” চিরঞ্জীব ” ( আহমেদ তফিজ উদ্দিন)
১৯৮৪ সাল । আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। মুটামুটি লেখাপড়া, টুকটাক খেলাধুলা আর গান গাওয়া এই হলো কৈশোরের প্রেম। সকল ক্ষেত্রে একজন ওস্তাদের কমান্ড ফলো করাই মালিফা সহ আশপাশের দু-চারটা গ্রামের সমবয়সীদের যেন অবধারিত কর্তব্য । তিনি হলেন মনিরুল ইসলাম (তরুন)। অন্য ধরনের মানসিক এবং আত্মিক সম্পর্কের মাধ্যমে আমাদের গ্রন্থিতে বেঁধে রাখার অনবদ্য কৌশল জানেন তরুন । আমাদের বললেন, স্যার আসবেন । সবাই থেকো।আমরা প্রায় ৩০/৩৫ জন কিশোর ছাত্র। একটা পুরোনো মটর সাইকেল নিয়ে আসলেন স্যার ।
বললেন-” তরুন ” বৃষ্টি হতে পারে।চলো বারান্দায় বসি । মালিফা হাইস্কুলের বারান্দায় ।
আমাদের গুরু “তরুন” সঞ্চালক। কেউ কেউ বক্তব্য দিচ্ছে। হঠাৎ স্যার আমাকে বললেন , তুমি কিছু বলো । কিংকর্তব্য বিমূঢ় আমি । গলাটা শুকিয়ে গেল । তবু কিছু বললাম। এরশাদ জমানা । আমার কথার রেশ ধরে বক্তব্য রাখলেন স্যার । আহমেদ তফিজ উদ্দিন মাস্টার। গর্বিত হলাম। তরুন কে বললেন এদের নিয়েই সংগঠন তৈরি কর। স্যার আর তরুনের নেতৃত্বে জীবনের প্রথম স্লোগান- ” জয় বাংলা ” !!
আমার ভাই মুন্নাফ মাস্টার স্যারের অকুতোভয় সৈনিক। স্যার মাঝে মাঝে আসতেন, আমাদের বাড়িতে মটর সাইকেল রেখে গ্রামের কর্মীদের সাথে দেখা করতেন। কী নিবিড় সম্পর্ক!প্রত্যেকের নাম মুখস্থ । ১৯৯৪ সালে মালিফা স্কুলের দোতলায় সেলিম রেজা হাবিবের নির্দেশে তার কুখ্যাত সন্ত্রাসী বাহিনী রাতের বেলায় আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে শারীরিক নির্যাতন করে। সেদিন তরুন বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে আমার জীবন রক্ষা করলেন।
স্যার এলেন আমাকে দেখতে। স্যার কাঁদছেন,কথা বলতে পারছেন না। একজন সাধারণ কর্মীর জন্য কী দরদ! কিছুদিন পর আমাদের ধানের
স্কীম বেদখল করা হলো। আবার মালিফা এলেন স্যার । ওদের অনুরোধ করলেন, ‘শাস্তি দিতে চাও আমাকে দাও
ওদের এতবড় ক্ষতি করোনা।’চিড়ে ভিজল না । হৃদয় ভরা ব্যথা নিয়ে ফিরে গেলেন স্যার,কী কর্মী বান্ধব নেতা!!তরুনের বিয়ে । স্যার ভীষণ অসুস্থ। ইন্ডিয়া যেতেই হবে। একদিন দেরি করে নবদম্পতি কে আশির্বাদ করে তারপর গেলেন ইন্ডিয়া। কী পিতৃস্নেহ!
অমলিন কত স্মৃতি —–
১৯৯৬ নির্বাচন। ভোটের গান লিখেছি। স্যার শুনলেন । উনার গাড়ীতে নিয়ে যেতেন । ঐ নির্বাচনে সকল জনসভায় গান গাওয়া ছিল প্রচারনার অন্যতম অনুষঙ্গ। জীবনে অনেক ডাকসাইটে নেতা দেখেছি । বন্ধুরাও কেউ এমপি হয়েছেন কিন্তু তাঁর মত তৃণমূল নেতা বিরল।পোশাকে,
আচরণে , চিন্তাচেতনায় এমন মাটি আর মানুষের নেতা হয় কি ? যেখানেই গেছেন খাবার সময় হলে অসংকচে চেয়ে খেয়েছেন । যা দিয়েছে তাই খেয়েছেন । মহানুভবতার ঔদার্যে কত সহজেই সকলকে আপন করে নেবার এমন সম্মোহোনী ক্ষমতা কজনের?
এত সাধারণ জীবনাচার কিন্তু কী অসাধারণ পান্ডিত্য এবং পরিণামদর্শীতা ! কত শিক্ষিত বেকার যুবকদের ডেকে নিয়ে চাকরি দিয়েছেন । নিজেও শিক্ষকতা করেছেন । ছিলেন রাজনীতির শিক্ষক আর তাই হয়ে উঠেছিলেন সকলের প্রিয় তফিজ স্যার । অংকে জাহাজ তাই তাঁর লেখা জ্যামিতি বই শিক্ষাবোর্ড পাঠ্য হিসাবে অনুমোদন দিয়েছিল। কত স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠায় পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তিনি। আমি কলেজে চাকরি করতে চাইনি কিছুতেই । উনিও আমাকে ছাড়লেন না কিছুতেই। তরুনের সাথে, জিলাল ভায়ের সাথে পরামর্শ করে নিয়ে গেলেন সাতবাড়িয়া কলেজে। ক্লাসে পাঠিয়ে দিয়ে অফিসে বসে রইলেন । শেষমেষ তাঁর কথাই অবধারিত। আজকে আমি সাতবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজের প্রিন্সিপাল । ভাগ্য মানি কিন্তু এও জানি মরহুম আহমেদ তফিজ উদ্দিন স্যার ভাগ্যকে প্রশস্ত করেছেন।
২৮ জুন ১৯৯৮ খুব কেঁদেছি,মানুষ কেঁদেছিলেন। আহমেদ তফিজ উদ্দিন এমপি মারা গেছেন । হেলিকপ্টারে কলেজ মাঠে এসে নামলেন প্রিয় শিক্ষক গণমানুষের প্রিয় নেতা, আমৃত্যু সুজানগর থানা আওয়ামী লীগের সম্মানিত সভাপতি, ৬৯ পাবনা-২ মাননীয় এমপি মরহুম আহমেদ তফিজ উদ্দিন মাস্টার । শোকের নিস্তব্ধতা! কর্মী, ভক্ত, ছাত্র জনতার চোখের জলে সিক্ত হলো হৃদয় , বুকে অভিভাবক হারানোর শুন্যুতা । আকাশে মেঘ, বৃষ্টি ছিল সেদিন। হয়ত আকাশও কেঁদে ছিল ! ওপারে অনেক ভালো থেকো আমার স্যার ,প্রিয় নেতা আমাদের অভিভাবক । আজ তুমি নেই ! কিন্তু – তুমি আছো আমাদের মাঝে অমর হয়ে । তুমি শ্বাশ্বতিক, তুমি চিরঞ্জীব। আমিন। ।
লেখক : অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল বাছেত বাচ্চু
সাতবাডীযা ডিগ্রি কলেজ
সুজানগর, পাবনা।
28-06-2020