চোখ থেকে মুছে ফেলো অশ্রুটুকু..। জসিম মল্লিক
১.
১৯৭১ সালে বরিশালে ক্রাকডাউনের এক মাসের মাথায় আমরা ঢাপরকাঠি চলে গিয়েছিলাম মামা বাড়িতে। আমি তখন নয় বছরের বালক। মনে আছে মামাদের অনেক বড় সংসার ছিল। তিন মামাৱ গন্ডায় গন্ডায় ছেলে মেয়ে। তার মধ্যে আমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকি। মা সেখানে গিয়ে কাজে লেগে যেতো। মনে পড়ে মামাদের ভিতর বাড়ির কয়েকটি ঘরের ভিত ছিল মাটির। রোজ সকালে সেই সব ভিত মাটির গোলায় ন্যাতা ভিজিয়ে লেপা হতো। এ কাজে পাকা হাত ছিল আমার মায়ের। লেপার পর মাটি শুকিয়ে গেলে দেখা যেত অতি সরল রেখা হাতের লাইনের মতো পড়ে আছে। এ কাজের পর মাকে খুব পরিশ্রান্ত লাগতো। একটু দুরেই সান বাঁধানো ঘাটে মাঝে মাঝে মা’কে চুপ করে বসে থাকতে দেখতাম। কোলের কাছে কাদাগোলা মেটে হাঁড়ি নিয়ে বসে ন্যাতাটা পানিতে ধুচ্ছে তো ধুচ্ছেই। খুবই অন্যমনষ্ক দেখাতো মাকে তখন। শিশুবেলা থেকেই আমার বাবা ছিল না। মা ছিল নিঃসঙ্গ।
২.
এক-একদিন সন্ধ্যেবেলা আমার খুব মন খারাপ লাগত। এমন এক-একটা বিকেল বেলা আছে যখন সূর্য ডুবে যাওয়ার সময়ে অন্তত একটা মায়াবী অপার্থিব আলো এসে পড়তো উঠোনে। আকাশের রং যেত পালটে। সমস্ত বাড়িটায় কেমন এক আলো আঁধারির সৃষ্টি হত। হঠাৎ হঠাৎ আমার বহুজনের মাধ্যে হারিয়ে যাওয়া আমাকে অনুভব করতাম। টের পেতাম আমার আলাদা একা এক ’আমি’ আছে। সেই সব বিষন্ন বিকেলে আমার মাঝে মাঝে মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে হত। প্রায়ই পশ্চিমের ঘরে মাকে খুঁজতে গিয়ে পেতাম না।
৩.
সারা বাড়ি খুঁজে মাকে হয়ত পেতাম বড় ঘরের পাটাতনের সিঁড়ির তলায় গামলায় চাল মেপে তুলছে। আমি অবোধ দুর্জ্ঞেও এক বিষন্নতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই যে মার কাছে গেছি তা মা বুঝত না। তবু একটুক্ষণের জন্য হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিত। একটুক্ষণের জন্য মাথাটা চেপে রাখত বুকে। আমি তখন মায়ের গা থেকে মা মা গন্ধটা পেতাম। মা ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করতো দুপুরে পেট ভরেছিল?। আমি বুক ভরে মায়ের গায়ের সুঘ্রাণ নিতাম। আজ মা নেই। আনন্দও নেই। কিন্তু স্বাধীনতার আনন্দতো আছে!
(আলোকচিত্রঃ লুৎফর রহমান রিটন, ফেব্রুয়ারি ২০২০)
টরন্টো ১৬ ডিসেম্বর ২০২০