২০০৩ সাল আমার জীবনে অবিস্মরণীয়। এই বছর জীবনের উজ্জ্বলতম একটি কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আর সেটা হল বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে সাক্ষাৎ, একসঙ্গে অনুষ্ঠান করা এবং তাঁকে টোকিওর বিখ্যাত কয়েকটি জায়গা দেখানো।
অনুষ্ঠান বলতে টোকিওতে প্রবাসী বাঙালির প্রথম বাংলা কবিতা উৎসবের আয়োজন। আয়োজন করেছিল “আড্ডা টোকিও: সৃজনশীল ও মুক্তচিন্তা বিষয়ক পাঠচক্র” নামে একটি সংগঠন, যা ১৯৯৪ সালে আমরা কতিপয় গঠন করেছিলাম যেমন, প্রবাসী কবি ও সংস্কৃতিকর্মী মোতালেব শাহ আইউব প্রিন্স, কবি, গল্পকার ও সাংবাদিক সজল বড়ুয়া, লেখক ও সাংবাদিক পি আর প্ল্যাসিড, সমাজসেবী হারুনুর রশিদ, কবি বিপুলকৃষ্ণ দাস, লেখক ও সাংবাদিক আরিফুর রহমান মাসুদ ববি, কবি, সাংবাদিক ও গবেষক বাবলু রহমান এবং আমি প্রধানত। আমরা সিদ্ধান্ত কবিতা উৎসবে কবি সাইফুল্লাহ্ মাহমুদ দুলালকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। যথারীতি আমন্ত্রণ জানানো হল, কিন্তু তিনি আসতে পারেননি, তাঁর পরিবর্তে এলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। তাঁর স্পনসর হল এবং সমস্ত ব্যয়ভার বহন করল সংগঠনের পরিচালক প্রিন্স।
একদিনের অনুষ্ঠান জমজমাট হয়েছিল। কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ছাড়াও বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত প্রবাসীরা যোগদান করেছিলেন সারাদিনব্যাপী অনুষ্ঠানে। আমি এই উপলক্ষে তিন জন বিশিষ্ট জাপানি নাগরিককেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, এঁরা হলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড.পেমা গিয়ালপো, লেখক, গবেষক এবং প্রাক্তন আইবিএম কর্মকর্তা ওওৎসুকা তোশিআকি এবং প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী তোজো হিদেকির নাতনি পরিবেশ সংরক্ষণ-সংগঠক, ইতিহাস গবেষক ও গ্রন্থকার তোজো ইউকো। তিন জনই রবীন্দ্রভক্ত এবং বাঙালিপ্রেমী। তাঁরা গভীরভাবে বিগত শত বছরের জাপান-বাংলা ভাববিনিময় সম্পর্কের ইতিহাস জানেন এবং বোঝেন। ফলে প্রধান অতিথি কবি নির্মলেন্দু গুণ অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন তাঁদের সান্নিধ্য পেয়ে। অনুষ্ঠানের মাত্রা যে ছিল ভিন্ন সেসম্পর্কে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন, আবেগে আপ্লুত হয়েছিলেন। সংগঠনের পরিকল্পক কর্মী হিসেবে আমার পরিকল্পনা যে সফল হয়েছিল তা আর না বললেও চলে। গুণদা স্বদেশে ফিরে গিয়ে সুদীর্ঘ একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন এই অনুষ্ঠান নিয়ে অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ২০০০ ম্যাগাজিনে। অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমরা একটি স্মরণিকা প্রকাশ করেছিলাম বিশেষ কালারে।
শ্রদ্ধেয় গুণদার সঙ্গে সেই আমার প্রথম প্রত্যক্ষ পরিচয় ও সাক্ষাৎ। কলেজজীবনে যাঁর দুর্দান্ত সব কবিতার পাঠক ও ভক্ত হয়েছিলাম। জাপানে সপ্তাহখানেক অবস্থানকালে আমরা তাঁর সঙ্গে আড্ডা ও খানাপিনা করেছি বিপুল এবং নিয়াজ আহমেদ জুয়েলের বাসায় রাত জেগে। সে কি তুমুল আড্ডা! সাহিত্য, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, বঙ্গবন্ধু এবং জাপান-বাংলা সম্পর্ক নিয়ে। সম্প্রতি প্রবাসে আমরা কী কী বিষয়ে লেখালেখি করছি জানতে চাইলেন। আমরা বললাম। শুনে আমাদেরকে উৎসাহ দিলেন।
সময় বের করে তাঁকে নিয়ে গেলাম উয়েনো উদ্যানে যেখানে ১৯১৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এক ঐতিহাসিক সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছিল কানয়েজি বৌদ্ধ মন্দিরে। গুণদা অত্যন্ত রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষ, রবীন্দ্রনাথ-জাপান সম্পর্ক নিয়ে আগ্রহভরে নানা তথ্য আমার কাছ থেকে শুনলেন। উদ্যানে ঘুরতে ঘুরতে বললাম, এই উদ্যানের পূর্বদিকে একটি পুকুর রয়েছে যার নাম শিনোবাজুইকে, তার কাছেই রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালে প্রথম জাপানে এসে বন্ধুবর জাপানের আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকানের বাসভবনে দিন দশেক আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তারপর য়োকোহামা বন্দরনগরে অবস্থিত নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অমরাবতী সানকেইএন বাগানবাড়িতে প্রায় তিন মাস অবস্থান করেন। এই তথ্য জেনে তিনি অত্যন্ত মুগ্ধ হন।
এরপর তাঁকে ট্রেনে চড়িয়ে নিয়ে যাই টোকিওর ব্যস্ততম শহর শিনজুকু-তে, যেখানে “নাকামুরায়া” নামে একটি শতবর্ষী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানে জাপান প্রবাসী মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু থাকতেন এবং জাপানে প্রথম “ইন্ডিয়ান কারি”র একটি দোকান “ইনদো নো মোন” তথা “ভারতীয় তোরণ” নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, এই নাকামুরায়া প্রতিষ্ঠানের মালিক সোওমা আইজোওর জ্যেষ্ঠকন্যা সোওমা তোশিকোকে রাসবিহারী বিবাহ করেছিলেন। তিনি আজ জাপানে কিংবদন্তিতুল্য একজন বাঙালি। সেই নাকামুরায়ার সামনে একটি ছবি তুলি আমি, সঙ্গে তাঁর বিপুল। রাসবিহারীর কাহিনি অনেক দীর্ঘ, তবু সংক্ষেপে তাঁকে আমি বলার চেষ্টা করেছি ট্রেনের মধ্যে, শুনে তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন।
সেদিন শিনজুকু শহর থেকে পাতাল রেলে চড়ে গেলাম হিগাশি কোওয়েনজি স্টেশনে। সেই স্টেশনের কাছেই রয়েছে বিখ্যাত রেনকোওজি বৌদ্ধ মন্দির। যেখানে ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে নেতাজির চিতাভস্ম সংরক্ষণ করা হয়েছিল বলে জাপানিভক্তরা বিশ্বাস করেন। এখানে ১৯৯০ সালে নেতাজির ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে একটি আবক্ষ স্মারক ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। সেই মন্দিরে গিয়ে গুণদা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। জাপানের সঙ্গে নেতাজির সম্পর্ক নিয়ে অতিসংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের প্রধান মন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকির সঙ্গে যৌথভাবে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন নেতাজি স্বাধীনতার জন্য। গুণদা নেতাজির দারুণ এক ভক্ত। এবার তিনি বুঝতে পারলেন কেন আমি তোজো হিদেকির নাতনিকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম! যাহোক, নেতাজির ভাস্কর্যের সামনে তাঁর একটি ছবি ক্যামরায় ধারণ করলাম। যাকে বলে ঐতিহাসিক এক ছবি!
উল্লেখ্য যে, এই অনুষ্ঠান, আয়োজক আড্ডা টোকিও এবং অতিথি কবি নির্মলেন্দু গুণকে নিয়ে একটি অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছিল। প্রবাসী সাংবাদিক মন্জুরুল হক দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় একটি ফিচার লিখেছিলেন যা ছিল ঈর্ষাজনক, অর্থহীন এবং অব্যশই নিন্দনীয়। এতে করে গুণদা প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ক্রোধ প্রকাশ করেছিলেন। দুজনের মতাদর্শের ভিন্নতাই ছিল এই ঘটনার মূল কারণ যা আমরা পরে জেনেছিলাম যখন গুণদা দ্বিতীয়বার জাপানে এসেছিলেন তখন।
গুণদার কাছে নানাভাবে কৃতজ্ঞ । তাঁর জন্মস্থান ময়মনসিংহের বারহাট্টা গ্রামেও গিয়েছি, আতিথ্যলাভ করেছি। প্রথম জাপান ভ্রমণের সময় তাঁকে আমার উপন্যাস “তালা”র পাণ্ডুলিপিটি দিয়েছিলাম। সেটা তিনি সাপ্তাহিক ২০০০ এর দ্বিতীয় দফা ঈদ সংখ্যায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। উপন্যাসটির বিষয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর চিত্রায়ণ কুমিল্লার শতবর্ষী মহেশাঙ্গন। মানুষ দীর্ঘায়ু লাভ করে খুব কম, কিন্তু ক্যামরা কিছু ছবিকে দীর্ঘায়ু দিয়ে থাকে। ছবিতে গুণদাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতোই লাগছে দেখতে। পথে-পথে এবং জনারণ্যে জাপানিরা বিস্মিত হয়েছিলেন এযুগের “তাগো-রু” তথা “টেগোর”কে দেখে! এই অভিজ্ঞতা চিরছাপ ফেলেছে আমার মনে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও গবেষক
টোকিও ১৫.৪.২০২১