রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর এবং ফেসবুকে মৃত্যুর চিঠি
যাকঘর নাটকটি দেখলাম। নিস্তব্ধ বর্ষার ভোরে বাসার আর কেউ জাগেনি। একা কী করব !
রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টি অমলকে দেখছি। নিতান্ত বালক। সে জানত না তার ভাগ্যে আর আয়ু নেই। তাই ঊসর মাটিতে শুক্ণ চারার মতো তার জীবনপিঁপাসা। কুমারীর পতি-লাভের বাসনার মতো বললে ভালো হতো, কিন্তু অমল ছিল নিতান্ত বালক, ছোট্ট মেয়ে সুধার সঙ্গে তার ফুল তুলতে বনে যেতে ইচ্ছা হতো বটে, সে শুধু ফুলের জন্য, সাথির জন্য, ওর বেশি কিছু গাঢ়, রক্তাক্ত বোধ তার মধ্যে তখন তৈরি হয়নি।
অমলের ঘর থেকে বের হওয়া কবিরাজের বারণ ছিল। সে জানালায় বসে বাইরের সেটুকু দেখত, তাতেই সীমিত হয় তার জগত। কাঠবিড়ালী আঙিনায় এসে ডালের খুঁদ খুটে খুটে খেত। পিসি যাতায় যে ডাল ভাঙতেন সেখানে, তার পড়ে থাকা খুঁদ। সে খুঁদ খাওয়া দেখে জীবনের প্রতি যে অসমান্য আকর্ষণ বোধ করত অমল, তা কোনো রাজা রাজত্বের জন্যও করে না। অমলের জানালার থেকে দেখা যায় এমন জায়গায় একটা ছোট্ট দালান ওঠে। বাইরের টহল দেয়া প্রহরী সুযোগ পেলে নিঃসঙ্গ অমলের জানালায় এসে গল্প করত। তার কাছ থেকে অমল জানে ওটা পোষ্ট অফিস। একে একে সে জেনে নেয়, ওটা রাজা বানিয়েছে, ওখান থেকে রাজার চিঠি আসে, ডাকপিয়ন তা ঘরে ঘরে বিলি করে। সে বলে, তার কাছে কি রাজা চিঠি পাঠাবে ? প্রহরী তাকে খুশি করতে বলে, ‘নিশ্চয়ই’। সরল বালক সেদিন থেকে রাজার চিঠির আশ্বাসে উতল হয়ে দিন যাপন করে। একদিন রাজার দূত আসে। সাথে রাজভেষক। তখন অমলের চোখের আলো মুছে গেছে। রাজভেষক বদ্ধ দরজা খুলে দেয়। তারার আলো নেমে আসে অন্ধকার ঘরে।
এখন ফেসবুকে মৃত্যুর চিঠি পড়ি। বিজ্ঞান উঠিয়ে দিয়েছে ডাকঘর। কিন্তু ঠেকাতে পারেনি মৃত্যুর অনাচার। যখন যার ঘরে ইচ্ছা এখনো ঢুকে পড়ে যমদূত। রাজার চিঠি নিয়ে।
মহামারী দমিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞান, আয়ু বাড়িয়েছে। তাই আশা করেছিলাম, আশির একটা সীমানায় রাজার দূত আসবে। কিন্তু অজাচারি রাজদূত সীমানা মানছে না। কোরনা রূপে সে হানা দিচ্ছে ঘরে ঘরে।
কাল যে চিঠিটা পড়েছিলাম, এক মায়ের কান্না। মা-বাবা দু জনই ডাক্তার। পাশে হাসপাতালের সাদা বেডে পড়ে আছে একুশ বছরের একমাত্র ছেলে। পড়ত মেডিকেলে। বাবা-মার মতো ডাক্তার হতে চেয়েছিল। যমদূত তার দেহের ভিতর থেকে তুলে নিয়ে গেছে সেই মহান ইচ্ছাসত্তার পদ্মকোরক, যা ডাক্তার হতে চাইতেন। এখন পড়ে আছে একট জীর্ণ চিঠি। যার আঁখর অস্পষ্ট। এতক্ষণে ধুলায় ধূলি হয়ে গেছে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি। আমরা সমতল ভূমির লোক, পাঁচদোনা পাহাড় চোখে পড়ে না। মানুষের নির্মিত ভবনগুলো চোখে পড়ে। সে-ও কত বিশাল বিশাল ! এক একটা টাকার পাহাড়। তার পাদদেশে নদী নেই, অরণ্য নেই। ভেতরে জীবনের যে কলোরব ছিল তা-ও কেমন শান্ত হয়ে গেছে।
এক একটি লাশ চলে যাচ্ছে গোরেস্তানে। ঘর থেকে, বড় বড় হাসপাতালের পাশ দিয়ে, হাসপাতাল থেকে। ওখানে যাঁরা ডাক্তার, তারা শত বছর আগের আয়ুর্বেদ কবিরাজ নন। শাস্ত্রকার চড়কের তেঁতো-বড়ি আর পাচানের দাওয়াই তাঁদের হাসাত। কিন্তু আধুনিক সব ওষুধ নিয়েও তাঁরা রবীন্দ্রনাথের সেই অমলের কবিরাজের মতোই অসহায়। অন্যের জীবন তো দূরের কথা, নিজের জীবনও রক্ষা করতে পারছেন না।
ইতিহাস যেদিন পাতা উল্টাবে ঢাকাবাসী বিশ্বাস করবে না শহর কেমন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। মাসের পরে মাস রাস্তা ফাঁকা, যেখানে মিসিলের মতো বয়ে যেত মানুষ আর যন্ত্রযান।
কী দেখছি আমরা !
জীবিকার দায়ে মৃত্যু-ঝুঁকির মধ্যে খুলেছে বটে লক-ডাউন, তবু মানুষ কই ? খাঁ খাঁ পথ। বারান্দার সামনে রাস্তা দিয়ে যারা চলে চায়, তাদের মধ্যে ‘ডাকঘর’-এর দইওয়ালার আনন্দ নেই, মালিনীকন্যা সুধার উল্লাস নেই, বালক ফকির ছিদাম, গোফওয়ালা প্রহরী—কারো মতো নয় তারা। সবাই যেন নিতান্ত দায়ে পড়া মানুষ। পথে বেরিয়েছে দায়ে পড়ে বটে, তবে পা ফেলছে সাবধানে। পথ ভরা যেন অদৃশ্য কাল কেউটা। সবার মুখে মুখোশ পরা। আধুনিক মানুষ মুখোশের মানুষ বটে, কিন্তু তাকে অন্তরের মুখোশের বাইরেও মুখোশ পরে এমন করে পথ চলতে হবে, এমনটা সে দুদিন আগেও ভাবেনি।
বালক অমল প্রত্যহ কীঁটে কাটা ফুলকুঁড়ির মতো শুকিয় যাচ্ছিল। বায়ু-পিত্ত-কফের নাড়ি ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছিল দিন দিন। তবুও তার একটা আশাবাদ ছিল, একদিন সে পাঁচদোনা পাহাড়ে যাবে, ডাকপিয়ন হয়ে ঘরে ঘরে চিঠি বিলাবে, সাগরধারে পাখির দ্বীপে ঘুরে ঘুরে দেখবে পাখির ঘর-সংসার।
কিন্তু আমাদের সামনে কী আশা আছে ? আমাদের সামনে এমন কোনো ঝরনা নেই যার জলের কিনারে বসে ছাতুতে জল মেখে খেয়ে নেওয়া যায়—সে জলে বিষ। কোনো পাহাড় নেই, যার গায়ে নর-রক্তের দাগ নেই। এমন কোনো দ্বীপ নেই যেখানে তলোয়ার-বাঁধা ‘বীর-পুরুষ’ নারীর হৃদয়ে ছোরা চালায় না। এমন কোনো রাজপথ নাই যেখানে সিনতাই হয় না। তা হলে কোন আশায় আরো বেঁচে থাকতে চাই ?
বাঁচার দুর্বোধ্য আশা কোন তীক্ষ্ণ সুতায় ঝুলে থাকে জানি না। দীর্ঘ দিন ঘরে থাকতে থাকতে প্রতিদিন মৃত্যু সংখ্যা বাড়তে বাড়তে, প্রতিদিন টিভির পর্দায় শুভ্র রক্ষা-পোশাক-পরা, একদল শববাহকের হাতে নিঃসঙ্গ শবের কবরে নামা দেখতে দেখতে, মৃত্যুর প্রত্যাশা বড় হয়ে উঠছে। কেমন সুন্দর একটা মৃত্যু—যদি হয়, আমার কোনো স্বজন সাথে যাবে না শবযাত্রায়। প্রিয়জন চোখের জল মুছে শেষ মুষ্টি মাটি দিয়ে ঢেকে দেবে না আমাকে। যাঁদের আমি জীবনে দেখিনি, যাঁরা আমাকে জীবনে দেখেনি, তাদের নিরাবেগ হাত আমার কবর খুঁড়বে, আমার জন্য দোয়াও করবে। তারপর কবরে শুয়ায়ে অন্য লাশের শেষ গতির জন্য দ্রুত ছুঁটবে।
ওদের অনেক তাড়া। কারণ লাশের সংখ্যা অনেক বেশি, ওদের সংখ্যা কম ।
ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম : অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও কবি ।