মেঘ বলেছে ‘যাব যাব’
মহৎ কবিরা প্রাণহীনের মধ্যে প্রাণ দেন, ভাষাহীনের মুখে ভাষা দেন। এমন একটি বাঙ-প্রাণময় মেঘের কথা দিয়ে যে গান শুরু, সে গানে আরো শুনব, সাগরের, দুঃখের, অদৃশ্য ‘আমি’-রূপ মানবাত্মার, ভুবনের, গগনের, প্রেমের, মরণের কথা। এঁদের কথাগুলো কিন্তু বুঝতে সবই সহজ নয়, কোনো কোনোটি বেশ কঠিনই আছে।
মেঘ বলেছেন ‘যাব যাব’—মেঘ কোথায় যাবেন ?
রাত বলেছেন ‘যাই’—রাতের কেন এ বিদায় সম্ভাষণ, তিনি কোথায় যাবেন ?
সাগরের কথাটি অবশ্য সহজ। তিনি বলেছেন ‘কূল মিলেছে—আমি তো আর নাই’—কূল মিলে গেলে সাগর আর থাকে না। মহাসিন্ধু অনুভব করেন, ‘আমি আর কূল-কিনারাহীন নই’।
কিন্তু মেঘ এ কী বললেন ? তিনি যেতে চান, কোথায় যেতে চান ? জলধারে সমাপ্ত হতে ? না এক আকাশ থেকে আর এক আকাশে উড়ে ?
মনে হচেছ, মেঘ সমাপ্তির ঘোষণা টানছেন। তিনি জমে জমে ভারি হয়ে পড়ছেন। এ ভার তিনি এখন নামাতে চান। এতে তাঁর তৃপ্তিও—তাঁর পূর্ণতা। জলদাতৃ জলদ পৃথিবীকে জল দিলেই তাঁর দায় শেষ হয়ে যায়। এ তাঁর পূর্ণতাও বটে, কর্তব্য পালনও বটে।
রাতই যাবেন কোথায় ? ‘রাত বলেছেন ‘যাই’’, মানেটা কী ? হ্যাঁ, মানেটা আমরা বুঝে গেছি। রাতও তাঁর পরম দায়িত্ব সাফল্যের সাথে পালন করেছেন। দিনের কোলাহলের উপর একটা নিথর –নীরব, অন্ধকার স্নিগ্ধ প্রপাত দরকার ছিল। প্রাণীকূল শুধু কাজ আর কোলাহল চায় না, বিশ্রাম, নিদ্রা, প্রশান্তি চায়। আবার নতুন ভোরের সাধনাও চায়। জগতকে তার চাওয়াটি দিয়ে দিনের হাতে পৃথিবীকে বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন রাত। এর সাথে শেষ হলো গানটির আস্থায়ীর অংশ :
মেঘ বলেছে ‘যাব যাব’ রাত বলেছে ‘যাই’,
সাগর বলে ‘কূল মিলেছে—আমি তো আর নাই’।।
এরপর প্রথম অন্তরায় আমরা শুনতে পেলাম ‘দুঃখ’ আর ‘আমি’ বা অহমের কথা :
দুঃখ বলে ‘রইনু চুপে তাঁহার পায়ের চিহ্নরূপে’,
আমি বলে ‘মিলাই আমি আর কিছু না চাই’।।
দুঃখ কাঁর পায়ের চিহ্নরূপে রইলেন ?
আর কারো নন, স্বয়ং বিধাতার। আমাদের জীবনের উপর একটা দুঃখের পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছেন তিনি। না হলে তো জীবন অচল হয়ে যেত, অন্বেষণহীন, সৃজনহীন হয়ে যেত। শুধু প্রমোদ নিয়েই পড়ে থাকত সে—তাতেই মুগ্ধ—তাতেই ধন্য। সে এ গান গাইতে পারত না, ‘প্রমোদে ভরিয়া দিনু মন/তবু, কেন, প্রাণ কাদে রে’।
এই যে সব প্রমোদ ছাপিয়ে প্রাণের কেঁদে ওঠা, এখানেই দুঃখের জয়। এখানে মানুষেরও জয়, বিধাতারও জয়।
কেমনে দুঃখে মানুষের জয়, তা অবশ্য আমাদের বুঝতে বেগ পেতে হয় না। দুঃখ না থাকলে জগতে সৃষ্টি থাকত না, দুঃখ দূর করার সাধনা থাকত না। দুঃখের তপস্যাই মনুষ্যতের সাধনা—এ বোধই জন্মই হতো না। জগতটা সৃষ্টিহীন, স্বপ্নহীন, রতি-নিবেদিত এক হুর-গেলমান সম্ভোগের মরনোত্তর কথিত জগতের মতো হয়ে যেত হয় তো বা।
একটা উদাহরণ মন্দ হয় না দুঃখের স্বরূপ বুঝতে। স্বরে ‘অ’ হচ্ছে স্বরবর্ণের বিধাতা। এই ‘অ’ এর পদছাপ দেখি ক থেকে ক্ষ পর্যন্ত প্রতিটি ব্যঞ্জনবর্ণে। তদ্রুপ এই ‘অ’ অপূর্ণতা রূপে, ব্যঞ্জনবর্ণরূপী প্রতিটি মানুষের অন্তরে বিরাজ করছে—এ কথাটি আমাদের মনে রাখতে হবে। এই অপূর্ণতাই আমাদের ‘দুঃখ’। যা না থাকলে জীবন অচল হয়ে যেত। যা আমাদের জন্য বিধাতার সবচেয়ে সেরা দান।
এবার আসি ‘আমি’-র কথায়। আমি বলে ‘মিলাই আমি আর কিছু না চাই’। ‘আমি’-কে আমরা ধন্যবাদ দিতে পারি, সরাসরি তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যটা বলার জন্য। এই যে আমার দুঃখ, আমার অপূর্ণ, সব পেয়েও এক অচেনা অজানা হাহাকার, এটি তো কখনো ঘুচবে না, যদি আমি পরম-জনের সাথে মিলতে না পারি। এই মিলন জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার। মাশুকের সাথে আশেকের ফানা হয়ে যাওয়া। নদী যেমন পথের সমস্ত বাধা অতিক্রম করে সাগরে মিললে তার আর কোনো চাওয়ার থাকে না, তদ্রুপ মানবাত্মা শত সংগ্রাম শত সাধনা শেষে মাশুকরূপী স্রষ্টার সাথে মিলাতে পারলে তার আর কোনো চাওয়ার থাকে না।
গানটির অন্তরায় ভুবন আর আকাশের কথা :
ভুবন বলে ‘তোমার তরে আছে বরণমালা’,
গগন বলে ‘তোমার তরে লক্ষ প্রদীপ জ্বালা’।
এই যে ভুবন আপন আনন্দে এত ফুল ফুটাল, এ তো স্রষ্টর জন্যই তাঁর বরণমালা তৈরির উদ্যোগ। গগন লক্ষ প্রদীপ তো তাঁর জন্যই জ্বাললেন। সেই মহারাজ, জগতের সব ফুল যাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ে। আকাশের সব তারা মূর্ছা যায়।
আমরা ভুবন আর গগনকে ধন্যবাদ জানাতে পারি, সরল ভাষায় তাঁদের মনের গহন কথা জানানোর জন্য।
গানটির শেষ অন্তরায় চলে এসেছি। এখানে আছে ‘প্রেম’ আর ‘মরণ’-এর কথা :
প্রেম বলে যে ‘যুগে যুগে তোমার লাগি আছি জেগে’,
মরণ বলে ‘আমি তোমার জীবনতরী বাই’।।
এরা দু-জন আমাদের উদ্দেশ্য করে বলছে। প্রেম তো কাল-নিরবধি। আমাদের জন্য তাঁর অনিদ্র জেগে থাকা। এই জেগে থাকায় জীবন ধন্য হচ্ছে। ভাবা যায় যদি আমাদের হৃদয়ে প্রেম জাগ্রত না থাকত ?
বিধাতা আমাদের প্রেম দিয়েছেন বলে আমরা আজীন তাঁর পরশ চাই। তিনি প্রেম দিয়েছেন বলেই আমরা নর-নারী ঘর বাঁধি, সন্তান লালন করি, মানব মিছিল নিয়ে কাল থেকে কালান্তরে প্রবাহিত হই। তিনি প্রেম দিয়েছেন বলে ফুল মালা হয়ে ওঠে। গোলাপ এত লাল হয়। জীবে নিসর্গে আমাদের এই যে প্রেম, এটি না থাকলে আমাদের সংসার চলত না। আঁতুরের আর্তনাদে কেউ সাড়া দিত না। প্রেম না থাকলে বিশ্বের বাল্মিকীরা কবিতা লিখত না। শব্দে-শব্দে বন্দি হয়ে গীত হতো না গানের কথা। যতদিন প্রেম জেগে রবে, ততদিন ‘ভোরের আকাশ আলোয় ভরে যাবে’।
গানের শেষে আসুন আমরা মরণকে প্রণতি জানাই। অসাধ্য সাধন করছেন তিনি। দাঁড়-টানা, পাল-তোলা, বৈঠা চালানোর কাজটি বড় কঠিন। আর তা যদি হয় নির্ঘুম, নিবিরতি, নিরন্তর। যে-দিন আমাদের জন্ম হলো, সে-দিনই তিনি আমাদের জীবন-তরীর মাঝি হয়ে বসলেন। তারপর অনুকূল-প্রতিকূল সব স্রোতেই তিনি এ তরী বেয়ে যাচ্ছেন। তিনি একদিন আমাদের ঘাটে পৌঁছে দিবেনই। আসুন আমরা এই মহান মাঝিকে আবারও নমষ্কার করি।
ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম -অবসরপ্রাপ্ত সচিব,কবি ।