১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাঙালি সংস্কৃতি ও সামাজিকতা থেকে জাতীয়তাবোধ ও জাগরণের বীজ বপন করা হয়। শোষণ-বঞ্চনা ও অপশাসনের ৫৪, ৫৮, ৬২ এর পথ ধরে তা ক্রমেই পোক্ত হতে থাকে। ১৯৬২ তে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মৃত্যুবরণ এবং ১৯৬৩ তে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ইহলোক ত্যাগ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হতাশার জন্ম দেয়।
শরিফ কমিশনের কুখ্যাত শিক্ষা সংকোচন নীতি, আইয়ুব খানের তথাকথিত নির্বাচন প্রভৃতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতর বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ভিতরে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সংস্কৃতি সংরক্ষণের স্বপক্ষে, শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের তীব্র আন্দোলন ও প্রতিবাদ জাতীয়তাবোধকে শাণিত করতে থাকে।
ইতিমধ্যেই ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ হয়। ১৭ দিনের এই যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার অরক্ষিত অবস্থা বাঙালি সমাজে দারুন ভাবে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। অরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীদের জাতীয়তাবোধ তখন জাতীয়তাবাদের পথে হাঁটতে থাকে। এ হাটাকে উস্কে দিয়ে বেগবান করেন ক্রমেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা তখনকার প্রতিবাদী দল আওয়ামী লীগ। এবং তার সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।
বাঙালি জাতিগোষ্ঠী তখন বঞ্চনার বেসাতিতে
ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উষ্ণ চেতনা নিয়ে উম্মুক্ত, উদগ্রীব। বাঙালি মননশীলতার এই আবেশকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেন শেখ মুজিবুর রহমান। তখন তিনি ৪৫ বছর বয়সের পরিনত রাজনীতিক। বাঙালির শোষণ ও বঞ্চনাকেন্দ্রিক যেকোনো ব্যর্থতা থেকে তিনি শানিত হতেন, ঘুরে দাঁড়াতেন। ইতিমধ্যেই তাঁর রাজনৈতিক দেশাত্মবোধের কর্মসূচিতে যুক্ত হলো- ‘পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত কেন।’ এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান ঘুরিয়া দাঁড়াও।’ জাতীয়তাবাদের বঞ্চনানিসৃত এ বক্তব্যে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জনমানুষ দারুনভাবে আলোড়িত হয়। বঞ্চনার বিক্ষুব্ধতা থেকে চেতনা বিস্ফোরিত জাতীয়তাবাদের উন্মেষ-উন্মোচন ঘটতে থাকলো বাঙালির আচার ও মননশীলতায়। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক বঞ্চনাগুলো বাঙালির বোধকে তাড়িত করতে থাকলো ক্রমাগত। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক বৈষম্য বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে দারুন ভাবে উসকে দিতে থাকলো।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ, অরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তান, বাঙালির চেতনায় আঘাত হানলো। আওয়ামীলীগ নেতা মুজিব তা লুফে নিতে চাইলেন। তাসখন্দ চুক্তির বিরোধিতা করতে পাকিস্তানের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো একত্রিত হলো । এরই প্রেক্ষিতে ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের নেতাদের এক কনভেনশন আহবান করা হলো । ৭৪০ জন প্রতিনিধির এ সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে অংশগ্রহণ করলো ২১ জন প্রতিনিধি ।যাদের পাঁচজন ছিল আওয়ামী লীগের। এমন একটি রাজনৈতিক, সামাজিক পরিবেশের অপেক্ষায় তীব্র জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠা তুখোড় নেতা শেখ মুজিব। অনুষ্ঠানের যথার্থ চরিত্র-চিত্রন করেছিলেন তিনি বেশ আগেই। ছয় ফেব্রুয়ারি পূর্বাহ্নেই মুজিব অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এখানে তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। তীব্র প্রতিবাদের মুখোমুখি হন তিনি। প্রায় সব রাজনৈতিক দল এই কনভেকশনে যোগ দিলেও, যোগ দেয়নি পাকিস্তানের উভয় অংশের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি -ন্যাপ এবং এনডিএফ । পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে এই দলগুলোর অবস্থানকে বিশ্লেষণ করা যায় এরকম ঘটনা থেকে।
ইতিপূর্বে পূর্ব-পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী চেতনায় উম্মুখ জনতার সামনে আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘আমাদের বাঁচার দাবি- ছয় দফা- কর্মসূচি’ নামে ছোট পুস্তিকা বিলি করা হয়। পাকিস্তানের আঞ্চলিক জনগণের অধিকার নিয়ে অন্যান্য দল ও নেতৃবৃন্দ তখনো জনগণের চাহিদাকে বাস্তব অর্থে অনুধাবন করতে সক্ষমতা অর্জন করেননি।
আর এজন্যেই শেখ মুজিবের উপস্থাপিত ছয় দফার তীব্র বিরোধিতা করেন তারা। তীব্র বিরোধিতার মুখে বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সম্মেলন থেকে শেখ মুজিব বের হয়ে যান । অত্যন্ত দৃঢ় জাতীয়তাবাদের প্রতীক শেখ মুজিব এখান থেকেই ক্রমান্বয়ে সবাকে ছাড়িয়ে যেতে থাকেন। মুজিবের এই দূরদর্শিতা এবং দেশাত্মবোধের সাথে পাল্লা দিয়ে আর কেউ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।
বিমানবন্দরে পাকিস্তানের সাংবাদিকদের সামনে তিনি ছয় দফা কর্মসূচিকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন। ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের ফেডারেশন সমূহের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি, কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা, মুদ্রা ও অর্থব্যবস্থা, কর ও শুল্ক বিষয়ক ক্ষমতা, বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক বাণিজ্য, এবং ফেডারেশনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্বলিত ছয় দফাকে আকর্ষণীয় করে, প্রতিবাদের ভাষায় তুলে ধরেন তিনি।
ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে ঢাকার সংবাদপত্রে ছয় দফার বিবরণী ছাপা হয়। এভাবেই শুরু হয় ছয় দফার অদম্য, অনিরুদ্ধ, দুর্গম যাত্রা। অত্যন্ত আস্থাশীল, দৃঢ় মানসিকতার শেখ মুজিবুর রহমান ঘনিষ্ঠজনদের কাছে ছয় দফাকে ব্যাখ্যা করেন। আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভা ছাড়াই ২১ ফেব্রুয়ারি ‘ছয় দফা বাঙালির বাঁচার দাবি’ আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এর আগে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সাথে বঙ্গবন্ধু কথা বলেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ ছয় দফার প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন দেয়। এই সমর্থনকে শেখ মুজিবুর রহমান ভালোভাবে কাজে লাগান। কার্যকরী কমিটিতে তিনি বলেন, ‘ছয় দফা জনগণ গ্রহণ করেছে।’ঐতিহাসিক সত্য হল, এই জনগণ ছিল চট্টগ্রামের জনগণ। তিনি এভাবে ছয় দফাকে কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির আলোচনায় জয়ী করান। ইতিহাসের এই পথ ধরেই ছয় দফা প্রথম জনসমর্থন লাভ করে বীরভূমি চট্টগ্রাম থেকে। অবিভক্ত ভারতবর্ষের মহামতি গান্ধীর কথা আবারো প্রমাণিত হয়-‘চট্টগ্রাম টু দ্যা ফোর’ । ছয় দফাকে প্রথম সমর্থন দেয়ার ঐতিহাসিক কৃতিত্ব চট্টগ্রামের মানুষের।
ছয় দফা কর্মসূচির রাজনৈতিক বিস্ফোরণে ভিতরে বাইরে অনেক কিছুই ওলট-পালট হয়ে যায়। এ কর্মসূচির কালবোশেখী তীব্রতা, তীক্ষ্ণতা ও তাণ্ডবে আওয়ামী লীগের প্রবীণ-নবীন অনেক নেতার মাঝেই ভীতিকর তীব্র ক্ষোভ এবং অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। অসন্তোষ ক্ষোভ, বিদ্বেষ ও বিরোধিতার সৃষ্টি করে। এসব বিরোধিতা সত্বেও ১৩ মার্চ ১৯৬৬ সালে আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ছয় দফা কর্মসূচি অনুমোদন লাভ করে। সিদ্ধান্ত হয়, পার্টির পরবর্তী কাউন্সিল অধিবেশনে ছয় দফা কর্মসূচির চূড়ান্ত অনুমোদন নিতে হবে। সে মোতাবেক ১৯৬৬ সালের ১৮ এবং ১৯ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়।
ছয় দফার বিরোধিতা করে পার্টির সভাপতি মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ সভাস্থল ত্যাগ করেন। তার আরো কতিপয় ভক্ত-অনুরক্ত তাকে অনুসরণ করে। নীরব-নিথর হয়ে যায় কতিপয় সদস্য। মুজিব, তাজউদ্দীন এবং আরো কতিপয় দৃঢ়চেতা নেতৃত্তের আপোষহীনতায় সভা চলতে থাকে। সভার কাজ পরিচালনা করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এই সভাতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তাজউদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে আন্দোলনের দিগন্তকে উম্মুক্ত করে দেয়া হয়। এটাই ছিল আওয়ামী লীগের তথা বাংলাদেশের ইতিহাসের ঐতিহাসিক টার্নিং পয়েন্ট এবং পাকিস্তানের জন্য বিপদজনক মোড়।
বাঙালির জাতীয়তাবোধ থেকে জাতীয়তাবাদের উত্তরণে ছয় দফা একটি মহাবিস্ফোরণ। সময়, ক্ষেত্র, উপযোগিতা বিবেচনায় এর আবির্ভাব ছিল অত্যন্ত সুদুরপ্রসারি, দূরদর্শী এবং যথাযথ। বাঙালির গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জাগরণের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বাঙালির স্বাবলম্বীতা এবং স্বায়ত্তশাসনের মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে ছয় দফার আবির্ভাব।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত প্রকাশের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব সকলকে ছাড়িয়ে একক জাতীয়তাবাদী নেতায় পরিণত হন। পাশাপাশি কালবোশেখীর তাণ্ডবের মতই বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার মত ও পথ থেকে ছিটকে পড়ে যায় বিভিন্ন নেতানেত্রী এবং দলমত।
আওয়ামী লীগ অত্যন্ত দ্রুততার সাথে পূর্ব পাকিস্তানে একক জনপ্রিয় জনগণের দলে রূপান্তরিত হয়। ইতিপূর্বেই শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের পত্রপত্রিকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেয়া হয়। সামরিক জান্তা আইয়ুব খান ছয় দফাকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, ধ্বংসাত্বক, যুক্তবাংলা প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের এক নম্বর দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করেন। পাকিস্তানের মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, পিপলস পার্টি ছয় দফাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দেয়।
অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ছয় দফাকে বিভিন্ন মোড়কে বিতর্কিতভাবে উপস্থাপন করে। মাওলানা ভাসানী একে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। ন্যাপ সম্পাদক তোয়াহা একে সিআইএ প্রণীত দলিল আখ্যা দেন। তারা ছয় দফার পাল্টা ১৪ দফা কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। বাম দর্শনের রাজনৈতিক দলগুলো ছয় দফার প্রতি তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করে। এই বিদ্বেষে যেমন ছিল অদূরদর্শিতা, দেশপ্রেমহীনতা, তেমনি ছিল ভয়-ভীতি এবং আত্মসংরক্ষন প্রবনতার চেতনা । ধর্মীয় মৌলবাদী দলগুলোর চেয়েও তীব্র ভাষায় তারা ছয় দফা ও শেখ মুজিবকে আক্রমণ করতে থাকে। ন্যাপের তথাকথিত চীন ও আইয়ুব খান প্রীতি এর অন্যতম কারণ। যা সত্তরের নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধকেও প্রভাবিত করতে চেষ্টা করে। আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের মত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে। পূর্ব পাকিস্তানে আব্দুস সালাম খানের নেতৃত্বে একটি অংশও আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে।
শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার প্রচারণার কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন জেলা সফর করেন।
ছয় দফা ভিত্তিক প্রচারণায় শেখ মুজিবের উক্তিগুলো জাতীয়তাবাদকে দারুণভাবে উসকে দেয়। বাঙ্গালীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘ছয় দফা দাবিতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নাই।’ তিনি বলেন, ‘সকল সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গোটা দেশবাসীর উৎসাহ উদ্দীপনার সাড়া দেখিতেছি-তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে।’ ‘সর্বোপরি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ আমার ছয় দফা দাবি অনুমোদন করিয়াছেন।’ ‘ছয় দফা দাবি আজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় দাবিতে পরিণত হইয়াছে। কিন্তু এও আমি জানি, জনগণের দুশমনদের ক্ষমতা অসীম। তাদের বিত্ত প্রচুর। হাতিয়ার এদের অফুরন্ত । মুখ এদের দশটা, গলার সুর এদের শতাধিক, এরা বহুরূপী। ঈমান, ঐক্য ও সংহতির নামে এরা আছেন সরকারি দলে। আবার ইসলাম ও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে এরা আছেন অপোজিশন দলে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুশমনির বেলায় এরা সকলে একজোট।’.. ‘এদের হাজার চেষ্টাতেও আমার অধিকার সচেতন দেশবাসী বিভ্রান্ত হইবেন না, তাতে আমার কোন সন্দেহ নাই।’শেখ মুজিব যথার্থভাবেই বাঙালিকে উপলব্ধি করেছিলেন, চিনেছিলেন ছিলেন।
এ অবস্থা বেশি দিন টেকসই হয়নি।
৯ মে গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত ২০ মার্চ থেকে ৮ মে ৫০ দিনে ৩২ টি জনসভায় ভাষণ দেন শেখ মুজিবুর রহমান। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অভূতপূর্ব ভাবে ছয় দফা কর্মসূচির প্রতি তাদের সমর্থন ও সাড়া ব্যক্ত করেন। ইতিমধ্যেই ছাত্রলীগ সারাদেশে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছয় দফাকেন্দ্রিক প্রায় পঞ্চাশ হাজার লিফলেট বিতরণ করে। ছাত্রলীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকসহ অন্যান্যরা এ দায়িত্ব পালন করে। ১০ মে ১৯৬৬ পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় সাড়ে তিন হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ইতোমধ্যে আন্দোলনের কর্মসূচিকে গুছিয়ে আনার জন্য গ্রেফতার আন্দোলনের প্রচার-প্রচারণায় কোন ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। মুজিবকে গ্রেপ্তার করার পর ১৩ মে আওয়ামীলীগ প্রতিবাদ দিবস পালন করে। দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেয়া হয়।
শেখ মুজিবের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ছয় দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীর দুর্বার আন্দোলন। যা ইতিহাসের আলোকে ক্ষণস্থায়ী সময়ের ভিতর এক দফায় তীব্রতা লাভ করে। সাত জুনের সর্বাত্মক হরতালে শ্রমিকশ্রেণী প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সারাদেশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল এবং ঢাকায় পুলিশের সাথে জনতার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। হরতালের সময় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গীতে পুলিশ ও ইপিআর- এর গলিতে ১৩ জন নিহত হয়। অনেক লোক আহত হয়। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় বেঙ্গল ব্যাভারেজে চাকুরীরত সিলেটের অধিবাসী মনু মিয়া পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায়।মনু মিয়ার মৃত্যু খবরে শ্রমিকদের ভিতরে প্রচণ্ড বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তাদের সাথে যোগ দেয় সর্বস্তরের ছাত্রজনতা। ঢাকার সকল ট্রেন তেজগাঁও স্টেশনে থামিয়ে দেয়া হয়।
তেজগাঁওয়ে আহাদ এনামেল এন্ড এলুমিনিয়াম কারখানার শ্রমিক, নোয়াখালীর আবুল হোসেন ইপিআরের গুলিতে মৃত্যুবরণ করে। প্রতিটি মৃত্যু মানুষের বিক্ষুব্ধতাকে তীব্রতর করে তুলে। মানুষ দলবেঁধে রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকার শ্রমিক এলাকাতে সন্ধ্যার পরে কারফিউ জারি করা হয়। প্রায় দেড় হাজার জনকে গ্রেফতার করা হয়। ৭ জুনের পুলিশি তাণ্ডবের প্রতিবাদে ৮ জুন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের সভা থেকে বিরোধীদল ওয়াক আউট করে। দৈনিক ইত্তেফাক, টাইমস এবং নিউনেশন পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। কিন্ত কোনকিছুই কোন কাজে আসেনা। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা আর শান্ত হয়নি।
এই ছয় দফার বিক্ষুব্ধ গহবর থেকে জন্ম নেয় ঐক্যের, সংহতির বাঙালি জাতীয়তাবাদ। জন্ম নেয় সর্বদলীয় ছাত্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ ১১ দফা। জন্ম নেয় জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক স্লোগান ‘তুমি কে আমি কে- বাঙ্গালী বাঙ্গালী’, ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা। দিশেহারা আইয়ুব খানের সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন শেখ মুজিবুর রহমানকে। ততদিনে শেখ মুজিবুর রহমান পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা। বঙ্গবন্ধু হয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতৃত্বের আসনে।
জনগণের সর্বাত্মক, স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছয় দফার জাতীয়তাবাদী ভিত্তিকে যে সুদৃঢ়তা দান করে, এই পুঁজিই বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন দুয়ারের ঐতিহাসিক ঠিকানা উন্মুক্ত করে দেয়। ছয় দফা পরিণত হয় এক দফায়। এই মহাবিস্ফোরক ছয় দফার ফসল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচন। পাকিস্তানের দাপুটে শাসকদের দিশেহারা অবস্থা দুর্বার, দুর্বিনীত বাঙালিকে আর পিছনে তাকাতে দেয়নি।
অতঃপর রক্তাক্ত পথ বেয়ে বাঙালির হাজার বছরের কাঙ্খিত স্বাধীনতা।
মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, গবেষক।
০৭ জুন,২০২০ খ্রি ।