একটা সুন্দর সম্পর্কের পরিবর্তন, সম্পর্কে অবিশ্বাসে গৃহপ্রবেশ, ভালোবাসা-র নামে কারো প্রতি নিজের মতামত চাপিয়ে দেয়া, ভরসা আর বিশ্বাসের অভাবে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে থাকা মেয়েটার জীবনে হঠাৎ করেই কোনো এক আগন্তুকের আগমন! না চাইতেও পর্যায় পরিস্থিতিতে আগন্তুক ছেলেটির সাথে বন্ধুত্ব নামক সম্পর্কের সূচনা হয়। সেটি ধীরেধীরে প্রেমের সম্পর্কে গড়ায়।
মেয়েটি জীবনকে নতুন করে সাজাতে যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে জানতে পারে সেই বিশ্বস্ত মানুষটির ধর্ম আর তার বিপরীত মেরুর!
সামাজিকতা, নিয়ম রীতির বেড়াজাল আর কারো ক্ষমতার জোড়ে অপছন্দের মানুষটির সাথে বিয়ে, সেই সাংসারিক জীবনে নেমে আসে মানসিক যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণা হয়তো সহ্য করার অবস্থা না থাকায় এক সময়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে মেয়েটি।
ঢাকা কবি নজরুল ইসলাম কলেজের
স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের বাংলা সাহিত্যের মেধাবী শিক্ষার্থী আনান্নিয়া আন্নি তার লেখুনিতে তুলে এনেছেন সেই অসঙ্গতির গল্প। রোমান্টিক সামাজিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ ভালোবাসার চরম পরিণতি নিয়ে লেখা গল্পটি অবশ্যই পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করতে সক্ষম হবে। গল্পটি বেশ কয়েকটি খন্ডে ধারাবাহিক প্রকাশ করবে জনপ্রিয় অনলাইন সংবাদ মাধ্যম বিডিভিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম।
আজকে থাকছে ‘মায়াজালে এখনও আমি’ শিরোনামে ধারাবাহিক গল্পের প্রথম খন্ড….
মায়াজালে এখনও আমি
লেখক- আনান্নিয়া আন্নি
পর্ব-এক
দুপুর ২ টা বেজে ১৭ মিনিট।
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, মৃদুমন্দ উত্তরের হাওয়া বইছে। বোধহয় এই বৃষ্টি শেষেই কনকনে শীত নামবে। ড্রয়িং রুমে ছোটফুপু বসে টিভি দেখছে, কি এক সিরিয়াল হচ্ছে সেটাই অপলক দেখে চলেছে। রান্নাঘরে মা পাতিল থেকে ভাত বেড়ে ডাইনিং টেবিলে সবার থালায় থালায় বেড়ে দিচ্ছে, ছোট কাকি বাটিতে বাটিতে তরকারি তুলে দিচ্ছে। বাবা বোধহয় নিজের ঘরে বসে ঝিমোচ্ছে, মা চেচামেচি শুরু করলে তবেই খাবার টেবিলে আসবে,রোজ এই সময়ে ভাত খাওয়ার আগে মায়ের বকা খাওয়া টাও বাবার অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে।
আমি কুমু।এতক্ষণ পরিবারের সামান্য ক’জন মানুষের পরিচয় করিয়ে দিলাম,এখনও অনেকেই আছে পরিচিত হবার। বিশাল এক যৌথ পরিবারের ক্ষুদে সদস্য আমি। সবেমাত্র স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।
মা আর ছোট কাকি রান্নাঘরে কাজ করছিলো বলে দাড়িয়ে আছি সেই কখন থেকে, যদি কোনো কাজে মা আমাকে ডাকে আর আমি শুনতে না পাই তাহলে আমার একদিন কি মায়েরই একদিন। কিন্তু আজ আর তেমন কোনো কাজ না থাকায় ডাইনিং এর চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে উঁকি মেরে সিরিয়াল দেখার চেষ্টা করছি।
আমার ছোট ফুপুর নাম অপ্সরা। নামটা যেমন অপ্সরা, ছোট ফুপু দেখতেও তেমন অপ্সরার মতোনই সুন্দর। বয়স প্রায় ত্রিশ বছর হবে কিন্তু বয়সের সাথে চেহারার গ্ল্যামার কোনো অংশে মূর্ছা যায়নি একটুও। তবে ফুপুর চোখেমুখে কেমন ব্যার্থতার ছায়া দেখতে পাই আমি। শুনেছিলাম খুব চুটিয়ে প্রেম করেই বিয়ে হয়েছিল ছোট ফুপুর, এও শুনেছিলাম বিয়ে নিয়ে খুব ঝামেলা হয়েছিলো, কিন্তু এটা বুঝতে পারিনি কেনো ছোট ফুপু বিয়ের আগে তার প্রেমিক কে বিয়ে করতে চায়নি, মা কাকিদের জিগ্যেস করলে কিছু বলতেও চায়না আর আমিও শুনতে চাইনা কখনো।তবে বিয়ে হয়েছে তার সেই প্রেমিকের সঙ্গেই।
ফুপুর বিয়ে হয়েছে দু তিন বছর হবে, বিয়ের পর থেকে দেখে আসছি বছরের বেশিরভাগ সময় টা ফুপু আমাদের এখানেই থাকে,মাঝে মাঝে ফুপা নিতে আসে তবে ফুপু যেতে চায়না, আবার কখনও একাই গিয়ে ঘুরে আসে।কেমন একটা ছন্নছাড়া সম্পর্কের দায় সাড়ানো দায়িত্ব পালনের চেষ্টা যেনো।
ঐ যে সিরিয়ালের রোমান্টিক দৃশ্য টুকু ফুপু কত গভীর ভাবে উপলব্ধি করছে,অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ফুপু ঐ সুন্দর দৃশ্যে নিজেকে দৃশ্যমান করে পরিনতি না পাওয়া কোনো ভাবনায় ডুবে গিয়েছে।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ফুপু কে গিয়ে জিগ্যেস করি সবটা, কিন্তু মা জানলে দুমদাম দিয়ে দেবে ক’খানা সেই ভয়ে কিছু বলা হয়ে ওঠেনা। মা কাকিরা সবসময় বলে যেনো ফুপুর সাথে কোনো উল্টোপাল্টা বিষয় নিয়ে কথা না বলি।
ও হ্যা বলতে ভুলেই গিয়েছি ফুপুর সামান্য সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম আছে, ব্যাপারটা খুবই সামান্য, নরমালি কথা বললে কেউ বুঝতে পারবেনা। তারপরও সবাই একটু বুঝে শুনে কথা বলে ফুপুর সাথে।
ঐ তো মায়ের চেঁচামেচি শুরু হয়ে গিয়েছে। বাবা এবার শুরশুর করে খাবার টেবিলে চলে আসবে..
রোজরোজ এই ডাকাডাকি আর ভালো লাগেনা, হ্যা রে কুমু… বলছি ওভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে না থেকে তোর বাবা কে তো ডাকলেও পারিস নাকি?তোর ছোট ফুপু কেও ডেকে আনবি, দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে কখন খেতে বসবে সবাই?
এরইমধ্যে বাবা চলে এসেছে টেবিলে। আমি ছোট ফুপু কে ডাকতে ড্রয়িং রুমে গেলাম।
ছোট ফুপু হয়েছে তোমার সিরিয়াল দেখা? চলো খাবে চলো মা ডাকছে। ছোট ফুপু কোনো কথার জবাব দিলোনা, সিরিয়াল থেকে চোখ ই সরালোনা, আমিও আর কিছু জিগ্যেস করলামনা সোজা খাবার টেবিলে এসে বসলাম।
আজকে দুপুরে সাদা ভাত, সরষে দিয়ে পাবদা মাছ, চিংড়ি মোচার ঘন্ট আর ডাল রান্না হয়েছে। আমার তো পছন্দের মাছ রান্না হয়েছে আর কোনোদিকে না তাকিয়ে দুখানা পাবদা মাছ নিয়ে বেশ জমিয়ে খেতে শুরু করে দিলাম। খেতে খেতে খেয়ালই করিনি মা আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মায়ের চোখে চোখ পরতেই মা বলে উঠলো;
তোকে বলেছিলামনা তোর ছোট ফুপু কে ডেকে আনতে, তা না করেই তুই খেতে বসে গিয়েছিস? জানিসতো মানুষ টা অসুস্থ, বারবার ডাকতে হয় সবকিছুতে তারপরও একা একা খেতে বসে গেলি?
আমি তো ডেকেছিলাম মা, ফুপু মন দিয়ে সিরিয়াল দেখছিলো কথা কানেই তোলেনি আমার, আমি কি করবো বলো?
আবার মুখে মুখে তর্ক করছিস? যা আবার গিয়ে ডেকে নিয়াই এক্ষুনি।
আচ্ছা যাচ্ছি…
ও মা… শুনছো ফুপু তো কোনো কথাই বলছেনা, তখন ডেকে এলাম আবার এখন ডাকলাম তবুও কিছু বলছেনা দেখো। এখন আবার টিভির দিয়ে তাকিয়ে কেমন কাঁদছে।
কুমুর কথা শুনে ডাইনিং থেকে কুমুর বাবা কামরুল হাসান সাথে সাথে কুমুর মায়ের দিকে তাকিয়ে কি যেনো ভাবের আদান প্রদান করলেন বলে মনে হলো, কুমুর কাকি বলে উঠলো ভাবি আজ কি তাহলে আবার অমন হবে? কেউ আর কিছু না বলে দৌড়ে ড্রয়িং রুমে ছুটে গেলো অপ্সরার কাছে। কুৃুমু-র মা সালমা বেগম আর কাকি শিরিনা বেগম গিয়ে অপ্সরার কাছে গিয়ে বসে তার গায়ে হাত রেখে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। আর কুমু-র বাবা সোফার একটা চেয়ারে বসে কেমন উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে রয়েছে বোনের দিকে।
কি হলো ছোট ফুপুর? কুমু কিছুই বুঝতে পারছেনা৷ এর আগেও বেশ কয়েকবার অসুস্থ হতে দেখেছে ফুপু কে তবে এর মাঝে সে কোনো রহস্যের গন্ধ পায়নি, আজ কেনো জানি কুমু-র মনে হচ্ছে ছোট ফুপুর জীবনে কোনো বিশাল কাহিনি আছে যেটা সে জানেনা বা এতোদিনে খেয়াল করে উঠতে পারেনি, তবে আজ সেটা খেয়াল করেছে সে। বাবা মা আর কাকির চোখের চাহনিতেই বোঝা যাচ্ছে সবটা।
কাওকে আর কিছু বলার সাহস হলোনা তার। কাকি তাকে ঘরে যেতে বললে সে চুপটি করে ঘরে গিয়ে বসে রইলো সন্ধে হওয়ার অপেক্ষায়। সন্ধে হলে ছোট কাকা অফিস থেকে ফিরবে, মেজো কাকি ও অফিস থেকে ফিরবে, মেজো কাকা যদিও এগারোটার পর আসে। ওদিকে আজ বড় ফুপুর আসার কথা, তারমানে সাথে ঝিলি ও আসবে। তখন না হয় সবটা জিগ্যেস করবে সেই জন্য অপেক্ষা করছে কুমু।
চলবে…♥️