এই লেখাটা আগেও বেশ কয়েকবার প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। কয়েকটা পান্ডুলিপি সাজানোর আশায় এবার মাস কয়েক ধরে আমার পুরোনো কাগজপত্র বেশ ঘাঁটাঘাঁটি চলছে। আর লেখাটা খুঁজে পেলাম ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (কেন্দ্রীয়) কর্তৃক প্রকাশিত মাতৃভূমি শীর্ষক স্মারকগ্রন্থে।
মুজিববর্ষ শেষ হতে চলেছে, তাই ভাবলাম এটি ইউনিকোডে রিটাইপ করে ফেইসবুকে দিলে সেখানেও থাকলো। #
বঙ্গবন্ধুকে সামনাসামনি আমি জীবনে দু’বার দেখি। প্রথমবার ১৯৭২ সালের জুন মাসে। ঐ সময়ে আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায় ছিলাম। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বেড়াতে আসি। উঠি মান্নান ভাইয়ের (সাবেক চেয়্যারম্যান, ইউজিসি, অধ্যাপক আবদুল মান্নান) মুহসীন হলের ৫১৫ নং রুমে। একদিন সকালে খবরের কাগজে দেখি কুসুমিত ইস্পাত গ্রন্থের কবি হুমায়ুন কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রভাষক, আততায়ীর গুলীতে নিহত হয়েছেন (সম্ভবত ৬ জুন)। আমার তখন লেখালেখির অভ্যাস। ফেলো ফিলিং থেকে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে কবি-সাহিত্যিকদের এক প্রতিবাদ সভায় যোগদান করি। তৎকালীন তথ্য মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী সে সভায় উপস্থিত ছিলেন। সে প্রথম আমার ঢাকা তথা বাংলাদেশের তাবৎ কবি-সাহিত্যিকদের দেখার সুযোগ হয়। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান সহ সবাই উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে ঠিক হলো গণভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে সরাসরি প্রতিবাদ জানিয়ে বিচার চাওয়া হবে। বিরাট মিছিল করে গেলাম। প্রথমে গণভবনে ঢোকার অনুমতি নিয়ে গেইটে জটিলতা তৈরি হলো। পরে অনুমতি মিললে গেলাম। গণভবনের সবুজ ঘাসের গালিচা পাতা প্রাঙ্গণে আমরা জোট বেঁধে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সন্ধ্যা প্রায় লাগ লাগ অবস্থা। বঙ্গবন্ধু কয়েকজন সহচর সহ ভিতরের লাউন্জ থেকে গণভবনের অর্ধচন্দ্রাকৃতির বারান্দায় ধীর পায়ে বেরিয়ে আসলেন। সাদা শুভ্র পায়জামা-পাঞ্জাবী পরিহিত ছিলেন। পাঞ্জাবীর ওপর ছিল হাত কাটা কালো একটি কোট (যেটি পরবর্তী সময়ে মুজিব কোট হিসেবে পরিচিতি পায়)। হাতে কালো একটি পাইপ। এত লম্বা দোহারা সুন্দর লোক যেন আমি আর দেখিনি। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কবি নির্মলেন্দু গুণ কাঁপা কাঁপা গলায় তাঁর নরম স্বরের কণ্ঠে বললেন, “বঙ্গবন্ধু, আপনি সবসময় আপনার বক্তৃতায় কবিগুরুর কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন, আজকে একজন কবি নিহত হলেন, আপনার কাছে বিচার চাই।“ কথা বলার সময় গুণদার কন্ঠস্বর যেমন কাঁপছিল, তেমনি তাঁর নিজের বুকের ওপর রাখা হাতটিও। বঙ্গবন্ধু জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, “তোমরা আমাকে নাম দাও, আমি অবশ্যই বিচার করব।” সেই প্রথমবার দেখা।
দ্বিতীয়বার যখন দেখি, তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি সময়। আমি মুহসীন হলে থাকতাম। খুব পেটের পীড়ায় ভুগতাম। তখনকার পিজি হাসপাতালে (এখনকার বঙ্গবন্ধু পোস্ট-গ্রাজুয়েট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি) কর্মরত আমার এক আত্মীয় ডাক্তারের সহায়তায় একদিন সকালে পিজি হাসপাতালের নীচের তলায় পেটের এক্স-রে করার জন্য অপেক্ষমান ছিলাম। হঠাৎ দেখি পুরো করিডোর জুড়ে ত্রস্তব্যস্তভাব। কেন? বঙ্গবন্ধু পিজিতে চিকিৎসারত তাঁর পিতাকে দেখতে আসছেন, যাঁকে এ-মাত্র এক্স-রে রুমে ঢোকানো হয়েছে। সবাই আমরা করিডোরে ভিড় করে দাঁড়ালাম। দেখলাম, সত্যি সত্যি বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রোটোকল সহ আমাদের সামনে দন্ডায়মান। আমার তখন প্রতিবাদী বয়স, মুখ থেকে হঠাৎ বের হয়ে এল, “বঙ্গবন্ধু, আমাদের সিরিয়াল ঠিকমতো মানা হচ্ছে না।” বয়ষ্ক লোক এবং রোগীদের ভিড়ে আমি নিশ্চয় খুব নবীন ছিলাম। বঙ্গবন্ধু যেন সকৌতুকে আমার দিকে চোখ রাখলেন, তারপর সেই বিখ্যাত জলদগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “সব ঠিক হয়ে যাবে।” তারপর তিনি এক্স-রে রুমে ঢুকে গেলেন।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
=শেষ=
২৮ ডিসেম্বর ২০২০