বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন ‘ঠাই নাই ঠাই নাই-ছোটো সে তরী/আমার সোনার ধানে গিয়াছে ভরি/শ্রাবণগগণ ঘিরে/ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে/শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি, যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।’ শাব্দিক অর্থে বা রূপক অর্থে কবি পদ্মার রুপকে ফুটে তুলেছেন তার আপন মহিমায়। কখনো ধুধু বালুচর আবার কখনো ভরা যৌবন পদ্মার। এই মানুষ বৈঠা মেরে নতুবা ইঞ্জিনের সহায়তায় পদ্মার এপার থেকে ওপারে মানুষকেই নিয়ে যায় গন্তব্যে পৌঁছানো তাগিদে। আবার এই মানুষই যৌবন হারানো পদ্মার বুকে পায়ে হেটে মাড়িয়ে যায় দীর্ঘপথ।
পদ্মাকে ঘিরেই বিনিয়োগ হয় শ্রম। অথৈই জলেই ভাসতে ভাসতে ছোট্ট ছোট্ট নৌকায় একটু বিনোদনের স্বাদ। ওই বিনোদনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে শ্রমজীবী মাঝিমাল্লাদের জীবনের গল্প। জেলেদের জালে উঠে আসে নানা প্রজাতির মাছ। কেউ বা মাছের স্বাদ নেন। আর কেউবা মাছ বিক্রির টাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে একটু সুখের স্বপ্ন দেখেন।
মরা পদ্মায় শ্রমের পরিবর্তন। জল নেই তাতে কি? নৌকার মাঝিমাল্লা, জেলে নতুবা নদীর জলের সাথে যাদের শ্রম বিনিয়োগ। তাদের শ্রমের পরিবর্তন আসে। জলহীন পদ্মার জেগে ওঠা চরের বুক দিয়েই চালানো হয় ঘোড়ার গাড়ি। কেউ চালান ব্যাটারী চালিত অটোবাইক। যাদের মওসুম ভিত্তিক শ্রম বিনিয়োগ।
বাদাম, ধানসহ বালু ও চরের সাথে বেড়ে ওঠা কৃষিপণ্যের মধ্যেই এই মানুষদের শ্রম বিনিয়োগের কমতি নেই। সাথে বালু আর মাটি খেকো দূর্বৃত্তরাও নিয়োজিত করেছে মুওসুমি এই সকল শ্রমজীবীদের। নদীর জেগে ওঠা চরগুলো হয়ে উঠেছে একটু বাড়তি আনন্দ পাওয়ার জায়গা। তৈরী হয়েছে খেয়াঘাট। সেখানে পদ্মার রূপবদলে থমকে যায়নি শ্রমজীবীদের জীবিকা নির্বাহের তাগিদ।
বিনোদন পিপাসু নানা শ্রেণির মানুষও একটু বিনোদনের আশায় ছুঁটে আসছেন জলহীন পদ্মার বুক মাড়িয়ে দিগন্ত ও বিসৃর্ণ বালুচরের উন্মুক্ত আবহাওয়ায়। শীতের বেলা গড়ানোর সাথে সাথে আবহাওয়ার রুপ বদল হয়। কুয়াশা কেটে যায়। দেখা মেলে সূর্য্যরে। চারিপাশ বালু আর সবুজের সমারোহ। এ যেন বিধাতার এক অপরূপ দান।
পাবনা-কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী জটিল সমীকরণের এক নাম শিলাইদহ ঘাট। এই ঘাট ঘিরেই বাংলাবাজার লঞ্চঘাট, সাদীপুর, শিলাইদহ, কসবাচর, হামিরহাটসহ বেশ কয়েকটি ঘাট তৈরী হয়ে যায় পদ্মার জল নেমে যাওয়ার কারনে। আর এগুলো পর্যায়ক্রমে খেয়া নৌকা পারাপারের ঘাটে পরিণত হয়।
১৬ ডিসেম্বর দুপুরে বাংলাবাজার পাড়ি দিয়ে সাদীপুর হয়ে শিলাইদহ ঘাটের প্রায় আড়াই কিলোমিটার দুরেই কসবাচর। কসবাচরের খেয়াঘাট থেকে শিলাইদহ ঘাট পৌঁছাতে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ১২ থেকে ১৫ মিনিটের পথ। কসবাচরে খেয়াঘাটের বদৌলতে নদীপারাপারে অপেক্ষমান মানুষের জন্য বসবার ব্যবস্থা করেছে ছোট্ট দোকানীরা। সেখানে যাত্রাপথের বিরতিতে মুড়ি মাখানো, বাদাম, চাসহ হালকা নাস্তা করার ব্যবস্থা রয়েছে।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী শিলাইদহঘাট থেকে কসবা ঘাট পর্যন্ত নৌকাতেই আসতে হবে। আর কসবা থেকে মোটর সাইকেল, বাই সাইকেল, ব্যাটারী চালিত অটো রিক্সাযোগে সাদীপুর ঘাট। এখানে আসতে ঘোড়ার গাড়ীও পাওয়া যায়। সকাল থেকে শুরু হয়ে মাগরিবের নামাজের পরও এখানে নদীপারাপারের কার্যক্রম চলে।
কসবাচরের খেয়া নৌকা ঘাটের তীরে ২৫ বছর ধরে ছোলা মুড়ি বিক্রি করছেন আব্দুল করিম। নদীর জেগে ওঠে চরকে আকড়েই তার এই ব্যবসা। বয়স ষাটের পঞ্চাশের কোঠা পার করেছেন। তার জীবনকালে শিলাইদহ-কসবা পদ্মায় কখনো পানি শুকাতে দেখেন নি। অথচ কসবা থেকে সাদীপুর বেশ কয়েকটি ঠিবি কখনো অথৈই পানি। আর এখন পায়ে হাটা চর।
চায়ের দোকানদার তুষার। ছোট্ট স্টলেই বসিয়েছেন সৌর বিদ্যুৎ। কাঁচা বাজার, ডিম, মুরগী, সিলিন্ডার গ্যাস সবই আছে তার ওই ছোট্ট পরিসরের দোকানে। সেও নদীর পানির সাথে খেলা করেই জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। ইঞ্জিন চালিত খেয়া নৌকা, বালু কাটা ড্রেজার শ্রমিক, মাটি ও বালু কাটা শ্রমিক মূলত এই চরে তার বড় ক্রেতা। এভাবেই দীর্ঘকাল সে চালিয়ে যাচ্ছে। পদ্মার রূপ পাল্টালেও তুষারের ব্যবসার চেহারা পাল্টায়নি।
ইঞ্জিন চালিত খেয়ানৌকার মাঝি শহিদ। বড়বড় চারটি নৌকা খেয়াপারাপারে নিয়োজিত থাকে। অনেক শ্রেণির মানুষ পাবনা-কুষ্টিয়া যাতায়াতে এই চর বা নদীপথ বেছে নেন। খুব সহজে ও স্বল্প সময়ে এ দু জেলার সাথে যোগাযোগ সম্ভব। নৌকার মাঝি শহিদও তীর ভাঙে, ঘাট ভাঙে, নদী শুকিয়ে যায়, সড়ে যায় নদীর জলধারার সীমারেখা। কিন্তু থেমে থাকেনি শহিদরা। মানুষ পারাপার করাটা এখন তাদের নিয়মিত পেশায় পরিণত হয়েছে।
সাদীপুর পদ্মার ঘাটে কথা হয় ব্যাটারী চালিত অটো রিক্সা চালক জামাল শেখের সাথে। জামাল শেখ প্রতিদিন পদ্মার বুকে বালু মধ্যেই সাদীপুর থেকে কসবা ঘাট পর্যন্ত যাত্রী আনা নেয়া করেন। নদীতে পানি থাকলে রুট পরিবর্তন করে সাদীপুর থেকে পুরাতন টেকনিক্যাল মোড় পর্যন্ত যাত্রীদের সেবা দিয়ে থাকেন।
ঘোড়ার গাড়িওয়ালা ওমর আলী। নদীর ধার দিয়ে বেড়াতে বা ঘুরতে আসা মানুষকে চড়িয়ে বেড়ান। তাদের দেয়া ভাড়ার টাকায় তার সংসার চলে। পদ্মার জল যখন শুকিয়ে যায়। পড়ে যায় বালুচর। তখনই যেন তার ঘোড়ার গাড়িটা নড়ে চড়ে বসে পদ্মার পাড় ঘেঁষে। পদ্মায় জল আসলেই জীবিকার তাগিয়ে গ্রামগঞ্জের ভাড়া মেরে সংসার চালান।
সাদীপুর থেকে কসবাঘাট পর্যন্ত প্রায় দু’কিলোমিটারের মধ্যবর্তী স্থানে সরু ক্যানেল দিয়ে প্রমত্তা পদ্মার জল গড়ায়। মানুষের পারাপারে সেখানে বাঁশের সাকো দেয়া হয়েছে। অনায়াসেই মোটর সাইকেল ও আরোহী এবং পায়ে হাটা মানুষ পার হতে পারেন। আর ব্যাটারী চালিত অটোগুলো খানিকটা ঘুরে বালুর উপর দিয়েই পাড়ি জমান কসবা ঘাটে।
নদী পারাপার হওয়া একাধিক নারী-পুরুষের সাথে আলাপকালে তারা বললেন, সহজ কাজের জ্বালা সবসময় বেশি। কখনো পুরোপদ্মা নৌকায় পার হতে হয়। আবার কখনো খানিকটা পথ পায়ে বা ছোট্ট যানবাহনে আর খানিকটা পথ নৌকা ব্যবহারে। এতো বড় নদীতে ব্রীজ পাওয়াটা স্বপ্নের ব্যাপার। এটা আমাদের কাছে কল্পনা মনে হবে।
বেড়াতে আসার নানা বয়সী মানুষের সাথে আলাপকালে তারা বললেন, সাদীপুর থেকে শিলাইদহ ঘাট দেশের দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বানাতে হবে। যা হয়তো এই জনপদের মানুষের কাছে চিরদিনের স্বপ্ন। তারা জানালেন, পাবনা থেকে এসেছেন। যাচ্ছেন শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িতে।
তবে তাদের অভিযোগ, যাতায়াতে কষ্ট মেনেই চলতে হয়। চর পড়েছে। পর্যাপ্ত বালু। কিন্তু পরিবেশের মারাত্বক ব্যাঘাত করছে মাটি ও বালু ভর্তি যানবাহনগুলো। এতো পরিমান বালু বোঝাই গাড়ী যে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল খুবই কষ্টদায়ক। পাবনা অংশের এক প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি এই বালু উত্তোলন, আমদানী ও বিপননের সাথে সরাসরি জড়িত।
স্থানীয়রা বলছেন, পদ্মার বুক থেকে প্রতিদিন ১০ টি এসকেভেটর মেশিন দিয়ে বালু কাটা হচ্ছে। আর শতাধিক ড্রাম ট্রাক দিয়ে সেই বালু ক্রেতাদের গন্তব্যে পৌঁছানো হচ্ছে। শতাধিক ড্রেজার মেশিন প্রবাহমান নদীর ভেতর থেকে বালু উত্তোলন করছে। আর পরিবহনের জন্য রয়েছে বড়বড় বার্জ কার্গো নৌকা। কাটা হচ্ছে মাটি। চর পড়া জমি থেকে মাটি কেটে কুত্তা গাড়ীর (শ্যালো ইঞ্জিন চালিত বড় ট্রলি) মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে পরিবহণ করানো হচ্ছে।
স্থানীয়দের দাবী, দু’জেলার পারস্পারিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজকরণসহ সরকারি ভাবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলে পদ্মা নদীর এই সীমানা হয়ে উঠবে একটি পর্যটন কেন্দ্র। বিপুল মানুষের উপস্থিতিতে বর্ষা মওসুমে এ অঞ্চলটি হয়ে উঠে প্রাণবন্ত। মানুষের উপস্থিতি এতোটাই যে পা ফেলার জায়গা থাকে না পদ্মাপাড়ে। যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন ও মাটি কেটে নেয়ার ফলে নদীকে সর্বশান্ত করা হচ্ছে। বিনষ্ট করা হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।
লেখক : কবি, কলাম লেখক ও সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব ।