হীরেন পণ্ডিত : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এমন একজন মানুষ যিনি আধুনিক সন্ন্যাসী, ধর্ম-কর্ম করেন নিয়মিত, আবার তাঁর জীবন ও রাজনীতির মিলে একাকার। অনেকে নরেন্দ্র মোদিকে পূর্ণতাবাদী মনে করেন। পূর্ণতাবাদী হলো তাঁরা, যাঁরা কিছুটা ভাববাদেও বিশ্বাস করেন আবারো কিছু কিছু ক্ষেত্রে বস্তুবাদকেও মানেন। দর্শনের ভাষায় যাকে বলে পূর্ণতাবাদ। পূর্ণতাবাদ বা কল্যাণবাদ অনুসারে পূর্ণতা লাভ বা আত্মপোলব্ধিই মানব জীবনের পরম কল্যাণ। অর্থাৎ পূর্ণতা লাভ বা আত্মপোলব্ধিই নৈতিক মানদণ্ড। প্লেটো মনে করেন বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার দ্বারা কামনা-বাসনা জাতীয় প্রবৃত্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমেই মানুষের পূর্ণতা বা কল্যাণ আসে। এরিস্টটল মনে করেন, সদগুণ অনুযায়ী মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই মানুষের পূর্ণতা বা কল্যাণ আসে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্রে মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হ্যাটট্রিক করেছেন। গত ৯ জুন সন্ধ্যায় শপথ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন। এ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে হ্যাটট্রিক করেছেন। নতুন এ রেকর্ডের শুরুটা মোদির জন্য মোটেও এতটা সুন্দর ছিল না। একদম সাধারণের কাতার থেকে এ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি, চা বিক্রেতা থেকে বিশে^র সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী। এ জন্য পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ পথ। মোদির এ ইতিহাস যেন কোনো রূপকথার কোনো গল্পকেও হার মানায়। তার উত্থান ও সফলতা বিস্মিত করেছে অনেককেই।
গুজরাটের ভাদনগরে এক দরিদ্র পরিবারে ১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন নরেন্দ্র মোদি। ছোটবেলা বাবার চায়ের দোকানে সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৭০ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির মূল সংগঠন আরএসএস নাম লেখান মোদি। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন তিনি। এরপর ১৯৮৫ সালে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়।
মাত্র তিন বছরের মাথায় গুজরাট বিজেপির সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনীত হন। এরপর ১৯৯৫ সালে কেন্দ্রীয় বিজেপির সম্পাদক মনোনীত হন। এরপর দিল্লি, হরিয়ানা ও হিমাচলের দায়িত্ব পান তিনি। ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেল অসুস্থতার জন্য দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন। এরপর ওই পদে স্থলাভিষিক্ত হন মোদি। এ ঘটনার মাত্র এক বছরের মাথায় গুজরাটে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা হয়। এ ঘটনায় ২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন। গুজরাটের এ দাঙ্গার জন্য অনেকে মোদিকে দায়ী করে থাকেন।
২০০২ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মোদি আবারও রাজ্যের ক্ষমতায় আসেন। এরপর আরও দুদফায় মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার এ সাফল্য ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। এর প্রেক্ষিতেই তিনি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়েছিলেন। একজন চা বিক্রেতা থেকে বিজেপির হয়ে প্রধানমন্ত্রীর আসন অলংকৃত করেন মোদি। সন্ন্যাস জীবনে অভ্যস্ত হলেও জানা যায় তিনি বিবাহিত। বারানসিতে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় যশোদাবেন নামের এক নারীকে স্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
টানা এক দশক ক্ষমতায় থেকে ভারতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, স্বচ্ছ ও আধুনিক ভারত গড়ে তুলতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। ভারতকে বিশ্বের পঞ্চম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার কৃতিত্বও তার ঝুলিতে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে বিশ্ব পরিমণ্ডলেও নিজের ব্যপ্তি ছড়িয়েছেন তিনি। ভারতের ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে মোদিই প্রথম প্রচারক, যিনি মাত্র ১৩ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় দেশটির সবচেয়ে উন্নত গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন। অথচ এর আগে প্রশাসন চালানোর কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না তাঁর।
তবে মোদির সমালোচকদের অভিযোগ, রাজনৈতিক জীবনে তাঁর উত্থানের পথে সহায়তাকারীদের ছুঁড়ে ফেলেছেন তিনি। এই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন বিজেপির অন্যতম তারকা রাজনীতিক লালকৃষ্ণ আদভানি, তবে আদভানির বয়স এখন ৯৬। প্রায় অচেনা মোদিকে তিনিই আজকের অবস্থানে এনেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক নরসিমা রাও বলেন, মোদি দৃঢ়প্রত্যয়ী। তিনি শতভাগ সৎ। আর ভীষণ পরিশ্রমী। পরিণতির কথা ভেবে কোনো কিছুতেই ছাড় দেননি তিনি। সাময়িক জয়ের মোহে কখনোই মোদিকে বাঁধা যায়নি।
স্কুলে মোদি ছিলেন আর দশটা ছাত্রের মতোই। কিন্তু ওই বয়স থেকেই তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু। তাঁর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, টানা চার দশক ধরে নবরাত্রির সময় উপবাস করছেন তিনি। স্কুলে পড়ার সময়ই মোদির অর্চনার বিষয়টি অনেকের নজরে আসে। তিনি প্রায়ই পরিবার থেকে বেরিয়ে দূরে নির্জন স্থানে গিয়ে উপাসনা করতেন। কখনো তাঁকে দেখা যেত হিমালয়ে গিয়ে উপাসনা করতে। ১৯৬৭ সালে চূড়ান্তভাবে পরিবারের সঙ্গ ত্যাগ করেন তিনি।
গুজরাটের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী মোদিকে ২০১৪ সালে প্রথমবারের মত ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হয়েছিলো। তিন দফা গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকার সময় গুজরাটকে পরিণত করেছেন উন্নয়নের মডেলে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদি পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ। সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
২০০৫ সাল থেকে নরেন্দ্র মোদি আমেরিকা ভ্রমণের ভিসা না পেলেও আমেরিকায় তিনি পাবলিক রিলেশন্স ও ইমেইজ ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে ৩ মাসের একটি সংক্ষিপ্ত কোর্স সম্পন্ন করেন। বিজেপির জয়ের জন্য এবারের লোকসভা নির্বাচনে মোদির স্বতঃস্ফূর্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত নির্বাচনী প্রচারণা ভীষণ প্রয়োজন ছিল।
নরেন্দ্র মোদির রসিকতাও সাধারণ নয়। বিরোধী দল মোদির এ গুণটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও এক-বাক্যের রসনাগুলোর মধ্যে তীক্ষè মেধা ও বুদ্ধির ছটা লক্ষ্যণীয়। নরেন্দ্র মোদিকে বেশ রক্ষণশীল বলে মনে হলেও প্রযুক্তিকে দূরে ঠেলেননি তিনি। প্রতিদিনই ইন্টারনেটে নিজের খবরগুলো দেখে নেন। তাঁর ঘড়ির সংগ্রহটাও মন্দ নয়। রাতে ৪ ঘণ্টা ঘুমান মোদি। এ নেতা অফিসে ঢোকেন সকাল ৭টায় এবং রাত ১০টা বা আরও রাত পর্যন্ত সেখানে কাজ করেন।
ভারতীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে শশী থারুরের পর নরেন্দ্র মোদিই নারীদের কাছে বেশি জনপ্রিয়। সেটার বিশেষত্ব তাঁর তাকানোর ভঙ্গির কারণেই মনে করেন অনেকেই। নরেন্দ্র মোদির শখের মধ্যে ছবি তোলা ও কবিতা পড়া। লিখতেও ভালোবাসেন তিনি। সমাবেশে যে বক্তৃতা দেন, তার একটি বড় অংশ তার নিজেরই লেখা। নিজের তোলা ছবির প্রদর্শনীও করেছেন তিনি। নিরামিষভোজী মোদি নিঃসঙ্গ থাকতে ভালোবাসেন ও অন্তর্মুখী স্বভাবের। কোন বেস্ট ফ্রেন্ড নেই তার।
একবার টাইম ম্যাগাজিনের এশিয়া এডিশনের প্রচ্ছদে নরেন্দ্র মোদিকে স্থান দেয়া হয়। টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্বের ১০০ শীর্ষ প্রভাবশালীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি। তিনি একাধারে ডিজিটাল পেমেন্ট, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির পাশাপাশি কোনো এক হিন্দু দেবতার পুনর্জাগরণের আচারে অংশ নেওয়ার কথাও গর্ব করে বলেন। সেলিব্রেটিদের মতো নরেন্দ্র মোদি তাঁর নিজের ব্র্যান্ডিং করেন টি-শার্ট পরে, ক্যাপ পরে। সাধারণ ভারতীয়দের নজর কাড়তে সৈকত থেকে ময়লা কুড়ান কিংবা রাস্তাও ঝাড়ু দেন। শক্তিধর নেতাদের মধ্যে মোদি ব্যতিক্রম। জো বাইডেন এব ভ্লাদিমির পুতিন; দুজনেরই প্রশংসা পেয়েছেন তিনি। দু’জনের সঙ্গেই আছে উষ্ণ সম্পর্ক।
মোদির প্রচারণার স্লোগানে অবশ্য যতই অন্তর্ভুক্তিমূলক অগ্রগতির আহ্বান থাকুক না কেন, অনেক ধর্মীয় সংখ্যালঘু দল মনে করে তারা ভারতীয় জনতা পার্টির কাছ থেকে অবহেলাই কুড়াচ্ছে। মোদির সঙ্গে ভারতের গণমাধ্যমের যে বিতর্কিত সম্পর্ক দেখা যায়, সেটার আংশিক কারণও এই দ্ব›দ্ব। দরিদ্র পরিবাওে বেড়ে উঠা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সংগঠক হিসেবে বছরের পর বছর দেশের বিভিন্ন এলাকা সফর করেছেন। ভারতের ৮০৬টি প্রশাসনিক জেলার প্রায় ৮০ ভাগ জেলার প্রতিটিতে অন্তত এক রাত করে কাটিয়েছেন মোদি।
ভারতীয় অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী হন অনেকেই। এশিয়ার অর্থনৈতিক বিস্ময়গুলো তখনই ঘটেছিল যখন কর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যা একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছেছিল। জাপান এই পর্যায়ে আসে ১৯৬৪ সালে, চীন আসে ১৯৯৪ সালে। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি ভারতের জন্য ওই অবস্থাটি ২০৩০ সালের আগে আসবে না। এরপর এটি স্থায়ী হবে কমপক্ষে ২৫ বছর এমন আশাই করছেন অনেকে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন বাংলাদেশের চোহারা পাল্টে দিয়েছেন গত ১৫ বছরে তেমনি গত এক দশকে মোদি ভারতের অবকাঠামো, রাস্তা, সেতু, বন্দর, বিমানবন্দর এবং ডিজিটাল নেটওয়ার্কগুলোয় বিস্ময়কর পরিবর্তন এনেছেন। অনেক দিক দিয়েই বিশ্বসেরার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে মোদির ভারত। শিগগিরই চীন ও ব্রিটেনের পরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মেট্রো নেটওয়ার্ক হবে ভারতে। এখানকার ৩০ কোটি মানুষ এখন তাৎক্ষণিক অর্থ লেনদেন সিস্টেমের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছে।
মোদির আমলে ভারতের উৎপাদনক্ষমতাও বেড়েছে। বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস বলেছে, পরবর্তী অর্ধশতাব্দীতে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অবকাঠামো বিনিয়োগের হাত ধরে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। ২০৭৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি দ্বিগুণ, চীনের তিন গুণ হলেও ভারতের ১৫ গুণ বাড়বে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। চীনের চেয়ে ভিন্ন পথে চলার জন্য সারা বিশ্বের এখন ভারতকেই দরকার। বলতে গেলে এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ ভারতের ওপর নির্ভর করছে বলেই অনেকে মনে করেন।
মোদি এখন ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসনে দেখতে চান। ভারত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে থেকে কোয়াডেও যোগ দিয়েছে। যেখানে সঙ্গী হিসেবে আছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। আর এ জোটের পরোক্ষ উদ্দেশ্যটি হলো ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবেলা করা। মোদি সরকারের আরেক ফ্রন্টলাইন আছে অর্থনীতিতে। ভারতের সরকারি তথ্য দেখায় দেশটির বেকারত্ব মাত্র ৪ শতাংশের নিচে। নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও মোদি টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শপথ নিয়েছেন এবং নেতৃত্ব দিতে চলেছেন। ১৯৬২ সাল থেকে কোনো ভারতীয় নেতাই এমনটা করে দেখাতে পারেননি।
ভারতে একটি স্থিতিশীল সরকার থাকলে তা তার প্রতিবেশীদের জন্যও নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। আছে আর্থসামাজিক আর নিরাপত্তার বহুমাত্রিক কারণও। বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল সরকার থাকলে লাভ বেশি ভারতের কারণ তার জাতীয় নিরাপত্তা। জাতীয় নিরাপত্তার চেয়ে মূল্যবান যে কিছু হতে পারে না তা ভারতের চেয়ে এ অঞ্চলে অন্য কোনো দেশ বেশি বুঝতে পারবে না। বাংলাদেশ শুধু ভারতের প্রতিবেশীই নয়, তার কৌশলগত মিত্রও।
ভারত তার সব প্রতিবেশীকেই কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা অব্যাহত রাখছে। চীনের মতো বিশাল অঙ্কের না হলেও আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে প্রতিবেশীদের নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টাও অব্যাহত রাখছে নতুন কওে সেই পথেই যাবে নতুন সরকার তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকে বলেন ২০১৪ সালে তো মোদি দেশের জনগণের ভোটে জিতে এসেছেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখিয়ে নয়। এটা তাঁর ক্যারিশমা। মোদির একটা ব্যক্তিত্ব রয়েছে, সেই সাহায্যেই বিপুল জয় পেয়েছেন।
২০১৪-এ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই, তার সরকার ভারতের পরিবহন পরিকাঠামোর উন্নতি এবং দেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের নিয়ম উদারীকরণের প্রচারাভিযানসহ বেশ কয়েকটি সংস্কার শুরু করেন। মোদি তার মেয়াদের প্রথম দিকে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছিলেন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তিনি চীনা প্রেসিডেন্টের সফরের আয়োজন করেন। আট বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো কোনও চীনা নেতা ভারতে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে, মোদি হিন্দু সংস্কৃতির প্রচার এবং অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়নের তদারকি করেছিলেন।
অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি ব্যাপক ছিল, কাঠামোগত পরিবর্তনগুলি প্রবর্তন করেছিল-এবং অস্থায়ী বাধাগুলি-যা দেশব্যাপী অনুভূত হতে পারে। সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিশের মাধ্যমে ৫০০- এবং ১,০০০ টাকার নোটের বিমুদ্রীকরণ এবং প্রতিস্থাপন। উদ্দেশ্য ছিল কালো টাকা বন্ধ করার অবৈধ কর্মকাÐের জন্য ব্যবহৃত নগদ বড় অঙ্কের নগদ বিনিময় করা কঠিন করে তোলা।
পরের বছর সরকার পণ্য ও পরিষেবা কর প্রবর্তনের মাধ্যমে ভোগ কর ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীভূত করে, নরেন্দ্র মোদি আরও শক্তিশালী ও একচ্ছত্র হয়ে ফিরেছেন এমনটাই আলোচনা আছে বাজারে। বিজেপি বা এনডিএ নয়; জিতেছেন আসলে মোদি। দেশের একচ্ছত্র নেতা হওয়ার আগে দলেও সেটি নিশ্চিত করেছেন। জনগণের ধারণা ১০০ বছর পর ভারতের স্বাধীনতার প্রথম ৭৫ বছরে তিনজন প্রধানমন্ত্রীর নাম মানুষ মনে রাখবেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী ও নরেন্দ্র মোদি।
মোদি সরকার কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো হলো, দ্রুতগতিতে নতুন বিমানবন্দর, বন্দর মহাসড়কসহ অত্যধিক প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ। সুবিন্যস্ত পদ্ধতি, দ্রুত অনুমোদন এবং বেসরকারি ঠিকাদারদের ওপর ব্যাপক নির্ভরতার মাধ্যমে এসব অবকাঠামো নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণের তেজিভাব ভারতের অনেক অংশের চেহারা বদলে দিয়েছে এবং নতুন বৃহৎ বিনিয়োগের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রেলওয়ে নেটওয়ার্ক হিসেবে অনেক আগেই প্রতিষ্ঠা পাওয়া ভারতীয় রেলওয়ের আধুনিকীকরণের কাজ এগিয়ে চলেছে। সরকার কোটি কোটি ভারতীয় দরিদ্র মানুষের জন্য তৈরি করা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীকেও শক্তিশালী করেছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদি আশাবাদী ভারতকে বিশ্বের নেতৃত্বে দিকে ধাবিত করবেন। প্রতিদিন দেশে হওয়া উন্নয়ন কাজ তাঁকে এই শক্তি জোগাচ্ছে। তবে মোদির দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে রাহুল গান্ধীকে পর্যন্ত গ্রেফতার বরণ করতে হয়েছে এবং বাক্ ও সংবাদপত্ররে স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে বলে মনে করছেন সচেতন মানুষজন। গ্রেফতার হয়েছেন দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তার দল আম আদমি পার্টির অনেক নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। আরো অনেক নেতিবাচক সমালোচনা রয়েছে।
চন্দ্র অভিযানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়ার সাফল্যের পর চতুর্থ দেশ হিসেবে তালিকায় নাম লিখিয়েছে ভারত। চাঁদের মাটি স্পর্শ করা ঐতিহাসিক মুহূর্তটি উদযাপন করতে উৎসুক ভারতীয় জনতা সমবেত হয়েছিলো। ইসরোর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে পুরো ঘটনা সরাসরি সম্প্রচারও করা হয়। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে যারাই সরকার গঠন করুক তারা বাংলাদশেরে সাথে সম্পর্কোন্নয়নে আরও মনোযোগ বাড়াবে এটাই প্রত্যাশা। গণতান্ত্রিক ভারত ঔজ্জ্বল্য ধরে রাখতে পারবে।
ভারতকে ইদানীং যুক্তরাষ্ট্র কোন চোখে দেখছে, সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারত ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব রুখতে ভারতই তাদের কাছে বড় বাজি। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-জাপান-ভিয়েতনাম অক্ষ চীনের কাছেও চিন্তার বিষয়। দক্ষিণ চীন সাগরের বিরোধপূর্ণ এলাকায় ভিয়েতনামের সঙ্গে যৌথভাবে ভারতের তেল-সন্ধানকে চীন মোটেই ভালোভাবে না নিলেও বিশেষ কিছু করতে পারছে না। এর একটা কারণ, ভারত ১২০ কোটি মানুষের বাজার, অন্য কারণ ভারতের সফল কূটনীতি।
এক জনসভায় দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমি গরিব মানুষ, কিছু হলেই কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। সে সময় তিনি তার বিরুদ্ধে আনা বিভিন্ন অভিযোগও অস্বীকার করেছিলেন। এবার নিজেকে ফকির হিসেবে উল্লেখ করা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে থাকা সম্পত্তির হিসাব দিয়েছে কেন্দ্র। আর সেই হিসাব বলছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মোট সম্পত্তির পরিমাণ ২ কোটি ২৩ লাখ রুপির বেশি।
মোদির নামে ১৪ হাজার ১২৫ বর্গফুটের যে বাসযোগ্য জমি ছিল, তা তিনি অন্য তিনজনের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় কিনেছিলেন। এই জমিতে তিন জনেরই সমান ভাগ ছিল। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০২-এর অক্টোবরে এই জমি কিনেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সর্বশেষ নথিতে উল্লেখ করা রয়েছে, গান্ধী নগরের এই জমিতে প্রত্যেকের ২৫ শতাংশ করে ভাগ ছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী এই জমি দান করে দেওয়ায় এই জমিতে তার আর কোনও অধিকার নেই। এমনকি, নিজস্ব কোনও গাড়িও নেই মোদির। তার ব্যাঙ্কে জমা টাকার পরিমাণও ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৮০ থেকে কমে ৪৬ হাজার ৫৫৫ রুপি হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদির একমাত্র লক্ষ্য ভারতকে একটি উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। ভবিষ্যতে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী জাতি হয়ে উঠবে এটাই তাঁর প্রত্যাশা। একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও জাপানকেও চমকে দেবে। নরেন্দ্র মোদির তাঁর উদ্দেশ্য, কৌশল নিয়ে সবসময় ভাবেন। তিনি একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। জাতির স্বার্থে বিশ্বের সমস্ত দেশকে ব্যবহার করেন তিনি। ভারতীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য তিনি ইরানসহ অনেক দেশকে কাছে নিয়েছেন।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট