আসুন প্রেম কুড়াই
স্রষ্টা আকাশ-হতে প্রেম বিলাচ্ছেন। দু হাতে। ছড়িয়ে পড়ছে অমৃতের মতো। জগত কুড়িয়ে নিচ্ছে। গাছপালা, পাখি, গ্রহ-নক্ষত্র—কেউ বসে নেই। তুমি বসে থাকবে ? প্রেম কুড়াবে না ?
এখানে স্বার্থের কোনো প্রতিযোগীতা নেই। প্রেমের দানের কোনো শেষ নেই। এক, একক, অখণ্ড আদি সত্তার দানে নেই দীনতা। যত নিবে, শেষ হবে না।
আজ যে গানটি আলোচনা করছি তার শিরোনাম, আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলায় :
আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলায় ওকে !
সে সুধা ছড়িয়ে পড়ে লোকে লোকে।।
ভূমিকায় বলেছি এ সম্পর্কে। কে প্রেম বিলান, বলেছি তাঁরও পরিচয়।
এই ছড়িয়ে দেয়া প্রেম কুড়িয়ে নিচ্ছে সবাই। গাছপালা পতায় পাতায় কুড়াচ্ছে। পতার রঙ প্রেমেরই বিভা। প্রেম আলো হয়ে আসে। সালোকসংশ্লেষণের মধুর খেলা চলে। পাতা হয় পান্নর মতো। আরো কত রঙ ! মন গায়, ‘এই তো তোমার প্রেম ওগো হৃদয়হরণ/এই যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরণ’।
শুধু গাছ কেন, স্বয়ং জগত মস্তকে ধারণ করে এই প্রেম। প্রাণীকূল অঙ্গে মেখে নেয়। পাখি মুক্ত আকাশে গতি পেয়েছে এই প্রেমের কারণে। এই প্রেম সে ডানায় এঁকে নিয়েছে বলে :
গাছেরা ভরে নিল সবুজ পাতায়,
ধরণী ধরে নিল আপন মাথায়।
ছেলেরা সকল গায়ে নিল মেখে,
পাখিরা পাখায় পাখায় নিল এঁকে।
উপরের ‘ছেলেরা’ বিশ্বর সন্তান—ছোট-বড় নির্বিশেষে। এর পরের লাইনটি আবার ‘ছেলেরা’ দিয়ে শুরু হয়েছে। কিন্তু এ ‘ছেলেরা’ শিশু। শিশুরা প্রেম কুড়িয়ে নিচ্ছে মায়ের বুকে। প্রেমের ধারায় ভাসছে শিশু, আর মুখে তাকিয়ে আছে মুগ্ধ মাতা :
ছেলেরা কুড়িয়ে নিল মায়ের বুকে,
মায়েরা মেখে নিল শিশুর মুখে ।।
এবার প্রেম রূপ নিল দুঃখ রূপে, অশ্রু হয়ে। এ দুই ছাড়া প্রেম হয় না :
সে যে ওই দুঃখশিখায় উঠল জ্বলে,
সে যে ওই অশ্রুধারায় পড়ল গলে।
অঙ্গারের মতো বিরহ জ্বলে। সব পেয়েও জ্বলন থামে না। এই বিরোহ অশ্রু হয়ে গলে। জীবন-ভর। এত পেলে, তবু কেন কাঁদো ? উত্তর, ‘মন যে টানে কিসের টানে, কেউ তা জানে না’। এ কি উত্তর হলো !
গানটির পরের দুই লাইন জীবন-মৃত্যুর আশ্চর্য এক প্রতীকী দর্শনে ঋদ্ধ :
সে যে বিদীর্ণ বীর-হৃদয় হতে
বহিল মরণরূপী দুঃখস্রোতে।
হৃদয় চিরেই বের হচ্ছে মরণরূপী দুঃখস্রোত, এও প্রেম। এই ইন্দ্রিয়মগ্ন মধুরতা থেকে প্রেমরূপী মরণস্রোত একদিন আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় অজানা লোকে। সেটা দুঃখের। তাই প্রেমকে এখানে দুঃখস্রোত বলা হয়েছে। সব সম্পর্কে অবসান ঘটিয়ে, এই আকাশ, আলোক, মেঘ-জল, অলো-ছায়ার বাঁধন কেটে, ছিন্ন করে সব স্নেহমোহবন্ধন, সে আমাদের কোথায় নিয়ে যায় !
তবুও মরণ ‘প্রেম’ কেন ? আকাশে দু হাতে বিলানো প্রেমের অংশ কেন ?
এখানেই রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টির স্বার্থকতা। মৃত্যু আসলে প্রেম ছাড়া কিছু নয়। কিশোর বেলায় তাঁর লেখা ভানুসিংহের পদাবলির ‘মরণ’ কবিতার বাঁশিওয়ালা তো কৃষ্ণরূপী মৃত্যু। আর মানবাত্মা রাধা। অনুক্ষণ মৃত্যু-বাঁশিতে কৃষ্ণ ‘রাধা রাধা’ করছে মানবাত্মাকে কাছে নিতে। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গানে-কবিতায় ব্যাপারটি ছড়িয়ে আছে।
জীবন ভাঙা-গড়ার খেলা। প্রেম তাই নেচে যায় ভাঙাগড়ার তালে, দেশ হতে দেশে, কাল হতে কালে :
সে যে ওই ভাঙাগড়ার তালে তালে
নেচে যায় দেশে দেশে কালে কালে।।
এ দু লাইনের মাধ্য দিয়েই সমাপ্ত হয়ে যায় এ আশ্চর্য গানের বাণীবন্ধ। আর প্রশ্ন রেখে যায়, প্রেম কি শেষটা হতাশার ? যা ভেঙেও দেয়, বুক বিদীর্ণ করে তা কী করে প্রেম হয় ? স্রষ্টার বিলানো প্রেম এমন হয় !
আরে হয়। প্রেম কি শুধু রতি-রমন-মোহবন্ধন ? হতাশার কিছু নেই। প্রেম নিষ্ঠুরও নয়। একটি গান একটি ছিন্ন কাঁকনের রাগিনী মাত্র। তা দিয়ে মহাকাব্য হয় না। রবীন্দ্রনাথের আরো গানের দিকে তাকাতে হবে। তা হলে প্রেমরূপ মাহাকাব্যের স্বরূপ বোঝা যাবে। যেখানে বলা আছে মৃত্যু এ-পার ভাঙছে তো ও-পার গড়ছে। হতাশার কি আছে ? দু দিনে এ-পার যদি এত নেশা ধরায় চির দিনের ও-পার কেন শূন্য হবে ? তাই মৃত্য নিয়ে কোনো দ্বিধা-শংসয়ের কারণ নেই। মৃত্যু, অজানার জয় ঘোষণা করছে। অমৃতের পুত্রদের যা দরকার, তা হচ্ছে অমৃতের তপস্যা।
প্রেম যিনি বিলান, তাঁর সাথে মিলন চাইতে হবে। শুধু স্বার্থপরের মতো জাগতিক সুখ ভোগের জন্য প্রেম নয়। তা হলে সেই মহারাজের আকাশ থেকে প্রেম বিলানোাটাও নিঃস্ফল হবে।
১৮.০৬.২০২০
ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম : অবসরপ্রাপ্ত সচিব,কবি ।