খিলখিল কাজীর ক্ষোভ : অব্যবস্থাপনার অভিযোগ : শিল্পীদের পরিবেশনায় মুগ্ধ দর্শক-শ্রোতা কাজী নজরুলের গান-কবিতা যুগে যুগে বিশ্ববাসীকে অনুপ্রানিত করবে

২০তম নজরুল সম্মেলন কানাডার টরন্টো : ‘কাজী সব্যসাচী’ অ্যাওয়ার্ড পেলেন ইকবাল বাহার চৌধুরী

নিউজার্সী (ইউএনএ): নজরুল শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত গণমানুষের জন্যই তার অমর সৃষ্টি রেখে গেছেন। তাঁর কবিতা, গান যুগে যুগে বিশ^বাসীকে অনুপ্রানিত করবে। নজরুলকে জানতে হলে আরো বেশি গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর সম্পর্কে আরো জানতে ও জানাতে দেশ ও প্রবাসে বেশি বেশি সভা, সমাবেশ ও সেমিনারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সীতে শতদল আয়োজিত দু’দিনব্যাপী ১৯তম উত্তর আমেরিকা নজরুল সম্মেলনের বিভিন্ন পর্বে এসব কথা বলেন বক্তারা। শনিবার (১৩ আগষ্ট) ও রোববার (১৪ আগষ্ট) নিউজার্সীর ইষ্ট ব্রুন্সউইকস্থ জেএমপি আর্ট সেন্টারে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সম্মেলনের শ্লোগান ছিলো ‘চির উন্নত মম শির’। সম্মেলনে কবিতা, গান, আবৃত্তি, নৃত্য আর বক্তব্যে কবি নজরুলকে তুলে ধরা হয়। এবারের নজরুল সম্মেলনে কবি নাতনী খিলখিল কাজী, বাংলাদেশের প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ সালাউদ্দিন আহমেদ, শিল্পী সুজিত মুস্তফা ও শিল্পী ড. লীনা তাপসী সহ দেশ-বিদেশ ও প্রবাসের নজরুল গবেষক, নজরুল ভক্ত এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অতিথি হিসেবে যোগ দেন। সম্মেলনে নিউইয়র্ক ও নিউজার্সী রাজ্য সহ উত্তর আমেরিকার ১২টি সংগঠন অংশ নেয়। দু’দিনের এই সম্মেলনের কর্মকান্ডের মধ্যে ছিলো কবি নজরুলের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা, সেমিনার, প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। খবর ইউএনএ’র।

এদিকে সম্মেলনের আয়োজনে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ছাড়াও কবিপুত্র কাজী সব্যসাচীকে তুলে ধরা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাঁর কন্যা ও কবি নাতনী খিলখিল কাজী। সম্মেলন আয়োজন, পরিকল্পনা আর ব্যবস্থাপনায় নানা ত্রুটির কারণে অতিথি সহ অনেককেই দূর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তবে ২/১টি পরিবেশনা ছাড়া দেশ ও প্রবাসের শিল্পী ও সংগঠনগুলোর অনুষ্ঠান পরিবেশনা মুগ্ধ করলেও দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি আশানরূপ ছিলো না। প্রতিদিন বেলা ২টা থেকে অনুষ্ঠান চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। এছাড়াও মূল মঞ্চের বাইরে ছিলো একটি বই, একটি খবারের স্টল সহ একাধিক শাড়ী-কাপড় আর ইমিটেশন গহনার স্টল।

সম্মেলনের উভয় দিনে অপরাহ্নে মূল মঞ্চের বাইরে একটি কক্ষে বিষয় ভিত্তিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে আমন্ত্রিত অতিথি, নজরুল বিশেষজ্ঞ ও এনএএনসিসি’র শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেন। সেমিনারগুলোতে দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিলো আরো কম। সম্মেলনের মূল অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ছিলেন নিউইয়র্কের দুই বিশিষ্ট উপস্থাপিকা ও নিউজ প্রেজেন্টার সাদিয়া খন্দকার এবং শামসুন্নাহার নিম্মি। এছাড়াও স্থানীয় উপস্থাপক ও উপস্থাপিকা বিভিন্ন পর্ব সঞ্চালনায় ছিলেন। সম্মেলনটি উপলক্ষ্যে ‘চির উন্নত মম শির’ শীর্ষক ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হয়।

২০২৪ সালের সম্মেলন টরন্টো: এনএএনসিসি কোর কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক দুই বছর পর আগামী ২০২৪ সালের উত্তর আমেরিকা নজরুল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে কানাডার টরন্টো। এর আয়োজক সংগঠন থাকবে ইলোরা আমীন নেতৃত্বাধীন তরঙ্গ। তবে কোন সংগঠন চাইলে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে নজরুল সম্মেলন আয়োজন করার বিষয়টি নর্থ আমেরিকা নজরুল কনফারেন্স কমিটি (এনএএনসিসি) বিবেচনা করবে বলে জানা গেছে। রোববার সকালে হোটেল লবিতে অনুষ্ঠিত এনএএনসিসি’র কোর কমিটির সভায় পরবর্তী সম্মেলনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। যদিও দুই বছর পর পর নজরুল সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও এর ব্যতিক্রম ইতিহাস রয়েছে, পর পর সম্মেলন আয়োজিত হয়েছে।

‘কাজী সব্যসাচী’ অ্যাওয়ার্ড ঘোষণা: এবারের নজরুল সম্মেলন থেকে প্রতিবছর কবি পুত্র প্রখ্যাত আবৃত্তিকার ‘কাজী সব্যসাচী’র নামে অ্যাওয়ার্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এবছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ‘কাজী সব্যসাচী’ অ্যাওয়ার্ড এর জন্য মনোনীত হয়েছেন ভয়েস অব আমেরিকা’র বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান, আবৃত্তিকার ইকবাল বাহার চৌধুরী। অ্যাওয়ার্ডটি ঘোষণার পর ইকবার বাহার চৌধুরীর ভিডিও বার্তা ডিজিটাল পর্দায় প্রচার করা হয়। শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি সম্মেলনে যোগ দিতে পারেনি।

উদ্বোধন: শনিবার সন্ধ্যায় সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন নর্থ আমেরিকা নজরুল কনফারেন্স কমিটি (এনএএনসিসি)-এর চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসাইন। এসময় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সম্মেলনের কনভেনর মোহাম্মদ কবীর কিরণ। সময়ের স্বল্পতার কারণে সংক্ষেপে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বিশেষ অতিথি রায়হানুল ইসলাম চৌধুরী, ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অফ সাইন্স এন্ড টেকনোলজির চ্যান্সেলর আবু বকর হানিফ ও সুলতান আহমেদ। সঞ্চালনা করে আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব হাসান আমজাদ খান। এসময় আমন্ত্রিত অতিথিসহ এনএএনসিসি’র ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দন আহমেদ, সদস্য ড. সুলতান আহমেদ, রোকেয়া হায়দার, ডা. ওয়াদুদ ভূঁইয়া, সম্মেলনের প্রধান সমন্বয়কারী রাহাত চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

উদ্বোধনী দিনের অনুষ্ঠানে শতদল ও বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব নিউ জার্সির শিল্পীদের পরিবেশনা উপস্থিত অতিথিদের মুগ্ধ করে। এছাড়াও এদিন নিউইয়র্ক ঢাকা ড্রামার প্রযোজনায় কাজী নজরুল ইসলামের ছোট গল্প অবলম্বনে নাটক “রাক্ষুসী” মঞ্চস্থ হয়। এর নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় ছিলেন বিশিষ্ট অভিনেত্রী শিরীন বকুল।

সম্মেলনের দ্বিতীয় ও শেষ দিন: সম্মেলনের দ্বিতীয় ও শেষ দিন রোববার সন্ধ্যায় ও রাতে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পারফর্মিং আর্টস-বিপা ‘মনেরও রং লেগেছে’ ও ‘বিদ্রোহী’ শিরোনামে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রদর্শন করে। এটি উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করার পাশাপাশি ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। সম্মেলনের বিভিন্ন দিন উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের মধ্যে অষ্ট্রেলিয়ার সিডনী থেকে আগত আদিলা নূর সহ সঙ্গীত পরিবেশন করেন সামিয়া মাহবুব, গায়ত্রী সাহা, সুচরিতা ঘোষ প্রমূখ শিল্পী। বিভিন্ন পর্বে আবৃত্তি করেন ডা. ফারুক আজম, কবীর কিরণ প্রমুখ।

সম্মেলনের শেষ দিন রোববার আমন্ত্রিত অতিথি, বিশেষ অতিথি এবং এনএএনসিসি’র শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে প্ল্যাক প্রদান আর উত্তরীয় পরিয়ে সম্মানিত করা হয়। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন নিউইয়র্ক-এর পক্ষ সম্মেলনের কনভেনর মোহাম্মদ কবীর কিরণ ও সদস্য সচিব হাসান আমজাদ খান-কে প্ল্যাক প্রদান করে সম্মানিত করেন ফরিদা আক্তার ও মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। এছাড়াও ২০২৪ সালের সম্মেলনের (টরন্টো, কানাডা) ঘোষণা দেন এনএএনসিসি’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন। রাত ১০টায় কনভেনর কবীর কিরণের কন্ঠে ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটে।

খিলিখিল কাজীর ক্ষোভ: সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অংশ নেয়া কবি নজরুল ইসলামের নাতনী খিলখিল কাজী রোববার রাতে মঞ্চে উঠে গান না গেয়ে কবি-কে নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন এবং ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সহ কবির লেখা ২/৩টি কবিতা পাঠ করে শুনান। এসময় তিনি বলেন, আজকের সম্মেলনে আমার বাবা কবী সব্যসাচীর নামে ‘অ্যাওয়ার্ড’ উৎস্বর্গ করা হয়েছে। এতে আমি খুশ হলেও, যাঁর জন্য তার নামে অ্যাওয়ার্ড হলো সেই সব্যসাচীর কন্ঠে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অংশ দর্শক-শ্রোতাদের শুনানো হলো না। এটা উচিৎ ছিলো।

ঢাকার শিল্পীদেরও ক্ষোভ: দু’দিনের সম্মেলনে দেশ-বিদেশ ও প্রবাসের শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করা ছাড়াও অন্যান্য পারফর্ম করার কথা থাকলেও তারা প্রাণভরে তাদের পরিবেশনা করতে পারেননি। আয়োজকদের পরিকল্পনার ত্রুটির কারনে সম্মেলন আয়োজক সংগঠন শতদল সহ আরো একাধিক সংগঠনের পরিবেশনা শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে হয়েছে। অপরদিকে ঢাকা থেকে আগত ওস্তাদ সালাহউদ্দিন আহমেদ, শিল্পী সুজিত মুস্তফা ও শিল্পী ড. লীনা তাপসী-কে মাত্র তিনটি করে গান পরিবেশন করতে হয়েছে। এতে শিল্পীরাও যেমন অতৃপ্তি প্রকাশ করেছেন, তেমনী উপস্থিত দর্শকরাও। গান গাইতে মঞ্চে উঠে অনেকেটা ক্ষোভের সাথে লীনা তাপসী বলেন, সময় কম কথা না বাড়িয়ে গানে চলে যাই। আসলে এভাবে গানও গাওয়া যায় না। শিল্পী সুজিত মুস্তফা বলেন, মাত্র তিনটি গান গাইতে বলা হয়েছে। ভালো করে গান গাইতে হলে ২/৩টি গানে সুর উঠে না। ওস্তাদ সালাউদ্দিন অনেকটা বিরক্ত হয়ে বলেন, আমাদেরকে (শিল্পীদেরকে) সহ্য করার জন্য যারা মঞ্চের সামনে বসে রয়েছেন তাদের গান শুনাতে হলে সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু সময় তো নেই। মাত্র তিনটি গান গাওয়ার কথা বলা হয়েছে। যদিও দর্শক-শ্রোতাদের পক্ষ থেকে আরো গান গাওয়ার দাবী উঠে, কিন্তু সময়ের অভাবে শিল্পীরা তিনটির বেশী গান গাইতে পারেননি।

গোলাম ফারুক ভূইয়ার মধ্যাহ্ন ভোজ: নিউইযর্ক বাংলা বইমেলা-২০২২ এর আহ্বায়ক গোলাম ফারুক ভূইয়া সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী অতিথি ও সাংবাদিক এবং এনএএনসিসি কর্মকর্তাদের সম্মানে রোববার দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করেন। স্থানীয় একটি রেষ্টুরেন্টে এই ভোজের আয়োজন করা হয়।

উল্লেখ্য, সম্মেলন স্থলে একটি মাত্র খাবারের স্টল থাকায় এবং সন্ধ্যার পর রাত বাড়ার সাথে সাথে স্টলের খাবার ফুরিয়ে যাওয়ায় অনেককেই শনিবার ও রোববার রাতে খাবারের জন্য কষ্ট করতে হয়। সম্মেলন স্থল ব্রুন্সউইক এলাকার আশপাশের হোটেল-রেস্তোরা আগে-ভাগেই বন্ধ হয়ে হওয়ায় শনিবার রাতে খাবার না পেয়ে এনএএনসিসি’র এক শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তার স্ত্রী মুড়ি আর পানি খেয়ে রাত কাটিয়েছেন বলে ইউএনএ প্রতিনিধিকে জানান। আবার অনেকে পিজা খেয়ে রাত কাটান বলে জানিয়েছেন।

অন্যান্য প্রসঙ্গ: নজরুল সম্মেলন স্থল আর হোটেলের অবস্থান ৮/১০ মিনিটের ড্রাইভের দূরত্ব হওয়ায় অনেকের জন্য যাতায়াতেও সমস্যা ছিল বিদ্যমান। এধরনের সম্মেলনের স্থান আর হোটেল একই ভবনে হওয়া উচিৎ এমন অভিমত জানিয়ে একাধিক অতিথি ও দর্শক-শ্রোতা বলেছেন যার ফলে সেমিনার বা অনুষ্ঠানে দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিলো কম। অনেক সময় হাতেগোনা দর্মক-শ্রোতার উপস্থিতিতে সেমিনার আর অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়েছে।

২০তম নজরুল সম্মেলন
Comments (0)
Add Comment