হীরেন পণ্ডিত : পশ্চাৎপদ ও ভ্রান্ত দ্বিজাতিত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পাকিস্তানের অধিনে থাকা পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে আহ্বায়ক কমিটির সদস্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হল মিলনায়তনে এক সভায় ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ সংগঠনটি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে পুনর্গঠিত হয়। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে রাজনীতির একটি মেরুকরণ সংগঠিত হতে থাকে।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরনো ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের অসাম্প্রদায়িক একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে নতুন দল গঠন করে। প্রতিষ্ঠার সময়ই দলের অসাম্প্রদায়িক নামকরণের দাবি উঠলেও সমাজ বাস্তবতা ও তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলটি প্রতিষ্ঠার প্রায় চার বছর পর ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ নামে বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রামের ব্রত নিয়ে এ রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ।
প্রথম সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে। প্রথম কমিটিতে তিনি কারাগারে থেকেই যুগ্ম সম্পাদক পদ পান। নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার একপর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন।
১৯৬৬ সালের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন। হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা শেখ মুজিব।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলে রূপান্তরিত হয়।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানের শাসন-নির্যাতন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের সব আন্দোলন একপর্যায়ে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জিত হয়। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পথ ধরে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে দলটি অগ্রসর হয়। ১৯৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, এরপর ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামি করে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়। ১৯৬৮ সালের শেষদিকে এই মামলার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও ছাত্র ঐক্য গড়ে ওঠে। ফলে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয় সেকারণে সরকার বাধ্য হয় মামলা প্রত্যাহার করে রাজবন্দিদের মুক্তি প্রদান করতে। এর মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে শেখ মুজিব এবং পূর্ব বাংলা তখন পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের নিয়ামক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ করে। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ষড়যন্ত্র থেকেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনে সফলভাবে নেতৃত্ব প্রদান করছিলেন। কিন্তু দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী ১৫ আগস্টের হত্যাকাÐ, ক্ষমতা দখল, জেলের অভ্যন্তরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা এবং পুরোপুরি সামরিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশকে পাকিস্তনি ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনাকে দলের সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তিনি ৬ বছর পর দেশে ফিরে আসেন এবং আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সময় সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান অভ্যুত্থানে নিহত হলে দেশের রাজনীতিতে ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি হয়। এরপর সামরিক বাহিনীর প্রধান এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং দেশে পুনরায় সামরিক শাসন জারি হয়।
গৌরব, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সাফল্যের একেকটি সিঁড়ি বেয়ে ৭৫ বছরে পদার্পণ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২৩ জুন। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই ও সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে আজকের এই অবস্থানে উপনীত হয়েছে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ ৭৫ বছরে দলটি অনেক ঐতিহ্য-গৌরব স্থাপনে সক্ষম হয়েছে।
এই সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় আওয়ামী লীগকে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। অনেক চরাই-উৎরাই এবং ভাঙা-গড়ার মধ্যদিয়ে এগোতে হয়েছে। কখনও নেতৃত্ব শূন্যতা, কখনও দমন-পীড়ন, কখনও ভাঙনের মুখে পড়তে হয়েছে দলটিকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের সিংহভাগ সদস্যকে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর নেতৃত্ব শূন্যতায় পড়ে আওয়ামী লীগ। এই শূন্যতা থেকেই দলের মধ্যে একাধিক ভাঙন, গ্রুপিং ও বহু ধারায় বিভক্তি দেখা দেয়। এরপর দলের চরম ক্রান্তিকালে ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে শক্ত হাতে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিধা-বিভক্ত আওয়ামী লীগ আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। প্রায় চার দশক ধরে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পরিচালিত হচ্ছে। এই সময়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি পাঁচবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। তবে ৭৫ বছরের মধ্যে প্রায় ৫০ বছরই আওয়ামী লীগকে থাকতে হয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে, রাজপথ, আন্দোলন-সংগ্রামে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছর এবং ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পাঁচ বছর এবং বর্তমানে টানা সাড়ে ১৬ বছর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে। দলের নেতারা সারা দেশের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেও দলের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কতটুকু ভ‚মিকা রাখেন সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কর্মীরা এলে সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া তাদের কিছু করার নেই এমন অভিযোগ রয়েছে ত্যাগী নেতা-কর্মীদের।
অনেকে যেমন আজন্ম আওয়ামী লীগ করেও দলীয় ক্ষমতার স্বাদ পাননি, তেমনি অনেকে হঠাৎ এসে উড়ে এসে জুড়ে বসে ষোলো-আনাই ভোগ করে ক্ষমতার স্বাদ নিচ্ছেন। অনেকের সাংগঠনিক দক্ষতা-অভিজ্ঞতা থাকলেও দলে নেই, ক্ষমতায় আছেন। সমন্বয়হীনভাবে দল ও সরকার আলাদা করার এ পরীক্ষা-নিরীক্ষা আওয়ামী লীগকে গণমুখী কর্মীবান্ধব সুসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তির জায়গা থেকে গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন করে দিয়েছে কি না তা নিয়ে মনে হয় ভাবার সময় এসেছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একসময় ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকও একাধিক দিনে শেষ হতো। সেসব বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্ত প্রস্তাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখত। সেই প্রস্তাব তৈরির জন্য মেধাবী রাজনীতিবিদরা ভূমিকা রাখতেন। আওয়ামী লীগ তখন গরিবের দল হলেও এর রাজনীতি ছিল বর্ণাঢ্য ও ঐতিহ্যের আলোয় আলোকিত।
১৯৭৫ সালের পর সেই গভীর সংকটকালে যারা ছাত্রলীগের রাজনীতির পতাকা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উড়িয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির প্রচার চালিয়েছেন সাংগঠনিক দক্ষতা ও মেধায় দলকে উজাড় করে দিয়েছেন তারা কি ব্যাকফুটে চলে যাচ্ছেন! তাদের মূল্যায়ন হয় না। ওয়ান-ইলেভেনে যারা ঝুঁকি নিয়েছেন, জেল খেটেছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন; যারা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ছাড়েননি তাদের খবরও এখন কেউ নেয় না।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশেই প্রবেশ করেনি, অর্থনৈতিক উন্নয়নে পৃথিবীতে রোল মডেল হয়েছে। করোনাযুদ্ধে তাঁর সাফল্য দেখার মতো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শত ব্যর্থতার মধ্যেও তিনি তাঁর নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা, মেধা ও প্রজ্ঞায় সংকট মোকাবিলা করছেন। খাবারের জন্য কাউকে কষ্ট করতে হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ আজ রাষ্ট্র পরিচালনায় আছে, কিন্তু ক্ষমতা চিরস্থায়ী থাকবে না। বিরোধী দলের কঠিন রাজনীতি মোকাবিলা করার মতো সাংগঠনিক শক্তি ও কাঠামো কি তৈরি আছে? এ নিয়ে কি কেউ ভাবছেন? সুতরাং সময় এসেছে দলের ত্যাগী এবং পরীক্ষিত নেতাদের মূল্যায়ন করার।
আওয়ামী লীগকে তৃণমূল বিস্তৃত জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর নির্বাসিত তার কন্যা শেখ হাসিনা চরম দুঃসময়ে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে হাল ধরেছেন। গণতন্ত্রের সংগ্রামে দীর্ঘ পথ হেঁটেছেন। বার বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয় দল হিসেবে ২১ বছর পর ক্ষমতায় এনেছেন এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য নিরলস কাজ করছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যার দুঃসময়ে যাঁরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন তারাই প্রকৃত আওয়ামী লীগার। কারণ তাদের ত্যাগ অনেক বেশি। তাঁরাই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এবং ওয়ান ইলেভেনে ভূমিকা রেখেছেন। এটাই দলের কঠিন বাস্তবতা।
সুবিধাবাদীরা যখন যে ক্ষমতায়, সেখানেই ভিড় করে। কিন্তু রাজনৈতিক বাণিজ্যিকীকরণ ও দুর্নীতির নেটওয়ার্কে সুবিধাবাদীরা যেভাবে নিজেদের জড়িয়ে আছে তাতে আদৌ কি সরানো যাবে? আওয়ামী লীগে বিভিন্ন দল থেকে এসে অনেকেই ক্ষমতা ভোগ করছেন। তারা আওয়ামী লীগার হতে পারেননি, দলের ত্যাগী কর্মীদেরও হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে পারেননি। সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের সামনে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগ এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির পাশাপাশি সব রকম শোষণ, বঞ্চনা, অন্যায়, অবিচার, জুলুমের বিরুদ্ধে সবসময় রাজনৈতিকভাবে সোচ্চার, প্রতিবাদী ভূমিকা রেখে এসেছে এবং এখনও রাখছে।
এই দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন মানুষের ভাগ্যের উন্নতি ঘটে। এ দলের জন্মকাল থেকে শুরু করে এই ৭৫ বছরের ইতিহাস সেই সত্যের সাক্ষ্য বহন করে। এখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পঞ্চম বারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন।
কোথাও কোথাও দলের নামে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অন্যের জমি-জায়গা, বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করার খবরও পত্রিকায় আসে। যদিও আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব বিষয়ে দলের অবস্থান, সরকারের অবস্থান, মনোভাব জানিয়ে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বক্তব্য দেন, সাংগঠনিকভাবে কখনও কখনও ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। কিন্তু পরিস্থিতির খুব যে উন্নতি হচ্ছে বা অবস্থান বদলাচ্ছে আপাতদৃষ্টে তা সকলে মনে করেনা। তাই আওয়ামী লীগের সামনে এই চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে। পরপর চারবার ক্ষমতায় থাকার কারণে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেড়েছে। আওয়ামী লীগকে এর মূল্যায়ন করতে হবে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সুফল সম্পর্কে বিশেষ করে জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণে গৃহীত কর্মসূচি দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে তুলে ধরা অপরিহার্য।
মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের অন্যতম কাণ্ডারি আওয়ামী লীগকে দলের তৃণমূলের কোন্দল ও বিরোধ মিটিয়ে স্থানীয় সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, সমাজসেবা ও মানবসেবাধর্মী কাজে সবাইকে সম্পৃক্ত করা একান্ত প্রয়োজন। এতে স্থানীয়ভাবে উন্নয়ন কাজে গতি আসবে, কাজের মানও ভালো হবে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দলের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্তা ও সখ্য বাড়বে, বাড়বে দল ও সরকারের জনপ্রিয়তা। তবে হাইব্রিড বা নব্য আওয়ামী লীগারদের কারণে ত্যাগী নেতারা অন্তরালে চলে যাচ্ছেন যা ভবিষ্যৎ ও দলের জন্য অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিতে পারে, এটা অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।
করোনা পরিস্থিতিসহ যে কোন দুর্যোগ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো প্রধানমন্ত্রী নিজে তদারকি এবং মোকাবিলা করছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এমপি-মন্ত্রীদের অনেকেই সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার মানুষের সঙ্গে তেমন একটা সম্পৃক্ততা তৈরি করতে পারছেন না গণমাধ্যমে সেরকম প্রতিবেদন দেখা যায় মাঝে মাঝে। প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভেবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যদি নিজেদের না শুধরে দাপটে বেড়ান, তা দলের ও দেশের জন্য হবে ক্ষতিকর। জনগণকে ভালোবাসতে হবে এবং জনগণকে সবকিছুতে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ দায়িত্ব দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদেরই নিতে হবে এবং মানুষের আস্থার জায়গাটিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। হাইব্রিড ও নব্য আওয়ামী লীগারদের দিয়ে কাজ হবে নাকি ত্যাগীদের দায়িত্ব দিতে হবে সেটা পরিস্কার করতে হবে বলেও বিশ্লেষকদের পরামর্শ।
রাজনীতি শুধু নিজে পাবার জন্য নয়, দেশের মানুষের সেবা করাই রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দরিদ্র ও অসহায় ছাত্রদের শিক্ষা প্রদানের জন্য নিজ পরিবারসহ পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করতেন। তিনি অনেক ছাত্রের লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছেন। ছাত্রজীবন থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত অসংখ্যবার কারাবরণ করেছেন। তিনি নিজ আদর্শ এবং দেশের মানুষের কল্যাণের মহান ব্রত থেকে সরে যাননি কখনো। অথচ আজ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নামে রাজনীতি করা অনেক সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি এখন নিজেদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন। বিভিন্ন অপকর্ম করে মিডিয়ায় আসেন দল ও নেতাকর্মীরা, বিব্রত হন সরকার, বিব্রত হয় দেশ-জাতি। বিপথগামী নেতাকর্মীরা এমন কাজ থেকে বিরত থাকবেন এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন।
বাঙালি জাতির পিতার আদর্শের রাজনীতির বাহক হবে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সব অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী, সমর্থক এবং দলমত নির্বিশেষে দেশের তরুণরা। তারা দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর মতোই নিঃস্বার্থে কাজ করবে, অহঙ্কারমুক্ত থাকবে, মানুষের সঙ্গে মানুষের ভেদাভেদ না করে সব ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিতের মাধ্যমে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়বে।
আমাদের আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের যারা নেতাকর্মী আছেন, একেবারে ওপওে থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ের বেশ কিছু সংখ্যক নেতাকর্মী, সমর্থক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার বক্তব্য ঠিকমতো বুঝতে পারেন না অথবা বুঝেও তারা তাদের নিজস্ব বিদ্যা-বুদ্ধি দিয়ে ইচ্ছেমতো চলেন। যার জন্য দেখা যায় দেশব্যাপী সত্যিকারের দলের বা সরকারের কাজ যা করা দরকার, অনেকেই তা করছেন না। নেতাকর্মীদের মধ্যে এখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মেনে কাজ করার প্রবণতায় ঘাটতি দেখা যায়। মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিত পথে শেখ হাসিনার নির্দেশে সবাইকে কাজ করতে হবে।
আওয়ামী লীগের এমন অনেক নেতা আছেন যারা সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন না আবার অনেক সময় বিব্রতকর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকেন। আওয়ামী লীগ বা অঙ্গসংগঠনে যারা নেতৃত্বে আছেন তারা নেত্রীর যে দর্শন, বঙ্গবন্ধুর যে দর্শন সেই দর্শনকে বাস্তবায়িত করবেন। নেত্রী যে কাজ দিয়েছেন সেগুলো জনগণকে জানাবেন এবং কাজের মাধ্যমে জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নেবেন।
বঙ্গবন্ধু আমাদের ছাত্রসমাজকে নিয়ে ভাবতেন এবং তিনি বলতেন, ‘ছাত্র ও যুব সমাজের প্রতিটি সদস্যকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তারাই হয়ে উঠবে এক আদর্শবান শক্তি। এই আদর্শ মানুষ বলতে তিনি এমন ব্যক্তিকে বুঝিয়েছেন, যে উন্নত মানবিক গুণাবলি ধারণ করবে ও অন্যের জন্য অনুসরণযোগ্য হবে।’ অর্থাৎ সামাজিকভাবে যা কিছু ভালো-শ্রেষ্ঠ, মহৎ ও কল্যাণকর সবকিছুই থাকবে ছাত্রসমাজের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে। আদর্শ মানুষ হতে হলে সবার ভেতর যেসব গুণ থাকা দরকার সেগুলো হলো-সততা, নিষ্ঠা, পরিশ্রমী ও পরোপকারী মনোভাব, মানবদরদি-সহমর্মিতা, নির্লোভ-নিরহংকার এবং সাহস। বঙ্গবন্ধু নিজে ছিলেন একজন আদর্শবাদী মানুষ। বাংলার শোষিত-নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তিই ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য ও আদর্শ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিল তিল করে গত এক দশকে দেশকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে এবং ভিশন ২০২১ অর্জনের পর ভিশন ২০৪১ বা স্মার্ট বাংলাদেশ অর্জনে দৃঢ় নেতৃত্বে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, অপরাধীদের পরিচয় একটাই তারা অপরাধী। তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং কতিপয় হীনস্বার্থবাদীদের অপচেষ্টা, যারা ব্যক্তিগতভাবে সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা জরুরি হয়ে পড়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং তার সরকারের অনেক ভালো কাজ চাপা পড়ে যাচ্ছে, যা নিয়ে হীনস্বার্থবাদীরা মোটেও চিন্তিত নয়।
বর্তমানে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রশ্নে মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব ঐক্য তৈরি হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। প্রযুক্তির প্রবেশগম্যতাকে ব্যবহার করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। অর্থনৈতিক এই রূপান্তরের জন্য শিক্ষাব্যবস্থায়ও রূপান্তর প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নেতাকর্মীদের মধ্যে থাকবে সততা, নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও পরোপকারী মনোভাব, মানবদরদি-সহমর্মিতা, নির্লোভ-নিরহংকার এবং সাহস। বঙ্গবন্ধু নিজে একজন আদর্শবাদী মানুষ ছিলেন। আগামী দিনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে রাজপথে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও দিকনির্দেশনায় কাজ করে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবে-এটাই সবার প্রত্যাশা।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশেই প্রবেশ করেনি, অর্থনৈতিক উন্নয়নে পৃথিবীতে রোল মডেল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির লালন, শোষণ মুক্ত সমাজ বিনির্মাণ এবং একটি উন্নত সমৃদ্ধ আধুনিক, প্রগতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন। বাংলাদেশ নানা দিক থেকেই এগিয়ে যাচ্ছে। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, অগ্রগতির মধ্যদিয়েই একটি দেশ সমৃদ্ধ হয়। যদি বিশ্বের অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের অগ্রগতির স্বীকৃতি দেয় এবং প্রশংসা করে, তবে তা অত্যন্ত ইতিবাচক এবং অনুপ্রেরণার।
আওয়ামী লীগ সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে ও নাগরিক সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে, সহজ করে দিয়েছে এবং এতে সরকার প্রধানের কঠোর নির্দেশনা আছে এটা মানতেই হবে। গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সড়ক কাঠামো চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না যে, এসব অঞ্চলের মানুষ জীবন-জীবিকাকে কতটা সহজভাবে গ্রহণ করতে পেরেছেন, অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। শেখ হাসিনার স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, দেশের মানুষকে উন্নয়নের স্বাদ পাইয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা, বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্বকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্থান দিয়ে যথাযথ মর্যাদার আসনে বসানোই ছিল মূল লক্ষ্য।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অঙ্গীকার ছিলো দেশবাসীর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার পূরণ করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশি-বিদেশি নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উন্নয়ন, অগ্রগতি আর সমৃদ্ধির পথে হাঁটছেন। ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে ৮ লাখ ৮৮ হাজারের বেশি ভূমি ও গৃহহীন পরিবারের মাঝে জমিসহ ঘর বিতরণ করেছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য চারটি ভিত্তি সফলভাবে বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। এগুলো হলো-স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি। এর পাশাপাশি হাতে নেওয়া হয়েছে ২১০০ সালের বদ্বীপ কেমন হবে- সেই পরিকল্পনা। স্মার্ট বাংলাদেশে সব কাজ, সম্পাদন করা হবে প্রযুক্তির মাধ্যমে। যেখানে প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে হবে দক্ষ। ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিভিত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক এবং উদ্ভাবনী বাংলাদেশ। স্মার্ট সিটি ও স্মার্ট ভিলেজ বাস্তবায়নের জন্য স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট ট্রান্সপোর্টেশন, স্মার্ট ইউটিলিটিজ, নগর প্রশাসন, জননিরাপত্তা, কৃষি, ইন্টারনেট কানেকটিভিটি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হবে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গত ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশকে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন ও বাংলাদেশ বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটেও অন্য দেশগুলোর মতো বড় ধরনের কোনো অর্থনৈতিক সংকটে না পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে তিনি এই সময়ে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে শক্ত অবস্থানে নিতে পেরেছেন। তা না হলে ১৭ কোটি মানুষের দেশটাকে এই সংকটকালেও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা বেশ কঠিন হতো।
১৯৯০ সালে সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে নির্বাচনের পথে দেশকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়। আওয়ামী লীগকে নানা ষড়যন্ত্রেও মোকাবিলা করতে হয়। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। শেখ হাসিনা সরকার গঠন এবং বাংলাদেশকে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের রূপরেখা বাস্তবায়ন শুরু করেন। এই সময়ে দেশ বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে, ডিজিটাল হওয়ার সুযোগ পায়, ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষার নানা প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে থাকে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ করে।
২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল এবং আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ৭৫ বছরে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা, উন্নয়ন, আত্মমর্যাদা, গৌরবময় অহংকারের অনেক কিছু দিতে পেরেছে।
তবে এখন অনেকের অভিযোগ আজন্ম আওয়ামী লীগ করেও দলীয় ক্ষমতার স্বাদ পাননি। তেমনি অনেকে হঠাৎ এসে উড়ে এসে জুড়ে বসে ষোল আনাই ভোগ করে ক্ষমতার স্বাদ নিচ্ছেন। এখন সাবেক আমলা, ব্যবসায়ী ও হাইব্রিডদের জয়-জয়কার বলে অনেকের অভিযোগ বা মনোকষ্ট রয়েছে অনেকের। এখনো অভিযোগ পাওয়া যায় দল ক্ষমতায় এলে মহাদুঃসময়ের দুঃখী কর্মীদের খবর দল নেয় না। মন্ত্রীরা এমপিরা তাদের আর চেনেন না বা কষ্ট হয় চিনতে। সাধারণ মানুষের কাছে ভিড়তে চান না। দলীয় কোনো সুবিধা-লাভ দূরে থাক তাদের রাজনৈতিক মূল্যায়নটুকুও হয় না। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বুকভরা অভিমানে রয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশেই প্রবেশ করেনি, অর্থনৈতিক উন্নয়নে পৃথিবীতে রোল মডেল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির লালন, শোষণ মুক্ত সমাজ বিনির্মাণ এবং একটি উন্নত সমৃদ্ধ আধুনিক, প্রগতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন। বাংলাদেশ নানা দিক থেকেই এগিয়ে যাচ্ছে। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, অগ্রগতির মধ্যদিয়েই একটি দেশ সমৃদ্ধ হয়। যদি বিশ্বের অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের অগ্রগতির স্বীকৃতি দেয় এবং প্রশংসা করে, তবে তা অত্যন্ত ইতিবাচক এবং অনুপ্রেরণার।
আওয়ামী লীগ সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে ও নাগরিক সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে, সহজ করে দিয়েছে এবং এতে সরকার প্রধানের কঠোর নির্দেশনা আছে এটা মানতেই হবে। গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সড়ক কাঠামো চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না যে, এসব অঞ্চলের মানুষ জীবন-জীবিকাকে কতটা সহজভাবে গ্রহণ করতে পেরেছেন, অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। শেখ হাসিনার স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, দেশের মানুষকে উন্নয়নের স্বাদ পাইয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা, বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্বকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্থান দিয়ে যথাযথ মর্যাদার আসনে বসানোই ছিল মূল লক্ষ্য।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অঙ্গীকার ছিলো দেশবাসীর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার পূরণ করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশি-বিদেশি নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উন্নয়ন, অগ্রগতি আর সমৃদ্ধির পথে হাঁটছেন। ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য চারটি ভিত্তি সফলভাবে বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। এগুলো হলো-স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি। স্মার্ট বাংলাদেশে সব কাজ, সম্পাদন করা হবে প্রযুক্তির মাধ্যমে। যেখানে প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে হবে দক্ষ। ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিভিত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক এবং উদ্ভাবনী বাংলাদেশ। স্মার্ট সিটি ও স্মার্ট ভিলেজ বাস্তবায়নের জন্য স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট ট্রান্সপোর্টেশন, স্মার্ট ইউটিলিটিজ, নগর প্রশাসন, জননিরাপত্তা, কৃষি, ইন্টারনেট কানেকটিভিটি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হবে।
আওয়ামী লীগ যেকোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। এটাই আওয়ামী লীগ এবং এটাই আওয়ামী লীগের শিক্ষা। আওয়ামী লীগের ইতিহাস যেমন সংগ্রামের ইতিহাস, আবার সেই সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগই পারে একটি দেশকে উন্নত করতে বা এগিয়ে নিয়ে যেতে, যেভাবে এখন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। যত অশুভ শক্তি, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করুক, না কেন বাঙালি এগিয়ে যাবে অগ্রযাত্রার পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
জনগণের সমর্থনের কারণে সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় দেশের অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়েছে এবং বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ রোল মডেল হিসেবেই এগিয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় দেশ যখন উন্নয়নের সোপানে এগিয়ে যাচ্ছে তখন মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির দোসররা অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করে। কোনো অশুভ শক্তিকে এই দেশে বিস্তার লাভ করতে দেওয়া হবে না। মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে। সাক্ষরতার হার ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
দুই কোটি মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ধরনের ভাতা পাচ্ছেন পরোক্ষভাবে ১২ কোটি মানুষ সামাজিক নিরপত্তা বেষ্টনির সুবিধা ভোগ করছেন। দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছেন। স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায়। ১৭ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে দরিদ্র মানুষ বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ পাচ্ছেন। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে।
সারাদেশে সড়ক, মহাসড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার, পাতাল সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রেল, নৌ ও যোগাযোগসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। মেট্রোরেল চালু হয়েছে, পদ্মাসেতু চালু হয়েছে, বঙ্গবন্ধু টানেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেস চালু হয়েছে।
আওয়ামী লীগের বিশাল কর্মযজ্ঞ সামনে রেখেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। শিক্ষা, যোগাযোগ অবকাঠামো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, নারী শিক্ষা, চাকরিজীবীদেও বেতন-ভাতা শতভাগ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা, বিনামূল্যে বই বিতরণ, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, সামাজিক কর্মসূচির আওতায় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী, অসহায়, বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, স্বামী নিগৃহীত নারী, অটিজম, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদান, আশ্রয়ণ প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, নারীর ক্ষমতায়নসহ ও বিভিন্ন সেক্টরের সামগ্রিক উন্নয়নের সুফল জনগণ পাচ্ছে। একমাত্র বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সেই সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, ‘আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি। আমরা বিজয়ী জাতি। বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে আমরা মাথা উঁচু করে চলতে পারি। কারও কাছে মাথা আমরা মাথা নত করবো না, কারও কাছে মাথা নত করে আমরা চলব না’।
আমাদের যতটুকু সম্পদ আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বারবার বলেছেন, সেই সম্পদটুকু কাজে লাগিয়েই আমরা বিশ্বসভায় আমাদের নিজেদের আপন মহিমায় আমরা গৌরবান্বিত হবো, নিজেদের গড়ে তুলব এবং সারাবিশ্বের কাছে আমরা মাথা উঁচু করে চলব। এটাই হবে এ দেশের মানুষের জন্য সবদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এভাবেই এগিয়ে যাবে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মোকাবেলায় বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরে জাতিসংঘের ই-গভর্ন্যান্স উন্নয়ন সূচকে সেরা ৫০টি দেশের তালিকায় থাকার চেষ্টা করছে। এক দেশ এক রেইট কর্মসূচির মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে জনগণকে ইন্টারনেটের আওতায় আনা হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার ইউনিয়ন। সারাদেশে ৮৮০০ ডিজিটাল সেন্টার চালু করা হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে ৫ জি চালু হয়েছে তবে বাণিজ্যিকভাবেও কাজ করবে।
তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় তরুণরা গড়ে তুলছে ছোট-বড় আইটি ফার্ম, ই-কমার্স সাইট, অ্যাপভিত্তিক সেবাসহ নানা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া মহাকাশে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইটসহ কয়েকটি বড় প্রাপ্তি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এখন স্বপ্ন নয় এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। একমাত্র আওয়ামী লীগ এ দেশকে সামনের দিকে নিয়ে যায় এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট