মেহেরপুর প্রতিনিধি : এ দেশ থেকে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠি বিতাড়িত হয়েছে বহু বছর। সাধারণ শ্রমজীবি মানুষ আর কৃষক, মজুরের ওপর তাদের নিদারুণ অত্যাচার আর দুঃশাসন এখন কেবলই ইতিহাস। তাদের সীমাহীন অত্যাচার আর ত্রাসের গল্পগাঁথা লিপিবদ্ধ আছে বইয়ের পাতায় পাতায়। কালের সাক্ষী হিসেবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটিশ শাসন আর শোষণের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত কিছু নীলকুঠি। মেহেরপুর জেলায় এইরকম দুইটি স্থাপনা রয়েছে। মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি নীলকুঠি ও গাংনী উপজেলার ভাটপাড়া নীলকুঠি। এই দুটি নীলকুঠি ও স্বাধীনতার সূতিকাগার হিসেবে মেহেরপুর একটি ঐতিহাসিক জেলা হিসেবে পরিচিত। ঐতিহাসিক ব্রিটিশ নির্যাতনের সাক্ষী হলেও ভাটপাড়া নীলকুঠি অযত্ন, অবহেলা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলুপ্তির পথে থাকা স্থাপনাটি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
সরেজমিনে দেখা যায়, নীলকুঠির দ্বিতল ভবনটির ভগ্নপ্রায় বেশিরভাগ দেয়াল সংস্কার করা হয়েছে। প্রথম তলার বিলুপ্ত ছাদ টালি ও চুন-সুড়কি দিয়ে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ভবনের দ্বিতীয় তলার ক্ষতিগ্রস্ত ছাদ মেরামতের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ভবনে নতুন করে দরজা-জানালা সংযোজনের প্রস্তুতিও দৃশ্যমান রয়েছে। সংস্কার কাজটি বাস্তবায়ন করছেন মেহেরপুরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স বারী এন্টারপ্রাইজ।
গাংনী উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ভগ্নপ্রায় ঐতিহাসিক কুঠিবাড়িকে ঘিরে ডিসি ইকোপার্ক হিসেবে এলাকাটি সংরক্ষণ করা হয়। নীলকুঠি ভবনটি সংস্কারের জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড থেকে ২০১৮ সালের জুন মাসে ত্রিশ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। প্রশাসনিক কিছু জটিলতার কারণে দীর্ঘদিন দরপত্র আহ্বান করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এর আন্তরিক প্রচেষ্টায় জটিলতার অবসান হলে কর্তৃপক্ষ ২০১৯ এর সেপ্টেম্বর মাসে দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। এরপরে প্রত্নত্ত্ব অধিদপ্তরের কারিগরি নির্দেশনায় চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কাজটি শুরু হয়েছে।
নীলকুঠি সংস্কারের বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে আলাপ করলে তাঁরা আনন্দিত হয়ে জানান এই সংস্কার কাজটা আমাদের এলাকার উন্নয়নে ভুমিকা রাখবে। এই কুঠিতে চার বছর আগে এখানে কেউ আসতো না। ভবনটা সংস্কার সম্পন্ন হয়েগেলে এখানে দর্শনাথীদের পদচারণায় এলাকা মুখতির হবে। ভাটপাড়া নীলকুঠিতে জেলার বাহির থেকেও অনেক দর্শনার্থী ঘুরতে আসে। তাই এখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।
দর্শনার্থী ঝিনাইদহ জেলার মেহেদী হাসান বলেন, ব্রিটিশ শাসনের গল্প বইয়ে পড়েছিলাম। দুইবছর আগে একবার এসেছিলাম তখন ভবনটি একবারেই ভাঙ্গাছিলো। কিন্তু এবার এসে দেখছি ভবনের সংস্কার করছে সংস্কার কাজ শেষ হলে এখানে অনেক দর্শনার্থী আসবে। এই ভবনটি সংস্কার করাতে নীলকুঠি তার পুরানো রুপ ফিরে পাবে। একই মন্তব্য করলেন চুয়াডাঙ্গা সরকারী কলেজের শিক্ষার্থী মুস্তাকিম হোসেন। এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাহক নীলকুঠি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ায় তাঁরা জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় প্রশাসনকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
সাহারবাটি ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক বলেন, ভাটপাড়া নীলকুঠি আমার ইউনিয়নের মধ্যে হলেও ঐতিহাসিক একটি নির্দশন। এই ভগ্নপ্রায় ভবনটি সংস্কার এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছিল। নীলকুঠি ভবন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ায় এলাকার মানুষ ও দর্শনার্থীরা বেশ উচ্ছ্বসিত। ইতিহাসের স্মারক নিজ চোখে দেখার অনুভূতি আসলে অবর্ণনীয়।
নীলকুঠি সংস্কার কার্যক্রমের তত্ত্বাবধায়ক উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের পক্ষে উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাকির হোসেন বলেন, কাজটি সাড়ে আটাশ লাখ টাকায় টেন্ডার করা হয়েছে। এত সীমিত অর্থে এই ধরণের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। কঙ্কালে পরিণত হওয়া ভবনটির দরজা-জানালা, কড়িকাঠ, বর্গা কিছুই ছিল না। আমরা কোনো কিছু সংযোজন বা বিয়োজন না করে পুরো আদল অক্ষত রেখে যতদূর সম্ভব কাজ করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। আগের মতোই সিমেন্টের পরিবর্তে চুন, সুড়কি ও টালি ব্যবহার করে এখন পর্যন্ত কাজ করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আর এম সেলিম শাহনেওয়াজ জানান, বরাদ্দকৃত অর্থের সর্বত্তোম ব্যবহার নিশ্চিত করে কাজ করা হচ্ছে। ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। পরবর্তীতে আরোও বরাদ্দ পাওয়া গেলে নীলকুঠি ভবনের অধিকতর সংস্কার ও নীলকুঠি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ভবনগুলোর পুরানো অবয়ব ফিরিয়ে আনতে পারবো।
এলাকার সচেতন মহল মনে করেন, ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী নীলকুঠিগুলো সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে সরকারের বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রত্নত্ত্ব অধিদপ্তরের এগিয়ে আসা উচিত। নইলে অচিরেই হারিয়ে যেতে পারে দেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা।