বাঁচতে হলে হাসতে হবে!
জসিম মল্লিক
১
আমার একজন বন্ধু থাকে টেক্সাস। প্রায়ই সে অভিযোগ করে আমি যে ছবিগুলো পোষ্ট করি তাতে হাসি নাই কেনো? তার বলার প্রেক্ষিতে আমি আমার ছবিগুলো চেক করি এবং তার কথা সত্য প্রমানিত হয়। পুরনো ছবি বা নতুন যেগুলো তুলেছি সেগুলোর কোথাও তেমন হাসি নাই। কোনোটায় মুচকি হাসি আছে কিন্তু দন্ত বিকশিত টাইপ হাসি নাই। এমন না যে আমার দাঁত খারাপ। ছোটবেলায় নিয়মিত দাঁতের যত্ন না নিলেও এখন নেই। ভাল পেষ্ট, ব্রাশ ইউজ করি। তাই আমার দাঁত ভাল আছে। আমি যে ছবিগুলো ফেসবুকে পোষ্ট করি সেগুলো কোনো প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যানের তোলা না। সবই পথে ঘাটে, যখন যাকে হাতের কাছে পাই তাকে বলি ছবি তুলে দাওতো। এমনকি অনেক বাচ্চারাও আমার ছবি তোলে। লোকজন আনন্দ নিয়ে ছবি তুলে দেয়। সবাই যে ভাল ছবি তুলতে পারে তাতো না। আর কাউকে না পেলে সেলফিতো আছেই। একবার টরন্টোতে টীমহৰ্টনে কফি খেতে গেছি, একজন সাদা মেয়ে ছবি তুলে দিল আমার। ছবিটা এতো পছন্দ হলো যে অনেকদিন ছবিটা আমার প্রোফাইল পিকচার হিসাবে ছিল। একহাজার লাইক আর পাঁচশর মতো কমেন্টস ছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাই ভাল ছবিটাই দেয়।
অনেকে আছেন বেষ্ট ছবিটা পোষ্ট করে মাথা ঘুরিয়ে দেন অদেখা বন্ধুদের। যখন সামনা সামনি দেখা হয় তখন ভিরমি খাওয়ার অবস্থা হয় অনেকেরই। ছবির সাথে বাস্তবের মানুষের কোনো মিল থাকে না। কখনো ছবির চেয়ে বাস্তবের মানুষটা সুন্দর আবার কখনো তার উল্টোটা ঘটে। তাই ছবি সবসময় সঠিক কথা বলে না। শুধু ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে বন্ধুত্ব করার সিদ্ধান্ত ঠিক নয়। বন্ধুত্ব হতে হবে হৃদয় দেখে, বয়স বা চেহারা দেখে না। সুন্দর মনের মানুষ কিনা সেটা দেখেই হবে বন্ধুত্ব। প্রতারনা, স্বাৰ্থপৱতা বা কারো সরলতার সুযোগ নেয়া কোনো বন্ধুত্ব না। কিন্তু এমনটা ঘটছে আজকাল। অতএব শোস্যাল মিডিয়ায় বন্ধু নিৰ্বাচনে যথেষ্ট সতৰ্ক হওয়ার দরকার আছে।
একসময় আমি নিজেই অনেক ছবি তুলতাম। আমার ছেলে মেয়ের বেড়ে ওঠার কালেৱ অজস্ৰ ছবি আমার কাছে আছে। এখন ওরা এসব ছবি দেখে চমৎকৃত হয়। নিশ্চয়ই ভাবে বাবাটা কত পাগল ছিল! অথচ আমার বাবার কোনো ছবি নাই আমার কাছে। আমার বাবা দেখতে কেমন ছিলেন আমি জানিনা। সেদিন একজন আমার একটা পোষ্টে কমেন্টস করেছেন, “আপনার লেখায় শুধু মায়ের কথা থাকে, বাবার কথা থাকে না কেনো? বাবার সাথে আপনার কোনো স্মৃতি নাই”? কথা সত্য। বাবার সাথে আমার কোনো স্মৃতি নাই। বাবা যখন মারা যান তখন আমার বয়স মাত্র দু’ আড়াই বছর। কেউতো তার ছবি তুলে রাখেনি! ওই রকম পরিবারে তখন ক্যামেরার প্রচলনই ছিল না। বাবার কবরের কাছে যখন যাই তখন মনে মনে বলি, আপনার কোনো ছবি নাই কেনো! আপনার সাথে আমার কোনো স্মৃতি নাই কেনো! বাবা উত্তর দেন, ছবি নাই তাতে কি। আমি সব সময় সাথেই আছি…।
২.
আমার একটা প্যানট্যাক্স কে১০০০ ক্যামেরা ছিল। জাপানী ক্যামেরা। এটা দিয়েই ছবি তুলতাম আমি। একবার ইডেন কলেজের একটা প্রোগ্রামে ছবি তুলতে গিয়ে হাত থেকে ক্যামেরাটা পড়ে নষ্ট হলো। মনে হয় সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখে মাথা ঘুরে গিয়েছিল। আবার একটা কিনলাম একই ক্যামেরা। ঢাকার স্টেডিয়াম মাৰ্কেটেৱ নিচ তলায় মিতালী নামে একটা ইলেট্রনিক্সের দোকান ছিল। ওখান থেকে কিনেছিলাম। তখন ওটাই ছিল ঢাকার একমাত্র নামকরা ইলেকট্রনিক্সের দোকান। সেদিন এক বন্ধুর সাথে মতিঝিল থেকে সেগুনবাগিচা যাচ্ছিলাম। বন্ধু বলল চল হাঁটি। আমরা শৰ্টকাট করতে স্টেডিয়ামের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। আর তখনই মিতালী দোকানটার কথা মনে পড়ল আমার। কত বছর আগের কথা। এখনও কি দোকানটা আছে! চোখে পরলনাতো! শুধু ক্যামেরা কিনেই ক্ষান্ত হইনি, গুলশান এক নম্বরে ফুজি কালারের একটা ল্যাব ছিল। সেখানে ছবি প্রিন্ট করতাম। চারটা বড় এ্যালবামে সেই ছবি এখনও আছে। আমার ছেলে মেয়ের বিয়ের সময় হাজার ডলার খরচ করে প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যানদের দিয়ে ছবি তোলা হলো। অথচ আমার তোলা ছবিই জেসমিন বেশি পছন্দ করল। দুটো ছবি ফ্রেম করে পাশাপাশি সাজানো আছে আমাদের ঘরে। আমার ছেলে মেয়েও সেই ছবি দেখে হ্যাপি। আমি আমার ফোন দিয়ে ছবি দুটি তুলেছি।
প্রতিদিন একটু একটু করে বয়স বাড়ে আমাদের। তিন বছর আগে আমি ল্যাফ্টেনেন্ট কৰ্নেল জমির, রিমি, মাইশা, আৱিবা ও শাহনুর গেলাম ঘুরতে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের নিৰ্ঝৱে।
রিমি আমাকে দেখেই বলল, আপনাকে একটু বুড়া লাগতেছে এবার।
শেষ এক বছর আগে দেখেছে আমাকে।
রাতে গেলাম ধানমন্ডিতে একটা পাৰ্টিতে।
কলি আমাকে দেখে প্রথমেই বলল, তুমি দেখতে কাল হয়ে গেছো জসিম।
একজন বলল, আগের মতো ব্রাইট লাগছে না আপনাকে। বাড়িতে গেলেও এসব কথা শুনতে হয়। রোজি তো সবসময় বলবে চাচু আপনি এরকম হয়ে গেছেন কেনো!
এসব কথা শুনে প্রথমে একটু মন খারাপ লাগে বৈকি। কিন্তু বাস্তবতাকে মেনে নেই। হয়ত অনেকদিন পর দেখে বলে পরিবৰ্তনটা চোখে পড়ে। যারা বলে তাদেরও যে বয়স বেড়ে গেছে সে কথা আর বলি না।
আপাতঃ আমাকে দেখলে অনেক রিলাক্স মনে হবে কিন্তু আমি অনেক স্ট্রেস নিয়ে চলি। মাথার মধ্যে একশটা চিন্তা নিয়ে জীবন যাপনে অভ্যস্ত আমি। যতই বলি আমি নিৰ্লিপ্ত টাইপ মানুষ আসলে তা না। আমি সবার ব্যাপারে সচেতন। আত্মীয়দের নিয়ে চিন্তা করি, বন্ধুদের নিয়ে চিন্তা করি, সন্তানদের নিয়ে চিন্তা করি, নিজেকে নিয়ে চিন্তা করি। প্রতিদিন একগাদা চিন্তার জট নিয়ে ঘুমোতে যাই। আমার ঘুম খুব ভাল তা সত্বেও কখনো কখনো মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। কিন্তু হাসি কেনো থাকবে না! হাসতে ভুলে যাই কেনো?
৩.
অনেকেই বলেছে আমাকে হাসলে ভাল লাগে। একবার একটি দরুণ সুন্দর মেয়ে বলেছিল, আপনি ছবির চেয়ে দেখতে ভাল। শুনে আমার বুকের মধ্যে একশটা ব্যাঙ লাফ দিয়েছিল! গোমরা মুখে আয়নায় নিজেকে দেখেছি। আমাকে কিম্ভুত লাগে। একবার আমি ’হাসি দিয়ে যায় চেনা’ শিরোনামে একটা লেখা লিখেছিলাম। সেখানে অন্যরা কেনো হাসতে ভুলে যায় সে কথা লিখেছিলাম অথচ আমার ছবিগুলোতে হাসি থাকে না প্রায়শঃই। গুলশান ১ এ কিভাহান নামে একটা ক্যাফে আছে। ঢাকা আসলে ওখানে যাই মাঝে মাঝে আড্ডা দিতে। বাসাৱ কাছে তাই। একবার আমরা তিনজন গেলাম কফি খেতে। আমরা গল্পে মেতে আছি এমন সময় একজন তরুন দম্পত্তি ঢুকল। চোখাচোখি হলো আমার সাথে।
তরুন এগিয়ে এসে বলল, আপনি জসিম মল্লিক, রাইট?
আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ। কিভাবে চিনলেন!
সে হেসে বলল, আপনি আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড।
আমি খুশীতে উদ্ভাসিত হলাম। তরুন ’রবি’ তে চাকরি করে আর তাৱ স্ত্রী মানারাত স্কুলে। অফিস শেষে দু’জন এসেছে কফি খেতে।
যাওয়ার সময় তরুন বলল, আপনাকে একটা কথা বলব!
আমি বললাম, সিওর।
সে বলল, আপনার হাসিটা সুন্দর..।
সেবার বরিশাল থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। বিকেলে বন্ধু পান্না উঠিয়ে দিয়ে গেলো স্টিমারে। বরিশাল এক সপ্তাহর মতো ছিলাম। সত্যি বলতে কি বরিশালের প্রতি মায়া আরো প্রগাঢ় হয় আমার প্রতিবার। একেই হয়ত এ্যাট হোম ফিলিংস বলে। শিকড়ের টান। ঢাকা ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। যে ঢাকার জন্য আমি এতো পাগল ছিলাম, ঘর ছেড়েছিলাম, মাকে ছেড়েছিলাম, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি, কখনো খেয়েছি কখনো উপোস দিয়েছি। সেই ঢাকার প্রতি আমি আর তেমন টান অনুভব করছি না। ঢাকা এখন একটি বসবাসের অযোগ্য নগরী। প্রানহীন, অনিরাপদ, স্থবির, স্বাৰ্থপৱ আর পাথুৱে শহর। সেবার পুরো সময়টা পান্নাকে কাছে পেয়েছিলাম। অনেক স্মৃতি আছে আমাদের দু’জনের। ওর নিজের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে আমাকে সময় দিয়েছে। আরো অনেক মধুর স্মৃতিতে ঘেরা বরিশাল।
স্টিমারে উঠে দেখি বেশ ফাঁকা ফাঁকা। যেখানে ফাৰ্ষ্টক্লাসে কেবিন পেতে তদবির পৰ্যন্ত লাগত সেখানে সব কেবিন ফাঁকা পড়ে আছে। এর কারন হলো এখন ঢাকা বরিশাল রুটে অনেক বিলাসবহুল লঞ্চ চালু হয়েছে। লঞ্চের মালিকরা সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআিইডব্লিউটিসির লোকদের হাত করে নিয়েছে। বিমানের মতোই টিকিট চাইলেও টিকিট নাই অথচ সীট খালি পড়ে থাকে। সরকারী প্রতিষ্ঠান ডুবলে কার কি যায আসে! চাঁদপুরে সব প্যাসেঞ্জার নেমে গেলো। আমি একা প্রথম শ্রেনীতে। বাটলাদের তেমন কাজ নাই। আমি ওদের সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। আমি সবসময় স্টিামারে ভ্রমন করি বলে পুরনো স্টাফরা আমাকে চেনে।
তাদেরই একজন নিখিল বলল, স্যার আপনি একটু শুকিয়ে গেছেন। কি সুন্দর আছিলেন দেখতে। সব সময় হাসিখুশী দেখেছি আপনাকে। এখন একটু গম্ভীর।
আমি নিখিলের কথায় হাসি।
সে বলল, অনেক দিনতো বিদেশে থাকলেন এবার চলে আসেন। স্যার দুনিয়াতে হাসি খুশী মানুষের বড় অভাব..।
ঢাকা ৩১ জানুযারী ২০২১