আমরা যাঁরা ইতিহাসের ছাত্র, প্রত্নতত্ত্বকে উপেক্ষা করতে পারিনা, সুযোগ পেলেই ছুটে যাই প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনের কাছে। বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যেগুলো পাওয়া গেছে তার মধ্যে পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় এগুলোর কথাই প্রথমে মনে পড়ে। মহাস্থানগড়ের প্রতি টান আমার সেই ছেলেবেলা থেকেই। আমার শৈশবের দিনগুলো কেটেছে বগুড়ার শিবগঞ্জে। মহাস্থানগড়ের পাশ দিয়ে শিবগঞ্জে অসংখ্যবার যাতায়াত করেছি। আজ এই মধ্যবয়সে এসেও মহাস্থানগড়ের প্রতি অমোঘ টান বরাবরের মতো রয়েই গেছে। হয়ত সেটা ইতিহাসের ছাত্র হবার কারণেই। উত্তরবঙ্গে বেড়ানোর প্রস্তাব পেলাম প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের উপ পরিচালক ড. আতাউর রহমানের কাছ থেকে। আমার পরিবারের সদস্যরা মেরী, আনিকা ও মোহাইমেন এক বাক্যে রাজী হয়ে গেল। ব্যস আর কি! যেমন ভাবা তেমন কাজ। গত বছরের ঈদের পরের দিনই আমরা সকলে মিলে বেরিয়ে পড়লাম ইতিহাসের অনুসন্ধানে।
বেলা তিনটা নাগাদ আমরা পৌঁছালাম মহাস্থানগড়। কিন্তু আমরা যখন পাবনা থেকে বগুড়ার পথে যাচ্ছি, তখন দু’দিকে একের পর এক পেরিয়ে যাচ্ছিল উত্তরবঙ্গের অজানা অচেনা গ্রাম। এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে চায়ের পর্ব সারলাম । ড আতাউর শুরু করলো পটাপট কিছু সেলফি । চায়ের আড্ডাতেই রাতা রহমানের প্রশ্ন মহাস্থানগড় আমরা কেন যাচ্ছি। প্রশ্নের ধরণ শুনে আতাউর বিরক্তি ভাব প্রকাশ করলেও আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম মহাস্থানগড় হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন নগরী। বগুড়া শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে গেলেই এই শহরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। মোহাইমেন এক ধাপ এগিয়ে বলতে লাগল কত বছর আগের এটা আর তখনও কি এর নাম মহাস্থানগড় ছিল? প্রত্নতত্ত্বের মানুষ ড. আতাউর মনে হয় দাপ্তরিক কোন প্রকাশনার আদেশ পেল। ঝটপট করে বলতে লাগল আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের বা বলতে পারো যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও আগে এখানে সভ্য জনপদ বা শহর গড়ে উঠেছিল। রাতা, মোহাইমেন, আনিকা সবাই অবাক হয়ে গেল! তাদের বাড়ীর কাছেই এতো পুরোনো দিনের ইতিহাস রয়ে গেছে তা ওরা জানতোই না।
পৌণ্ড্রবর্ধনের পথের বাঁকে বাঁকে শুধুই ইতিহাস আর প্রত্ন স্থাপনা। রয়েছে দিঘিও। মন্দিরগুলোতে পাওয়া যায় টেরাকোটার কাজ। প্রাচীন যুগের মন্দির আর মধ্যযুগের মসজিদের পোড়া ইট পাথর যেন ইতিহাস ফিসফিস করে। আতাউর বলতে লাগল একদা পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল পুণ্ড্র। পুণ্ডবর্ধন বলতে বর্তমান রাজশাহী বিভাগের সমস্ত জেলাগুলোকেই বোঝাত।
প্রাক্ মৌযর্দের আগে থেকেই এখানে মানুষ বসবাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। পরাক্রমশালী মৌয, গুপ্ত এবং পালরাজাদের প্রাদেশিক রাজধানী পরবর্তীকালে হিন্দু সামন্তরাজাদের রাজধানী হিসেবে ব্যবহ্নত হয়ে এসেছে। এ যেন চোখের সামনে জীবন্ত ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। মৌর্য, গুপ্ত, পাল রাজাদের কথা – এতদিন যা পাঠ্যবইয়ে পড়েছে, তা চোখের সামনে দেখতে পেয়ে রাতা, অথৈ, আনিকা, মোহাইমেন সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। এটা তো একটা দারুণ ব্যাপার অথৈ বলে উঠল, আমি মনে করতাম মৌর্যদের ইতিহাসের সীমাবদ্ধতা শুধু উত্তর ভারতেই । অথৈ ঠিকই বলেছে পাটলিপুত্রকে কেন্দ্র করেই মৌর্যরা প্রাচীন ভারতে বড় ধরণের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। পুণ্ডনগর থেকে এর দুরত্ব খুব বেশি দুরে ছিল না। আমরা যদি মানচিত্রের দিকে তাকাই তাহলে এটি আরো স্পষ্ট হবে। বর্তমানে মহাস্থানগড় যে জেলায় সেটি বগুড়া। এই বৃহত্তর বগুড়ার সাথেই রয়েছে পশ্চিম বাংলার মালদা জেলা। এরই সংলগ্ন বিহার প্রদেশ। আবার এটি যেমৌর্যদের অধিকারভূক্ত ছিল তার বড় প্রমাণ ব্রাক্ষ্মী লিপি। আনুমানিক তৃতীয় খ্রিস্ট পূর্বাব্দে রচিত মহাস্থান ব্রাক্ষ্মী লিপি হচ্ছে বাংলার প্রাচীনতম লিপিতাত্ত্বিক দলিল। কিন্তু এই লিপিতে কী লেখা আছে বা এটি কে আবিস্কার করেন এ সকল প্রশ্ন ওদের মনে ঘূরপাক খেতে থাকে। আতাউর সাহেবও নাছোরবান্দা। তিনি মনে হয় ওদের প্রত্নতত্ত্ব শিক্ষা দিয়ে ছাড়বেন। আতাউর সাহেব বলতে থাকেন- মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই পাথর বা ধাতুর পাত্রে খোদাই করে লিখতেন। যেহেতু পাথরের গায়ে লেখা হত এবং পাথরের প্রতিশব্দ শিলা একারণেই এগুলোকে শিলালিপি বলা হয়। মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত শিলালিপিটিকে ব্রাক্ষী লিপি বলা হচ্ছে কারণ এই শিলালিপিতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা হল ব্রাক্ষী লিপিতে লেখা। স্বপ্না এতোক্ষন চুপ করে শুনছিল, কিন্তু এবারে সে বলতে লাগল ব্রাক্ষী লিপি প্রাচীন যুগের একটি পুরনো লিখন পদ্ধতি। খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে সাধারণত এ লিপি ব্যবহার হতো। তবে এই লিপিটি উপমহাদেশে বেশি পরিচিতি লাভ করেছে সম্রাট অশোকের সময় থেকে। তিনি প্রজাদের মঙ্গলের চিন্তা করতেন। প্রজারা যাতে শান্তিতে এবং ধর্মপথে থাকেন একারণে পথের ধারে তিনি পাথরে খোদাই করে শান্তির বাণী লিখতেন। আজকালকার দিনের বাচ্চারা ছোট হলেও কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন করে বসে। মোহাইমেনও স্বপ্না আন্টির দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে পুরনো দিনের সব কথাই কি তাহলে পড়তে পারা যায় । না সব লেখাই পড়তে পারা যায়নি। আতাউর বলতে থাকল এই যেমন ধরো হরপ্পা সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার এখনো সম্ভব হয়নি।
মহাস্থান ব্রাক্ষী লিপিতে কি লেখা আছে এতোক্ষণ চুপচাপ থাকার পর অথৈর জিজ্ঞাসা?
তোমরা তো আগেই জেনেছ এটি একটি পাথরের উপরে লেখা। পাথরটি গোলাকৃতি অংশের । আবার এর খানিকটা ভেঙ্গেও গেছে। এর পাঠোদ্ধারের পর যা জানা যায় তা হলো:
অনুবাদ।। “ রাজার আজ্ঞা (বচন) দ্বারা ষড়বর্গীয়দিগকে তেল প্রদানের জন্য দ্রুম বা কাষ্ঠ প্রদানের মহামাত্রের প্রতি। (তিনি) সুলক্ষ্মীযুক্ত পুন্ড্রনগর হইতে ইহা সরবরাহ করাইবেন। ষড়বর্গীয়দিগকে দেয় ধান্যও পরিবহন করিবেন। উদকজনিত (বন্যাজনিত) আপদের, অগ্নিজনিত আপদের ও শুকপক্ষীজনিত আপদের (প্রতিবিধান) জন্য এই (পুণ্ডনগরের) কোষাগারের কোষ গণ্ডক ও কাকনিকা (মুদ্রা) দ্বারা পূর্ণ করিয়া রাখিতে হইবে।”
কিন্তু বাংলা অনুবাদ হলেও আমরা তো এটাও ঠিকমত বুঝতে পারলাম না। আনিকার কথাশুনে আতাউর বলতে লাগল- এই শিলালিপিতে একটি আদেশ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। জনগণের দু:খ দুদর্শা দুর করার জন্য স্থানীয় শাসককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রজাদের ধান বা মুদ্রায় সাহায্য করার কথা বলা হয়েছে। দেখো এখানে একটা চমৎকারবিষয়রয়েছেমাত্রসাতলাইনেরবাক্যেলেখাব্রাক্ষী লিপি থেকে আমরা তখনকার মুদ্রার নাম গণ্ডক, কাকনিক বা কড়ির কথা জানতে পারছি। আবার কিছু প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন তেল, গাছ, ধান কিংবা ধরো খাদ্য শস্যের ক্ষতি হওয়া সম্পর্কে ইঙ্গিত পাচ্ছি। পাখি ধান খেয়ে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরী করতে পারে বিষয়টি নিয়ে অথৈ হাসতে লাগল। রাতা বলল এতে হাসির কী আছে? আমাদের ছেলেবেলার বইতে পড়েছি না ‘ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিব কিসে’। আতাউর সোৎসাহে বলে উঠল এইতো ঠিক ধরেছো টুকরো টুকরো উপাদান জুড়ে অতীতের ইতিহাস তুলে ধরা যায়। অতীতে মানুষ কী করত, কী খেত, কী পরত, সবটাই জানতে পারা যায়। যেখানে ইতিহাসের উপাদানের টুকরো পাওয়া যায় না সেখানে শূন্যতা থাকে।
লেখক: ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম- প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর:পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ।