বাংলাদেশের ধ্বংসযজ্ঞে সোশ্যাল মিডিয়ার দায় কতটুকু!

হীরেন পণ্ডিত: বাংলাদেশে মানবাধিকারের মূল ভিত্তি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ভুল তথ্যের ব্যাপকতার কারণে আজ হুমকির মুখে। স্থানীয় পর্যায়ে ভুল তথ্য প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার, বিশেষ করে যুবকদের সাথে কাজ করার জন্য উদ্যোগের প্রয়োজন। যুব ও যুব-নেতৃত্বাধীন সংগঠনগুলির অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ প্রক্রিয়া চিহ্নিতকরণ এবং কার্যকরভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদ্দেশ্য হল যুবসমাজকে ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে এবং স্থানীয় এবং জাতীয়ভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করার জন্য প্রক্রিয়াগুলিকে শক্তিশালী করতে অবদান রাখা।

ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়; এগুলো বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকতার বিশ্বাসযোগ্যতাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশে, ফেসবুক এবং মেসেঞ্জারের মতো প্ল্যাটফর্মগুলি ভুল তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, প্রায়শই এগুলো ভাইরাল হয়ে যায়। এই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের জন্য ভুল তথ্যের মোকাবেলা করতে এবং বিস্তৃত পরিসরে তথ্য প্রচারের বস্তুনিষ্ঠ মান বজায় রাখার জন্য সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংঘাতের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার অনুঘটক হয়ে উঠেছে। এই অপব্যবহারের ফলে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি সাধত হচ্ছে, ভুলতথ্য এবং ক্ষতিকারক বিষয়গুলো সমাজের শান্তিকে বিনষ্ট করে উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ২০২৪ সালের কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম করে দেশে যে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চলে এর মূলে গুজব ও অপতথ্যের ভূমিকা ব্যাপক ছিলো বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটক এর।

আমাদের সমাজে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি ও সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রতারণামূলক উপাদান দ্বারা ভরপুর। শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরির জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর আরো সতর্ক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক, টুইটার, টিকটক এবং ইউটিউব বাংলাদেশের ভুল তথ্য থেকে বেআইনি মুনাফার জন্য একটি প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৮৪ শতাংশের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, প্রতিদিন হাজার হাজার বিভ্রান্তিকর বিষয়বস্তুুর প্রচার হচ্ছে। এটি এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করে যেখানে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশের কাছে তারা যে তথ্যের মুখোমুখি হয় তার নির্ভুলতা স্বাধীনভাবে যাচাই করার উপায় নেই।

ভুল তথ্যের ব্যাপক বিস্তার একটি বড় সামাজিক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। ভুল তথ্যের প্রভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঐতিহাসিক উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা এবং প্রবেশযোগ্যতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই আরও জটিল হয়ে ওঠে, যা জাতির স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

ভুল তথ্যের জাল উন্মোচন করার জন্য নিয়োজিত বিভিন্ন কৌশল বোঝার সাথে জড়িত, যার মধ্যে রয়েছে মিথ্যা সংযোগ, বিভ্রান্তিকর বিষয়বস্তু এবং প্রতারক সামগ্রী তৈরি করা।

বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত ল্যান্ডস্কেপ, ৩১.৫ শতাংশ ইন্টারনেট প্রবেশের হার এবং ১৮৮ মিলিয়ন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী, স্মার্টফোন ব্যবহারের ব্যাপকতাও অনেক। তথ্যের ক্ষতিকারক পরিণতি রোধ করতে তথ্যের এই প্রবাহকে পরিচালনা করাই চ্যালেঞ্জ। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যাচাইকরণের চ্যালেঞ্জগুলি এই সত্য থেকে উদ্ভূত যে কেউ একটি সংবাদের উৎস হতে পারে, যা যাচাইকরণ প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে।

শুধু টুইটার নয়, মেটার মতো অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কাছেও এ ধরনের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য উদ্বেগের বিষয় নয়। বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের বিরোধিতা করেন এমন অনেকের দাবি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নীতির বিষয়ে অঙ্গীকার আর তা বাস্তবায়নে পার্থক্য আছে, বিশেষ করে ফেসবুকে বিভ্রান্তি, ষড়যন্ত্রের তত্ত্বের বিষয়ে আলোচনা ও উসকানিমূলক বিজ্ঞাপন অনুমোদনের ক্ষেত্রে এটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা জানান, অনেক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মেটা ২০২০ সালে নজরদারি পর্ষদের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেয়। এই পর্ষদের কার্যকারিতা দেখতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। অনলাইনে জাতিগত বিদ্বেষের প্ররোচনাকে মোকাবেলা করার জন্য তাদের প্রক্রিয়া পর্যালোচনা এবং সংশোধন করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সর্বোচ্চ পর্যায়ে অব্যাহত প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। বিবৃতি দেওয়া জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আফ্রিকার বংশোদ্ভূত জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ, ব্যবসা, আন্তঃদেশীয় করপোরেশন ও মানবাধিকার বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের সভাপতি ও সদস্যরাও রয়েছেন।

এটি এখন বাস্তবতা যে আমাদের দেশেও, সমকালীন বিশ্বের মত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অতিমাত্রায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একদিকে এর অত্যধিক ব্যবহারিক গুরুত্ব, অন্যদিকে অপব্যবহারের মাত্রা বিভ্রান্তির বেড়াজালে পুরো সমাজে নির্মাণ করছে কদর্য-সংশয়-আশঙ্কার অনাকাক্সিক্ষত প্রাচীর। অপসংস্কৃতির মোড়কে রাজনীতি-ধর্ম-অর্থনীতি-সামগ্রিক সামাজিক বিষয়গুলোর মিথ্যা ভিত্তিহীন প্রচারণা, সাম্প্রদায়িকতা, কূপম-ূকতা, অসহিষ্ণুতা, সহিংসতা, বিরোধ, বিচ্ছেদ জীবনপ্রবাহের সাবলীল গতিময়তায় প্রচ- অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

কতিপয় ব্যক্তিত্বের পরিচয়ে নানামুখী নেতিবাচক বক্তব্য পরিবেশন অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করছে। এতে সামাজিক অসংগতি গণমানুষের জীবনে অসহনীয় দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত করছে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির আচ্ছাদনে দুরভিসন্ধিমূলক তরুণ সমাজের সৃজন-মনন-মানবিক-নৈতিক চরিত্রের বিচ্যুতি ভবিষ্যৎ স্বাভাবিক সমাজ বিনির্মাণে কতটুকু ভূমিকা রাখবে, তার গভীর বিশ্লেষণ অতীব জরুরি।

সমৃদ্ধ পাঠ্যপুস্তক-বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিমানসের জীবনচরিত জ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর পঠনপাঠন থেকে দূরে সরিয়ে সামাজিক যোগাযোগনির্ভরতা যে ভয়াবহ বাস্তবতার ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করছে, তা অনুধাবনে ব্যর্থ হলে সুন্দর ধরিত্রী কঠিন অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিপতিত হবে-এ সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

২০১০ সালে বুকার পুরস্কার বিজয়ী খ্যাতিমান ব্রিটিশ লেখক হাওয়ার্ড জ্যাকবসন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘২০ বছরের মধ্যে শিশুদের মূর্খ বানাবে ফেসবুক-টুইটার। ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আধিপত্যের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশুরা অশিক্ষিত হবে। স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং প্রচুর পরিমাণে ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে নাটকীয়ভাবে তরুণ প্রজন্মের যোগাযোগের পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। আর এসবের কারণে তারা হারাচ্ছে বই পড়ার অভ্যাসও।’ অপরাধবিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইদানীং আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে।

এ মাধ্যম আমাদের মানবিক গুণাবলিকে প্রভাবিত করছে। মানি লন্ডারিং, আক্রমণাত্মক গেম, ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে অনেকে। মানসিকভাবে অনেকেই আছে অস্থির অবস্থায়। এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ক্রমেই রাগ-ক্রোধ-অবসাদ-বিষণœতা-একাকিত্ব-হতাশা-হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার নিয়ে শঙ্কিত স্বয়ং ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সিইও মার্ক জাকারবার্গের ভাষ্যমতে, ‘সোশ্যাল মিডিয়া সময় নষ্টের জন্য নয়। এটি সত্যিকারে উপকারে আসতে পারে, যদি এর সঠিক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আপনি যদি শুধু এখানে বসে থাকেন আর যা দেখানো হবে, তাই গলাধঃকরণ করেন, তাহলে তো হবে না।’

ইতিবাচক অবদান রাখার পাশাপাশি প্রবাসী ও অভিবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে অনেকেই দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এদের সরব উপস্থিতি ও দেশবিরোধী আপত্তিকর মন্তব্য-বক্তব্য প্রচারের কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এবারের ধ্বংসযজ্ঞে গুজব, অপ্রচারের মাধ্যমে সহিংসতাকে উস্কে দিয়েছে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ও টিকটক। এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যারা আছেন, তারা একবার ভেবে দেখুন এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার পথ কি, মানুষের কল্যাণেই যদি এসব সোশ্যাল মিডিয়া কাজে না লাগে, মানুষ ধ্বংস, দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করার কাজে উস্কানিতে আপনাদের মিডিয়া ব্যবহৃত হয়, সে জন্য আপনাদের জবাবদিহিতাও জরুরি। আপনাদের মিডিয়া ভুল ও অপতথ্যে মানুষ ও সমাজের ক্ষতি হচ্ছে কিনা তা আপনাদের নিশ্চিত করতে হবে, এর দায় আপনার এড়াতে পারেন না।

তারা যেসব দেশে অবস্থান করছে, সেসব দেশের নানা আইনি জটিলতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে। এসব ঘৃণ্য কাজে নিয়োজিত-তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের তালিকা ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ মিশনগুলোয় পাঠানো হয়েছে। ওইসব দেশের আইনের আওতায় এনে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো থেকে সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর কাছে আবেদন জানানো জরুরি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্রমতে, বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৭০ শতাংশ মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংযুক্ত, যার প্রায় ৯০ শতাংশই তরুণ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, লিঙ্কডিন, স্কাইপে প্রভৃতি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সর্বাধিক জনপ্রিয় ফেসবুক। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশের রয়েছে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং এর একটি বিশাল অংশ কিশোর-কিশোরী।

বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপের ফলাফল অনুসারে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের কারণে উল্লেখযোগ্য তরুণ ও তরুণী বিপথগামী-মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে-পড়াশোনায় মনোযোগ হারাচ্ছে-খেলাধুলা ছেড়ে দিয়ে রাতদিন ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। চরম স্খলন হচ্ছে শিক্ষা-নীতি নৈতিকতার। ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে সংঘাত-সহিংসতা। ভুয়া তথ্য সরবরাহ-ঘৃণা-বিদ্বেষ, যৌনতা ও অশ্লীলতা-চরিত্রহনন-মুদ্রা ও মানব পাচার-জুয়া-সাইবার সহিংসতাসহ নানা মাত্রিক অপরাধের মাধ্যম হিসাবে পরিগণিত হয়েছে এ সামাজিক যোগাযোগ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরাধের ক্রমবর্ধনশীলতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইন-চাপ প্রয়োগের ফলে ইউটিউব ও ফেসবুকের মতো অনেক সাইট তাদের নিজস্ব নিয়মে অগ্রহণযোগ্য ও ক্ষতিকর বিষয়বস্তু দ্রুত মুছে ফেলাসহ প্রথম প্রকাশ হওয়া প্রতিরোধের পদক্ষেপ নিয়েছে। ইউটিউব ও ফেসবুক কর্তৃপক্ষ নিয়মিত অনুপযুক্ত বিষয়বস্তু অপসারণের তথ্য প্রকাশ করছে।

গুগলের মালিকানাধীন ভিডিও শেয়ারিং সাইটের তথ্যমতে, তারা ২০২০ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৮৮ লাখ ভিডিও, ৩৩ লাখ ক্ষতিকারক চ্যানেল ও ৫১ কোটি ৭০ লাখ অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য অপসারণ করেছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা উল্লেখ্য সময়ে ৩ কোটি ৩০ লাখ ক্ষতিকারক বিষয় সরিয়ে নিলেও অগ্রহণযোগ্য ও ক্ষতিকর বিষয়বস্তুর আধিক্যের কারণে শুধু কোম্পানির একার পক্ষে এটি ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। নিয়ন্ত্রক কোম্পানিগুলোর শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এটি দিনদিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশে পরিচালিত প্রতিটি ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন বিনোদনমূলক প্ল্যাটফরমগুলোর জন্য বিটিআরসি থেকে কিছু শর্তসাপেক্ষে নিবন্ধন নেওয়ার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, দেশে পরিচালিত যে কোনো ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অফিস বাংলাদেশে থাকতে হবে। সংবাদ-কিউরেটেড কনটেন্ট-ফিল্ম-ওয়েব সিরিজ রয়েছে এমন ওয়েবসাইটের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এনওসি বাধ্যতামূলক।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশও আইনি কাঠামোর ভিত্তিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গণমাধ্যমের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, জার্মান সরকার ২০১৮ সালে নেটজডিজি এ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিকে তাদের সাইটে প্রকাশিত আপত্তিকর বিষয়বস্তু সম্পর্কে অভিযোগ পর্যালোচনা করার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা-বিষয়বস্তু প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা অপসারণ-কোম্পানিগুলোর কাজের বিবরণ সম্পর্কে প্রতি ছয় মাস অন্তর আপডেট প্রতিবেদন প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

ভারতে ২০২১ সালে প্রণীত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা মতে, ফেসবুক-টুইটার-হোয়াটসঅ্যাপ ও অন্যান্য যোগাযোগমাধ্যমের কর্তৃপক্ষকে ভারতীয় সরকার কোনো ব্যবহারকারীর পোস্ট মুছে দেওয়া এবং ব্যবহারকারীর নাম-পরিচয় প্রকাশের অনুরোধ করতে পারবে। ঘৃণ্য ও হিংসাত্মক বিষয়বস্তু প্রকাশের কারণে সংস্থাগুলোর বৈশ্বিক টার্নওভারের ১০ শতাংশ পর্যন্ত আর্থিক দ- ও প্রযুক্তি নির্বাহীদের জন্য তিন বছরের কারাদ-ের বিধান রেখে অস্ট্রেলিয়ায় ২০১৯ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়।

২০২১ সালের নভেম্বরে কার্যকর আইনে রাশিয়াকে জরুরি অবস্থায় বিশ্বব্যাপী ওয়েব সংযোগ বন্ধ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং রাশিয়ার ডেটা আইনে সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলো কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ সার্ভারগুলোয় রাশিয়ানদের সম্পর্কে ডেটা সংরক্ষণ করতে পারবে। শিশু পর্নোগ্রাফি, হেট স্পিচ এবং বিনা সম্মতিতে কারও অন্তরঙ্গ ছবি প্রকাশ করাকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করে কানাডা সরকার কর্তৃক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইনে পুলিশ সোশ্যাল প্ল্যাটফরম এবং বক্তব্য পোস্টকারীর বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারবে।

চীন সাইবারস্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ওয়েবসাইট বন্ধ ও জুয়া খেলাসহ ক্ষতিকারক নানা মোবাইল অ্যাপ অপসারণ করে থাকে। দেশটিতে থাকা কয়েক হাজার সাইবার পুলিশের কাজ হচ্ছে সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফরম এবং সংবেদনশীল স্ক্রিন বার্তাগুলোকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা।

জগতের প্রতিটি বিষয়েরই ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় দিকই থাকে। কিন্তু যেকোনো বিষয়ের ইতিবাচক দিকগুলোকে সাদরে গ্রহণ করে সেগুলোকে আমরা কীভাবে কাজে লাগাচ্ছি সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আজকাল এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে ব্যবসা-বাণিজ্যের এক বিরাট মাধ্যমের সূচনা হয়েছে। এই যান্ত্রিক কর্মব্যস্ত জীবনে অনেকের নিজের নিত্যপ্রয়োজনীয় নানাবিধ পণ্য কিনতে দোকান, মার্কেটে যেতে পারেন না। তাদের এই ব্যস্ত জীবনে আশার আলো হয়ে এসেছে ই-কমার্স। বিভিন্ন নামীদামী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিংবা ছোটখাট ব্যবসায়ীদের বেঁচে থাকার অবলম্বন এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যার ফলে তারা নিজেদের বিক্রয়যোগ্য পণ্যের প্রচার ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। এই ই-কমার্সের সুফল ভোগ করতে বর্তমানে বহু বেকার তরুণ উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে ঝুঁকছে। এর ফলে অনেকেই এখন অনলাইন ব্যবসামুখী হচ্ছে ও সফলতার মুখ দেখছে।
আমাদের এই সত্যটি স্বীকার করে নেওয়া জরুরি যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদের বাস্তব জীবনের সম্পর্কে নেতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনছে ও আমাদের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায় তৈরি করছে। যে কারো সাথে মনের ভাব বিনিময়ের জন্য সামনে বসে বলা সর্বোত্তম। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির ফলে আমরা ভার্চুয়ালি মনের ভাব আদান-প্রদানেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রযুক্তির ওপর আমাদের এই নির্ভরশীলতা আমাদের প্রতিনিয়ত বাস্তব জীবন থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে ক্রমেই আমাদের যান্ত্রিক করে তুলছে।

মূলত প্রতিটি ধর্মের ধর্মগ্রন্থ অনুসারে এতদিনকার প্রচলিত রীতিনীতি-সমাজদর্শন-সত্য-সুন্দর-ক্যল্যাণ আনন্দের অনুষঙ্গভিত্তিক সংস্কৃতি-কৃষ্টি-ঐতিহ্যের মূলে কুঠারাঘাত করে বিকৃত চিন্তাচেতনা-ধ্যানধারণার অনুপ্রবেশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিগূঢ় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে। মিথ্যাচার-প্রতারণা-জালিয়াতি-অসংলগ্ন কর্মযজ্ঞের সমীকরণে প্রজন্ম কী পেতে যাচ্ছে, তা ভেবে দেখার এখনই উপযুক্ত সময়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো

Comments (0)
Add Comment