সাইফুর নিশাদ , মনোহরদী (নরসিংদী) প্রতিনিধি : আদা, রসুন, মরিচ, এলাচী, লবঙ্গ, পাঁচফোঁড়ন, কালোজিরা, বহেরা, আমলকি, হরিতকি, জয়ত্রী ও জয়ফল। ওষধি ও রান্নার এ রকম ২৭টি মসলা যোগে বানানো চা। মিলবে এক ঝাড়তলায়, চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকারে, টিমটিমে এক আলোর ভেতর। এ চায়ের খ্যাতি পরিচিতি এখন মনোহরদীর গ্রাম-গঞ্জ-শহর ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী কয়েক উপজেলা ও জেলা অবধি।
বুধবার (০১ই ডিসেম্বর) পড়ন্ত বিকেলে হাজির হওয়া গেলো মনোহরদী উপজেলার কৃঞ্চপুর ইউনিউনের পশ্চিম বীরগাঁও গ্রামের খ্যাতি লাভ করা ঝাড়তলা এলাকায়। অত্যন্ত সাধারণ একটি চায়ের দোকান। টিনের একচালার নিচে সুপারি গাছের ফালির দুতিনটে বেঞ্চ। আছে দুতিনটে প্লাস্টিকের চেয়ারও। একধারে লাকড়ির চুলা। তাতে কেটলিতে ফুটছে লিকার। মাটিতে ছালা বিছিয়ে নানা রকম ডিব্বা-কৌটা ইত্যাদি সারি সারি সাজিয়ে রাখা।
এই হচ্ছে ২৭ মসলাখ্যাত ঝাড়তলার চায়ের দোকান। দীর্ঘদেহী, হৃষ্টপুষ্ট, শ্মশ্রুধারী, চা দোকানি ফরিদ উদ্দীন। কথা হচ্ছিলো তার সাথে কাজের ফাঁকে-ফাঁকে। কয়েক বছর আগে বীরগাঁও চৌরাস্তা বাজারে দোকান ছিলো তার। ২৭ মসলার ব্যতিক্রমী চায়ের আকর্ষণে জমজমাট ব্যবসা শুরু হতেই লোক লাগলো পেছনে। রাতের আঁধারে ঘরের চালা ফেলে দেয়া, দোকানে প্রাকৃতিক কার্যাদি সম্পাদনা করা, ইত্যাদি নানাভাবে অতিষ্ঠ করে তুললো ফরিদকে। শেষে রমরমা চা বেচায় ইতি দিয়ে বাড়ি ফিরতে হলো তাকে। পাক্কা ২ বছর বাড়িতে কাটিয়ে অবশেষে এখানে দোকান করলেন তিনি। ঘন বাঁশঝাড় ও ঝোপ জঙ্গলে আচ্ছন্ন জায়গা তখন এটি। দিনের বেলায়ও এ পথে মানুষ চলতে ভয় পায়।
ফরিদ জানান, প্রায় আড়াই বছর আগে চাচাতো ভাইয়ের বাঁশঝাড় উপড়ে ফেলে, ঝোপ জঙ্গল সাফ করে এখানে এই একচালার নিচে দোকান করেন তিনি। আগের পরিচিতি তো ছিলোই, নতুন করে ২৭ মসলার চায়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। খুঁজেপেতে খদ্দেরও জুটে আসতে থাকলো অখ্যাত এলাকার ততোধিক অখ্যাত এই ঝাড়তলার চায়ের দোকানে।
ফরিদ জানান, প্রতিদিন বিকেল ৫টার দিকে দোকান শুরু হয়। চলে মধ্যরাত অবধি। ফরিদের দাবি, চালাকচর, কটিয়াদি, মঠখোলা, বটতলা, মাষ্টার বাড়ি, বীরগাঁও, দরগা বাজারের ব্যবসায়ীরাও আসেন এখানে। দোকান বন্ধ করতে অনেক রাত হয়। এজন্যে কখনো কখনো রাত ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখতে হয় তাকে। অনেক দূর দূরান্তের খদ্দের আসেন তার চায়ের আকর্ষণে।
আশেপাশের ১০/২০ কি.মি. দূর থেকে তো আসেনই। মাসে দুদিন নারায়ণগঞ্জ থেকেও তার মসলাদার চা খেতে খদ্দের আসেন বলে জানান তিনি। কটিয়াদীর নোয়াকান্দী থেকে চা খেতে এসেছেন জামালসহ ৪/৫ জন। পাকুন্দিয়ার মান্দারকান্দী ও বুরুদিয়ার কয়েকজন। তারা চা খেলেন এবং বাড়ির জন্যেও নিলেন পলিব্যাগে করে। তারপর সাথে আনা ইজিবাইকে চলে গেলেন তারা। কৃষ্ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী এমদাদও আসেন এখানে চা খেতে। যোগাযোগ করা হলে তিনিও এ কথার সত্যায়ন করলেন। তার দোকানে প্রায় আড়াই ঘণ্টা অবস্থান করে দেখা যায়, সেখানে একা একা আসছেন খুব কম লোকই। প্রায় সবাই ৪ থেকে৭/৮ জনের দলে আসছেন। বসছেন। চা খেয়ে,পলিব্যাগে ভরে নিয়ে চলে যাচ্ছেন তারা। গ্রামীণ চা দোকানের আড্ডাবাজি নেই এখানে। নেই কোনো হৈ চৈ কিংবা চেঁচামেচি। কাউকে দীর্ঘ সময় বসে থাকতেও দেখা গেলো না সেখানে।
ফরিদ জানান, এ রকমই হয়। তারা আসেন, চা খান, সাথে নেন, চলে যান। তাই বেচা-বিক্রি নিয়ে তত ঝামেলা হয় না তার। কার্তিক অগ্রহায়ণে বেচাকেনা বেশি। তখন দৈনিক ৩ হাজার টাকার মতো বিক্রি হয় দোকানে। সামনের সংকীর্ণ পাকা রাস্তার ধারে তখন হোন্ডা, ইজিবাইক, সিএনজি, প্রাইভেটকারে জায়গা ধরে না। ফলে দোকান আরো পেছন দিকে সরিয়ে নিয়ে জায়গা করে দিতে হয়। বর্ষায় বিক্রিতে মন্দা। প্রতি কাপ দশ টাকা করে ১৫ থেকে ১৮ শয়ের বেশি বিক্রি ওঠে না এখন। দৈনিক দেড় ২০০ কাপ চা বেচেও ৫ থেকে ৬ শত টাকার বেশি লাভ হয় না।
ফরিদ জানালেন, দিনের অর্ধেক যায় তার চায়ের মসলা কাটা, বাটা ও অন্যান্য কাজে। স্ত্রীও সাহায্য করেন তাকে। তবে দোকানের সব কাজ একাই করেন তিনি। চারপাশের ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর সামান্য টিমটিমে আলোয় তার দোকানে বসে চা পানের অনুভূতিটাই আলাদা! মসলাদার চায়ের স্বাদেও আছে এক ভিন্নতা। ওষধি গুণের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। সেই সাথে ফরিদ উদ্দীনের টুকটাক গালগল্পও মন্দ লাগে না তখন।