বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছিল ৩০ দশকের দিকে। সেই আধুনিকতার ভিত্তি যারা শক্ত হাতে সযত্নে নির্মাণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে কবি জীবনানন্দ দাস অন্যতম । শুধু কবিতা লেখাকেই জীবনের অন্যতম সংগ্রাম হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি। ইউরোপীয় কবিতার নির্যাস আর বাংলার মায়ের শ্যামল মাটির সুগন্ধ মিশিয়ে তিনি যে কবিতার-বীজ বপন করেছিলেন, সেই গেরস্থালির উত্তরাধিকার আজকের আমরা, যারা কবিতার নতুন জল-ভূমির সন্ধানে মরিয়া, তাদের সামনে শক্তিশালী যে ভিত্তিটি নির্ভার রহস্যের ঢেউ তুলে কথা বলতে চায়, তার দিকে আমাদের তাকাতেই হয়। ভিত্তিটি রং-রস-রূপের মাধুর্যে এই শুদ্ধতম কবির শিল্পীসত্তার অহংকার মিশে আছে নিবিড় মমতায়।
এ এক অভিনব সখ্য, ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন জীবনানন্দ দাশ, এপারে আমরা কুয়াশা ভেঙে ভেঙে গুচ্ছগ্রাম বানাই কিংবা জলজ অাঁধারে বৃক্ষের কাছে হাত পাতি শব্দের খোঁজে। এই ভিত্তিটি কালের নিরালম্ব স্রোতে এক আশ্চর্য বাতিঘর, সেখানে দাঁড়াতেই হয়, এ এক মহাতীর্থ আমাদের।
কোনো এক পৌষ-সন্ধ্যায়,তাঁর কাছে ধরা দিয়েছিল কবিতার চঞ্চলা হরিণী, সে যেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়। যা কবি বুঝেছিলেন খুব সহজেই, ‘প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি অন্ধকারের যোনির ভেতরে সৃষ্টির অপার সম্ভাবনাকে।
তাঁর অন্তর্গত বিষাদ থেকে তিনি পেয়েছিলেন প্রকৃতির নিবিড় অবলোকনের ক্ষমতা। মণি-মুক্তো, কৈবল্যের উড়ন্ত পত্রালি যা তিনি সংগ্রহ করেছিলেন অনেক ভেতরে খুঁড়ে খুঁড়ে । সেখানেও আমাদের দাঁড়াতে হয়,কিভাবে কবিতার অন্তরালে গানের দীপাবলি মন হৃদয়কে অন্যভাবে দোলা দেয়। ভাবতে হয় সেই কথা কীভাবে কালিক সত্যকে বহন করে বয়ে যায় কাল থেকে কালান্তরে এই নির্জনতম কবির প্রজ্বলিত হৃদয়ের অভিজ্ঞান।
গ্রামবাংলার যেসব দৃশ্য প্রতিদিনই আমাদের চোখে ভাসে – সেই চিরচেনা দৃশ্য – সেই অন্তর্ভেদী জীবনঘনিষ্ঠ পথঘাট, বিজন প্রান্তর এবং শাশ্বত গ্রামীণ নিসর্গের বিস্তার দেখা যায় তাঁর ‘আকাশে সাতটি তারা’ কবিতায়। আকাশে সাতটি তারা জ্বলে উঠলে তিনি দেখতে পান ‘বাংলার নীল সন্ধ্যা -/ কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে’ এছাড়া … ‘নরম ধানের গন্ধ-কলমির ঘ্রাণ,/ হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল,/ চাঁদা সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল-ধোয়া ভিজে হাত – শীত হাতখান/ লাল লাল বটের ফলের/ ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা – এরি মাঝে বাংলার প্রাণ :’ বাংলার শ্যামল নিসর্গ এবং এসব চিত্র ও চিত্রকল্পে লেপ্টে আছে কবির মমতাময়ী দেশচেতনার নিগূঢ়তা।
যে-কবি ‘চাঁদা সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রাণ’ পান আর ‘লাল লাল বটের ফলের ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা’ অবলোকন করেন, সে-কবিকে বাংলাদেশের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছাড়া আর কী ভাবা যেতে পারে! জীবনান্দের অবস্থান বাংলা কবিতার এমন এক স্থানে, যেখানে আলো ফেলে নতুন নতুন জগৎ আবিষ্কারের সুযোগ কখনো শেষ হবেনা।
— জাহিদ হাসান নিশান।