেউ এর বেগ কমে যাওয়াতে আল্লাহর রহমত আর মায়ের দোয়ায় আমার নিথর শরীর টাকে আর ভাসিয়ে নিতে পারে না, রাক্ষসী পদ্মা-যমুনা?
আমি চেষ্টা করেও উঠতে পারছিলাম না। কিছু সময়ের মধ্যেই চরের লোকজন এসে আমাকে উদ্ধার করে এবং বাপ দাদার পরিচয় পাবার পর সবাই আমাকে গরম দুধ এবং ছ্যাক দিয়ে সাময়িক সুস্থ করে তোলে! তারপর তাদের জানাই মা কোথায়?
লোকজন সহ নদীর পার দিয়ে মা’কে খুঁজছি। অনেক লাশ! এই মাত্র নাক বা কান থেকে সোনার গহনা ছিঁড়ে নিয়েছে, রক্তের দাগ লেগে আছে? এ-ই তো আমাদের মানসিকতা? অধিকাংশ ই নারী এবং ছোট শিশু দের লাশ লক্ষ্য করলাম।
আমার মাকে প্রায় ১ কি: খুঁজেও পেলামনা। সন্ধার দিকে আরিচা থেকে উদ্ধার ফেরী এসে আমাদের নিয়ে নগরবারীঘাট নিয়ে গেল। ওখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আমাকে ঘাটের পাশেই আমার আত্মীয় বাড়ি রঘুনাথপুর সাত্তার ডাক্তারের বাড়িতে লোকজন নিয়ে এলো। আমি দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকলেও মা’কে আজ অব্দি ও পেলাম না?
কোথায় আমার মা’ রাহিমা খানম রমা? আল্লাহ মা’কে যেখানে ই রাখো তোমার এফাজতে রেখ? আমার মা ঐ দিনও সকাল বেলায় নিয়মিত নামাজ এবং কোরান তেলওয়াত করেই ঢাকা থেকে বের হয়েছিলো!
পৃথিবীর সকল “মা” যেনো শান্তিতে থাকেন, আমিন।– ২৩’মে, ২৪ ঢাকা।