সবাই সারাদিন পর কাজ থেকে ফিরেছে তাই কুমু-র মা সোহেলী বেগম বেশ তড়িঘড়ি করে খাবার বেড়ে দিচ্ছে সবার জন্য, বাড়ির বড় বউ তিনি, সংসারের ভালো মন্দ বুঝে, শান্তি বজায় রেখে সবকিছু গুছিয়ে এক সুতোয় তিনি এই সংসার টাকে বেঁধে রেখেছেন।
ছোট ফুপু অপ্সরা এখন ঘুমিয়ে আছেন, বাড়ির বাকি লোকজন কে এখনও কিছু জানানো হয়নি। সময় সুযোগ বুঝে যা বলার সবটা সোহেলী বেগম নিজেই বলবেন।
মিনিট দশেক বাদে সবাই খাবার টেবিলে খেতে বসলে সোহেলী বেগম সবার সাথে বেশ স্বাভাবিক ভাবে সারাদিনের ব্যস্ততা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। বড় ননদ আর তার মেয়ের আসার পথে কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা সেসবই বলছিলেন। কুমু এসে মায়ের পেছনটায় চুপটি করে দাঁড়ালো। বড় ফুপু আর ঝিলি-র সাথে তার আগেই ভাব বিনিময় হয়ে গিয়েছে।
সবাই খাচ্ছে, তুমিও কি এখন খাবে?
না মা খাবোনা এখনো পেট ভর্তি হয়ে আছে।
আচ্ছা শোনো তুমি একটু গেস্ট রুমের বিছানা টা গুছিয়ে দাও বড় ফুপু আর ঝিলি ওখানেই তো শোবে।
কেনো মা বড় ফুপু যদি ছোট ফুপুর কাছে ঘুমায় আর ঝিলি যদি আমার কাছে ঘুমায় তাহলেই তো হয়ে যায়।
না.. তুমি জানোনা তোমার ছোট ফুপু একা ঘুমোতে পছন্দ করেন। যেটা বলছি করো যাও।
সবার খাওয়া শেষ, ড্রয়িং রুমে বসে সবাই টুকটাক গল্প করছে। কুমু আর ঝিলি পাশাপাশি বসে বেশ অনেকদিনের জমানো গল্প গুলো শোনাচ্ছে একে অন্যকে।
কুমু-র মা সোহেলী বেগম চা করে এনে সবার হাতে হাতে চা দিয়ে গল্পের আসর টা আরো জমিয়ে দিলেন!
কুমু,ঝিলি তোমরা ভেতরের ঘরে যাও গল্প করো, এখানে আমরা বড় রা একটু কথা বলবো এখন।
মায়ের কথা শুনে ঝিলি কে সঙ্গে করে নিজের ঘরে গিয়ে বসলো কুমু।
কুমু-র ঘর থেকে ড্রয়িং রুমের কথা গুলো শোনা যাচ্ছে;
কুমু-র মা বলতে শুরু করলো;
আজ বেশকিছু দিন ধরে অপ্সরা কেমন অন্যরকম ব্যাবহার করছে, আগের থেকে আরো বেশি চুপচাপ থাকে, কারো সাথে কোনো কথা বলেনা,কিছু বললেও উত্তর দেয়না। বোধহয় ওর সমস্যা টা একটু বেড়েছে। আমি বলি কি একবার ডক্টর এর কাছে থেকে চেকআপ করিয়ে আনাই ভালো নয় কি?
সোহেলী বেগমের কথা শুনে তার মেজো জা রুবিনা একটু অন্যরকম সুর ধরে বলে উঠলো;
রোজরোজ এসব ঝামেলা কি ভালো লাগে বড় ভাবি? তার ওপর আবার ডক্টর দেখাতে একগাদা করে টাকা খরচা হয় সেগুলো ও আমাদেরই দিতে হয়।বিয়ের পর ও স্বামী সংসার ছেড়ে এভাবে বাপের বাড়িতে পরে থেকে আমাদের হেনস্তা না করলেই কি নয়?
সাথে সাথে কুমু-র ছোট কাকা মুকুল হাসান এর আপত্তিকর প্রতিক্রিয়া;
মেজো ভাবি, ঠিক করে কথা বলো। তুমি না শিক্ষিত মহিলা, চাকরি করো, দশজনের মাঝে তোমার বিচরন তাহলে অপ্সরা কে নিয়ে এতো ছোট মানসিকতার প্রকাশ কিভাবে করতে পারো তুমি?
ননদ অপ্সরা-কে নিয়ে এমন উল্টোপাল্টা কথা বলার সাহস একমাত্র রুবিনা-ই দেখায়, যেটা তিন ভাইয়ের বা বাড়ির বাকি সদস্যদের একদম পছন্দের নয়।
ব্যাপারটা বেশি তর্কের দিকে চলে যায় তার আগেই সোহেলী বেগম বলে উঠলেন ;
আচ্ছা তোমরা আর কথা বাড়িওনা , আমাকে কথাগুলো শেষ করতে দাও।
রুবিনা…. অপ্সরা তো এ বাড়ির ই মেয়ে, আমাদের কারো বোনের যদি এমন সমস্যা থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই আমরা তাদের ফেলতে পারতামনা, তাহলে অপ্সরা-র বেলায় কেনো এমন করছি আমরা?
আমি আর তোমার বড় ভাইয়া ডক্টর এর সাথে কনসাল্ট করে অপ্সরা কে বরং চেকআপ করিয়ে আনবো, তোমরা সবাই বাড়ির সদস্য তাই তোমাদের জানালাম।
বড় ভাবি, তুমি ডক্টর এর আ্যপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখো আমি তোমার সাথে যাবো অপ্সরার চেকআপ করাতে। এই বলে হাত থেকে চা-এর কাপ টা টি টেবিলে রেখে ড্রয়িং রুম থেকে উঠে এলো রশ্নি, অপ্সরার বড় বোন রশ্নি, কুমু-র বড় ফুপু, ঝিলি-র মা, এ বাড়ির বড় মেয়ে।
ড্রয়িং রুমের কথাগুলো ঝিলি আর কুমু সবটাই শুনেছে তবে কিছু বুঝতে পারেনি তারা। তারা জানেনা কি সমস্যা অপ্সরার, তারা বুঝতে পারছেনা কেনো কিছুদিন পর পর তার চেকআপ করানোর জন্য ডক্টর এর শরণাপন্ন হতে হয়। কি হয়েছিল অপ্সরার জীবনে যে সেটা তার মানসিক সমস্যার কারন হয়ে দাড়িয়েছে? এমন কি ঘটনা রয়েছে তার অতীতে?
সেদিন আর কিছু জানা হলোনা কুমু-র। সাহস করে কাওকে জিগ্যেস ও করা হয়নি আর।
তিনদিন বাদে আজ ছোট ফুপুর চেকআপের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়েছে। সকাল সকাল বেশ তাড়াহুড়ো চলছে বাড়িতে। কুমু-র বাবা একজন আইপিএস অফিসার, মেজো কাকা একটা পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক, ছোট কাকা কনস্ট্রাকশন ইন্জিনিয়ার, আর মেজো কাকি মন্ত্রণালয়ের একজন সরকারি কর্মচারী। এই হলো বাড়ির কর্মজীবী মানুষ দের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। তাদের জন্য রোজ সকাল সকাল রান্না-র তাড়া থাকে, আজ আবার ছোট ফুপু-র চেকআপ করাতে যাবে মা আর বড় ফুপু তাই আজ তাড়াহুড়ো আরো বেশি।
রান্না শেষ করে সবাইকে নাস্তা দিয়ে দিয়েছে মা, ওদিকে ছোট ফুপু কে তৈরি হতে সাহায্য করছে ছোট কাকি।
কুমু….
হ্যা মা বলো।
তোর ছোট ফুপুর আগের চেকআপ এর প্রেসক্রিপশান আর রিপোর্ট গুলো একটু ওয়ারড্রব থেকে বের করে দে না মা। সবগুলো ঠিক করে গুছিয়ে ফাইল টা আমার হাতে এনে দিবি কেমন?
আচ্ছা মা এক্ষুনি দিচ্ছি..
কুমু সাধারনত বিশেষ কোনো কারন ছাড়া ছোট ফুপুর ঘরে যায়না, গেলেও একটু কথাবার্তা বলে চলে আসে। আজ কাগজপত্র গুলো বের করার জন্য ওয়ারড্রব ঘাটতে গিয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে ফুপু কে ডক্টর দেখানো হচ্ছে, অনেক গুলো কাগজপত্র রয়েছে, কোনটা রেখে কোনটা নেবে বুঝতে পারছেনা কুমু, সবগুলো ওলট-পালট করে দেখতে গিয়ে একটা ডায়েরি চোখে পরলো কুমু-র। মায়ের কাছে শিখেছে কারো ফোন, ডায়েরি বা পার্সনাল কিছু অনুমতি ছাড়া দেখতে নেই। কিন্তু ছোট ফুপু-র ওয়ারড্রবে কিসের ডায়েরি হতে পারে?
কুমু-র ভীষণ কৌতুহল হলো;
এক মিনিটের জন্য সবকিছু ভুলে ভয়ে ভয়ে ডায়েরির প্রথম পাতা টা উল্টেছে সে।
ওখানে প্রথম পাতায় লেখা ছিলো
“অপ্সরার বিচ্ছেদ”
লেখা টুকু পড়ে কুমু আগা গোড়া কিছুই বুঝতে পারছেনা, ছোট ফুপু-র নাম দিয়ে এটা কি লেখা? কি লেখা আছে ডায়েরির ভেতরে?
তবে কি কোনো অপ্রত্যাশিত বিচ্ছেদ এরই করুন পরিনতি ছোট ফুপু-র এই সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম? তবে কি মাঝে মাঝে তার মানসিক ভারসাম্য হারানোর আসল কারন লেখা আছে এই ডায়েরি তে?
চলবে…