প্রশ্নটা করলাম এজন্য যে, আমি চাই সংকট কেটে যাক। সংকট কাটানোর জন্য বর্তমান লেখায় আমার চিন্তাগুলো গ্রন্থিত করব। প্রথমত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ও সব সদস্যকে বলতে চাই যে, তারা যে বিপ্লব সাধন করেছে এটি অভূতপূর্ব, অকল্পনীয় ও সম্মুখমুখী। (এখানে বলে রাখি, আমি একজন প্রবীণ শিক্ষক বিধায় সামাজিক রীতি মেনে আমি তাদের ‘তুমি’ করে বলছি স্নেহের জায়গা থেকে, যেহেতু তারা সবাই ছাত্রছাত্রী)। তাদের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন। জুলাই মাসের এক তারিখ থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে তারা একবারের জন্যও লক্ষ্যবিচ্যুত হয়নি। গুলির মুখে, প্রতিপক্ষ দলের সন্ত্রাসের মুখে, নানান ধরনের অপবাদের মুখে তারা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যায়নি শুধু, আন্দোলনকে বিস্তৃত করেছে, সব স্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করেছে এবং এক মাস পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ৫ আগস্ট ঠিকই বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। প্রবল প্রতাপশালী নেত্রী, অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী নেত্রী, রাষ্ট্রশাসনে না হলেও রাষ্ট্র উন্নয়নে বেশ খানিকটা সফল, এমন একজন নেত্রীকে পরাভব মানতে বাধ্য করেছে।
এ বিজয় শুধু আগের গণআন্দোলনগুলোর মতো সাধারণ বিজয় ছিল না, এটি ছিল বিপ্লব। এই প্রজন্ম তাই সোনার বাংলার সোনার প্রজন্ম। এদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভাষায় বলা হচ্ছে জেন-জেড প্রজন্ম। এদের জন্ম গড়পড়তায় নব্বইয়ের দশকে, তাই এদের বেড়ে ওঠা মোবাইল প্রযুক্তির বিশ্বব্যাপী বিস্তারের সঙ্গে সমকালীন। এরা ছাপানো কাগজে বই না পড়ে মোবাইলের পর্দায় বই পড়ে। এদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, এরা ভার্চ্যুয়াল জগতে বড় হলেও এদের মধ্যে অনাবশ্যক ভাবালুতা নেই। বলা হচ্ছে, এদের মানসিক গঠন বৈষয়িকভাবে বিস্তারিত, কী করলাম, কেন করলাম এবং কী পেলাম, এই কর্মপদ্ধতি এদের চিন্তাজুড়ে আছে। এরা কী চায়, এরা সেটা জানে। এবং যা চায়, সেটা কীভাবে আদায় করতে হয় সেটাও তারা জানে।
যেদিন পূর্বতন সরকারের পতন হবে, ৫ আগস্ট, প্রতিরক্ষা বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর নেতাদের বলা হলো, হাজারখানেক মেরে ফেলেন না কেন, তখন সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তারা বললেন, দশ হাজার লোক মারলেও এই গণবিক্ষোভ ঠেকানো যাবে না।
কারণটা কী? কারণটা হচ্ছে নৈতিক সাহস। একটা উদাহরণ দিই। একটা বেসরকারি টিভি সাক্ষাৎকারে ছয় সমন্বয়কের একজনকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি ভয় পাননি, পুলিশের গুলির মুখে দাঁড়াতে। সে ব্যাখ্যা করল, যখন বিক্ষোভরত জনতার মধ্যে থাকা হয় তখন ব্যক্তিগত অঙ্গহানি, প্রাণহানি বা অন্য কোনো তরফের ভয় মন থেকে উবে যায়। কারণ আপনি জানেন যে আপনি যে দাবি করছেন সেটি নৈতিকভাবে সঠিক, তখন আপনাকে মেরে ফেললেও আপনার আদর্শটা উজ্জীবিত হয়ে অন্যদের মধ্যে ছড়াবে। এই উত্তরটির মধ্যে আমরা একাধারে পাই জনতা-মনস্তত্ত্বের প্রকাশ এবং অন্য ধারে ব্যক্তিগত প্রজ্ঞার প্রকাশ।
বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার সময় গণভবন, সংসদ ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনার সামগ্রী লুট হয়েছে এবং ভাঙা হয়েছে, কিন্তু গত মঙ্গলবার থেকে বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা সেগুলো পুনরায় ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে এবং এরা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব নিয়ে রাস্তার যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে, রাস্তাঘাটের নোংরা পরিষ্কার করছে এবং আরও যাবতীয় দেশ রক্ষামূলক কাজে ব্যাপৃত রয়েছে। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটের একটা ভিডিও পেলাম যেখানে দেখলাম তরুণ-তরুণীরা মিলে রাস্তা পরিষ্কার করছে।
তবে দুঃখজনকভাবে বহু স্থানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি ভাঙা হয়েছে, যেটি সহসাই যে কোনোভাবে বন্ধ হওয়া উচিত। কারণ তিনি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
এই ধরনের ভুল পথে প্রবাহিত জনআবেগসহ বড় কিছু শঙ্কার জায়গা রয়ে গেছে, যেগুলোর ভেতর দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়োজন হবে সর্বোচ্চ মেধা ও কৌশলের প্রয়োগ। এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য তরুণদের সম্পূর্ণ ত্যাগও যথেষ্ট হবে না, প্রয়োজন হবে এমন একটি শাসকবর্গ, যারা হবেন কুশলী, কূটনীতি জ্ঞানসম্পন্ন ও চিন্তা-চেতনায় প্রাগ্রসর ও আধুনিক।
এর মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। বয়স চুরাশি হলেও ড. ইউনূস জাতির সন্ধিক্ষণে এই গুরুদায়িত্ব পালনে সম্মত হয়েছেন। সেজন্য তাকে অভিনন্দন জানাই। এবং আর যাদের নাম শোনা যাচ্ছে সদস্য হিসেবে তাদের অনেকেই ক্ষুরধার সমাজসচেতন ব্যক্তি। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামোটি হয়তো ইতিবাচক হবে। সক্রিয় রাজনীতিতে বা দেশ পরিচালনায় হয়তো তাদের অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু তারা সর্বক্ষেত্রে যোগ্য লোকদের পরামর্শ গ্রহণের কাঠামো তৈরি করলে শাসনকার্য পরিচালনা করতে খুব বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
ব্যক্তিদের চরিত্র আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, শাসক যখন অযোগ্য হয়ে ওঠেন, তখন তিনি চাটুকারদের দরজাটা খুলে দেন এবং সমালোচকদের দরজাটা বন্ধ করে দেন। তখন হয় কি টাকা ও পেশি জায়গা দখল করে নেয় মেধা, যোগ্যতা ও বস্তুনিষ্ঠতার। পেশাদারিত্বের চেয়ে জায়গা করে নেয় পেশিদারিত্ব।
পূর্বতন সরকারের সময় বাংলাদেশের চোখ ধাঁধানো উন্নতি হয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থারও বহুল উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু নৈতিকভাবে একটি গর্হিত কাজ হয়ে গিয়েছিল, সেটি হচ্ছে মানুষের মৌলিক ভোটাধিকার হরণ। অর্থাৎ বাক-স্বাধীনতার মতো মৌলিক উৎপেক্ষায় সরাসরি হস্তক্ষেপ। আন্দাজ করা যায় যে, জেন-জেড প্রজন্মের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কোনো শিক্ষার্থীই হয়তো তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি।
এখন আশা করি, ড. ইউনূসের অধীনে একটি নতুন দিগন্ত সূচনাকারী পথ তৈরি হবে, যে পথে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিচালনা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আধুনিক যুগে প্রবেশ করবে।
ড. মোহীত উল আলম : সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ