ঐতিহাসিক ৭ মার্চ । ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের ৫০ বছর পূর্তি। এ দিন বিকেলে রাজনৈতিক মঞ্চে তাঁর প্রীতিপদ উপস্থিতি। মাইকের সামনে আরামে দাঁড়ান। ঈষৎ সতর্ক হয়ে নিজের ক্ষমতা ও সীমা বুঝে ভাষণ দেন। যে পর্যন্ত বলা সম্ভব তার বেশিই যেন বলে ফেলেন। জবরদস্তির শাসন ব্যবস্থা থাকাকালে তিনি মারাত্মক ঝুঁকি নেন। এক হাজার একশ শব্দের এই ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালি জীবনে প্রাত্যহিক শ্রবণযোগ্য। যা বিবৃতিমূলক। আধুনিক। রাজনৈতিক কবির বীররসের গদ্য মহাকাব্য। রাজনৈতিক পরিবেশ অনুযায়ী শব্দ চয়নে এ ভাষণ প্রেরণা শ্রাব্য হয়ে ওঠে। মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে যাঁর ৩০ বছর কেটেছে রাজনীতির রনাঙ্গণে। ঘাড়ে মামলা ঝুলেছে ১৮টি। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছেন বার দুয়েক। দফায় দফায় কারাবাসে গেছে বার বছরেরও বেশি সময়। এতে জীবনের উজ্জল সময়ের সবটুকু আয়ুক্ষয় হলেও তিনি দমে যাননি। নেতা-কর্মি এবং সমর্থকদের কাছ থেকে পেয়েছেন অপরিমেয় প্রেরণা। যিনি স্বপরিবারে রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে শোধ করে গেছেন রক্ত ঋণ। এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা। তিনি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশবাসীর কল্যাণে তিনি যা দিয়ে গেছেন তার দাম অপরিসীম। তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন আপসহীন। পরোয়া করেননি সামরিক শাসন। তাই নির্ভীক কন্ঠে তর্জনি উঁচিয়ে দিয়ে গেছেন সম্মোহক ভাষণ। যার উচ্চরিত বাক্যগুলি যেন এক একটি নির্দেশ নামা। সামরিক শাসনের বেলুনে এ ভাষণের এক একটি শব্দ যেন উপযুক্ত আলপিন। মঞ্চে দাঁড়ানো এই নেতার দেহজ ভঙ্গিমায় শিকল ভাঙার গান, গভীর আবেগের চিন্তাক্লিষ্ট মুখজ অভিব্যক্তি। স্বপ্নঘন দুটি চোখ।
দৃষ্টিতে তাঁর ঝাঁঝ ও অভিভাবক সুলভ কমনীয়তা। শক্ত চোয়াল। মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘোরানর ভঙ্গিতে চাওয়া ও লক্ষ্য প্রকাশ করতে থাকেন ধাপে ধাপে। দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ৭ মার্চে ১৮/১৯ মিনিটের যে ভাষণ তিনি দিয়ে গেছেন তার শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। উদয় ঘটায় সক্রিয় রাজনীতি বোধের। তাঁর নেতৃত্বেই আন্দোলন ক্রমাগত অগ্রগতি ঘটতে থাকে। বাংলার রাজনৈতিক বায়ুমন্ডল হয়ে ওঠে মেঘময়। স্বাধিকার আন্দোলনের উদ্যোনে লাল গোলাপের মতো ফুটতে থাকে তরুণ যুবকেরা। তাঁরা দেশ প্রেমের টানে ঝাঁপ দেন দাবি আদায়ের কর্মসূচিতে। বঙ্গবন্ধুর নির্মল আদর্শের হাওয়ায় মহিমান্বিত হতে থাকে আওয়ামী লীগ। দলীয় কর্মকান্ডে কোথাও দুর্বোধ্যতা ছিল না। চাতুর্যতা ছিল না।
কালজয়ী এ ভাষণের গভীরতা ও ব্যাপ্তি যেন চিরকালের। তাঁর বক্তব্য নিজস্ব গুণেই বিভাসিত। সুগভীর ভাবে সমাদৃত। সু-প্রসারিত। যা ভৌগলিক সীমায় আবদ্ধ থাকেনি। তাই প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। মেমোরি অবদ্য ওয়াল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিষ্টারে যা সংরক্ষিত। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর প্যারিসে ইউনেস্কোর পরিচালক এই ভাষণটিকে দলিল হিসেবে স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন।
বাঙালি জাতির গৌরব বৃদ্ধি করা বঙ্গবন্ধুুর প্রেরণাময় এ ভাষণ নিপীড়িত নাগরিকদের মুক্তি সনদ স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ প্রদর্শক। স্বাত্তিক ও বীররসের এ ভাষণ শুনেই দেশবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্ধুদ্ধ হন। শেখ মুজিবের ছিল অসীম সাহস। নির্ভীক দৃঢ়তা। অনন্য সাধারণ বাগ্মিতায় শ্রোতারা আকৃষ্ট হয়েছেন। কষ্টসাহিঞ্চু এই নেতার ছিল হৃদরোগ। তারপরেও তিনি মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে রাজনীতি করেছেন। কারাবাস, নির্যাতন কোন যন্ত্রনাই তাঁকে দাবায়ে রাখতে পারেনি।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করে হানাদার বাহিনির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিতে আহবান জানান। বাঙালি জাতিকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে সক্রিয় ছিলেন। বিনা বিচারে একজন নেতাকে বন্দি করে রেখে তাঁর পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে শাসকেরা দিয়েছে মানসিক যন্ত্রণা। ক্ষমতা ও স্বার্থ লাভের জন্যে তৎকালীন শাসক সম্পূর্ণ বিবেকহীন হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর শেষ কারাবাস ঘটে ১৯৭১ সালে। এ বছর ২৬ মার্চ হানাদার বাহিনি তাঁকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পকিস্তানে। করাচির ফয়সালাবাদের একটি কারাগারে তাঁকে আটক রাখা হয়। পরে মিয়ানওয়ালি কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ইতিহাসে আরও উল্লেখ রয়েছে, পাকিস্তান সরকার সামরিক গোপন আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু করে। ১১ আগষ্ট প্রহসনমূলক এই বিচারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করায় তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশের প্রবল প্রতিবাদের মুখে পাকিস্তান সে রায় বাস্তবায়নের পথে এগোয় নি। কিন্তু কারা অভ্যন্তরে খনন করা হয়েছিল কবর। তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকারের পর বঙ্গবন্ধুকে সমাহিত করার জন্যই সবকিছু তৈরি করা হয়েছিল। সেই কবর দেখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার লাশটি বাংলার মানুষের কাছে পৌছে দিও। যে বাংলার আলো-বাতাসে আমি বেড়ে উঠেছি। সেই বাংলায় আমি চির নিদ্রায় শায়িত থাকতে চাই।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ফাসির মঞ্চে যাবার আগে আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ। বাংলা আমার ভাষা।’
কারাগারে ২৯০ দিন কাটানোর পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি তিনি মুক্তি পান। মুক্তির প্রাক্কালে জুলফিকার আলী ভুট্টোই তাঁকে ফ্রি ম্যান হিসেবে ঘোষণা দেন। ছাড়া পেয়ে তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডনে যান। সেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত শেষে সংবাদ সম্মেলন করেন। এখানে তিনি সকল দেশের প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার অনুরোধ জানান। ফেরার পথে দিল্লিতে যাত্রা বিরতি করেন। বিমান বন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভিগিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে স্বত:স্ফূর্ত ভাবে স্বাগত জানান।
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভিগিরি বঙ্গবন্ধুকে জাতিরজনক বলে অভিহিত করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার আনন্দ বঙ্গবন্ধু বিজয়ীর বেশে ফিরিয়াছেন।
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করলে তাঁকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। দর্শনার্থীদের মধ্যে আশ্চর্যরকম উদ্দীপনা সঞ্চার হতে থাকে। মুক্তির খবর প্রচারের পরপরই দেশে আনন্দের বান ডাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের হতে তখনও হাতিয়ার। গুলি ফুটতে থাকে আতশবাজির মতো। বিমান বন্দর থেকে তিনি সরাসরি চলে যান রেসকোর্স ময়দানে। লাখ লাখ জনতার সমাবেশে কান্নাজড়িত কন্ঠে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম। বাংলার মাটিকে দেখলাম। বাংলার আকাশকে দেখলাম। বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই। আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি।’ এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ১৯৭০ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিক পালন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন, বাংলাদেশ। তিনি বলেন, আমাদের আবাস ভূমির নাম পূর্ব পাকিস্তান নয়, হবে বাংলাদেশ।’ ১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে প্রথমবারের মতো ‘জয়বাংলা’ শব্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ভাষণ শেষ করেন। সেই থেকে নজরুল কাব্যের এই জয়বাংলা শব্দ তিনি ভাষণ শেষে সমাপ্তি সূচক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত “আমার সোনার বাংলা” জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষিত হয়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক ।