পর্বঃ ১১
(২৮ অক্টোবর)
সকাল সকাল নীড় এর মেসেজ আসায় ফোনে বেশ একটা আওয়াজ হলো; বোধহয় সকালবেলা বলে আওয়াজ টা এমন জোরে শোনা গেলো,কিন্তু বুঝতে পারছিনা ফোন টা কোথায়, রোজ তো বালিশের পাশে রেখেই ঘুমাই, হাতরাতে হাতরাতে খুঁজে পেলাম বিছানার একদম শেষদিকে।মনে পরলো রাতে রাগ করে ফোন টা ছুরে মেরেছিলাম তখনই হয়তো ওখানটায় গিয়ে পরেছে।
হ্যা যেমন ভাবা তেমনই কাজ। নীড় এর মেসেজ!
শুভ সকাল অপ্সরা..
কেনো জানিনা আজ খুব ইচ্ছে করছে ওর মেসেজের রিপ্লাই করতে।একটু একটু করে টাইপ করতে করতে আমিও শুভ সকাল জানিয়ে একটা মেসেজ করেই দিলাম।
ছেলেটা বোধহয় আমার মেসেজের জন্যই অপেক্ষা করছিলো, বুঝতে পারলাম তার রকেটের বেগে পাঠানো পরের মেসেজ টি দেখে। তাতে লেখা ছিলো;
আজ আমার জন্য এই সকাল টা সত্যিই অনেক শুভ…
বুঝতে পারলাম মেসেজ টি পেয়ে তার খুশির সীমা নেই। যাইহোক আমিও আর বেশি কথা না বাড়িয়ে বিছানা ছড়লাম।
সারাদিন একবারের জন্যও ফোনের কাছে আসার সময় হয়নি, বড় ভাইয়ার কয়েকজন কলিগ এসেছিলো বাসায়, ভাবি-র সাথে অতিথি আপ্যায়নে ভীষণ ব্যাস্ত সময় পার করেছি সারাদিন। রাতে বিছানায় গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম ততক্ষণে নীড় শুভরাত্রি জানিয়ে মেসেজ করে দিয়েছে। আমিও ওর মেসেজের প্রত্যুত্তরে শুভরাত্রি জানিয়ে ঘুমোতে গেলাম।
রাত পৌনে বারোটা….
ঘুম আসছেনা। বলতে বাঁধা নেই যে ইমাদ এর কথা খুব মনে পরছে,ওর মুখটা যেনো চোখের ওপর ভাসছে। হ্যা আমি এই সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে এসেছি তা বলে পুরনো স্মৃতি নাড়া দেবেনা এমন টা তো নয়, পিছুটান থেকেই যায়।এতোগুলা দিন, এতোগুলা সময়, এতোদিনের অভ্যেস সবকিছু কি এতো তাড়াতাড়ি মুছে ফেলা যায়? কাকে প্রশ্ন করবো আমি? কে দেবে আমার এই প্রশ্নের জবাব?
যখনই এই পিছুটান গুলো আমাকে কুড়ে কুড়ে খায় তখনই ইমাদ এর ওই রাগী, কর্কশ কন্ঠের কথাগুলো আর আমার জন্য বলা ওর ঔ তাচ্ছিল্যের ভাষাগুলো যেনো আমার মস্তিষ্কের নিউরনে একটা সাইক্লোন এর সৃষ্টি করে দেয়…
বড় ভাবি ঠিকই বলেছে, যেখানে মানসিক শান্তি নেই সেখান থেকে সরে আসাই শ্রেয় কিন্তু আমি সেখান থেকে নিজেকে সরিয়েও কেনো ভালো থাকতে পারছিনা? কিসের এক অশান্তি ভেতরটা ছেয়ে আছে আমার।
তাহলে তো নীড় এর কথাগুলোও ঠিক ছিলো। ও বলেছিলো জীবনটাকে উপভোগ করার মাঝেই আনন্দ। ও বলেছিলো নামহীন কোনো সম্পর্ক যদি কারো ভালো থাকার কারন হয় তবে তাতে দোষ নেই। সত্যি কি তাই?
(২৯ অক্টোবর)
সকালবেলা। অপেক্ষা নয়, তারপর ও কিসের যেনো অপেক্ষা। এই ভাবতে ভাবতেই মেসেজ এলো। ফোনের মেসেজ আসায় আমার মনের মধ্যেও যেনো কোথাও একটা টুং করে আওয়াজ হলো, সঙ্গে সঙ্গে ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ খানা পড়ে কতক্ষণ যে চেয়ে রইলাম মেসেজের দিকে আজও।তারপর আমিও শুভ সকাল জানিয়ে প্রত্যুত্তর দিলাম।
(৪ই নভেম্বর)
সাতদিন হয়ে গেলো,, রোজ সকাল আর রাতে ঘুম থেকে উঠে আর ঘুমোতে যাওয়ার আগে আমার আর নীড় এর নিয়ম করে শুভ সকাল আর শুভরাত্রি এই দুখানা মেসেজের মাধ্যমে ভাবের আদান প্রদান হয়ে চলেছে।
আজ সকলে সেই প্রহর শেষ হতে চলেছে, আমিও অপেক্ষা করে চলেছি কিন্তু মেসেজ আর আসছেনা।
সকাল পেড়িয়ে দুপুর গড়ালো কিন্তু আজ একমাস ধরে নিয়ম করে আমায় শুভ সকাল জানানো কারো মনের সেই বার্তা খানা কোনোভাবে নিয়ম ভঙ্গ করে আজ আর আমার কাছে পৌঁছলোনা। নিয়মের ব্যাতিক্রম দেখে আমারও কেমন অস্থিরতা কাজ করছে ভেতরে। সে আমার কিছুই হয়না তারপর ও “আজ তার কি হলো”এই প্রশ্ন টা বারবার মাথায় কড়া নাড়ছে।
তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো, আমার মনের অস্থিরতা কেমন জানি বেড়েই চলেছে,বেড়েই চলেছে।আমার অস্থিরতা সামলাতে না পেরে আমি নীড় এর নাম্বারে একটা কল করে বসলাম।
ফোন টা বন্ধ বলছে…..
জানিনা নীড় এর ফোন টা বন্ধ দেখে মনের মধ্যে অশান্তি আরো বেড়ে গেলো।
বেশ কয়েকবার ফোন করলাম। একবার, দুবার, তিনবার, বারবারই ফোনটা বন্ধ বলছে।
বিকেল পেড়িয়ে সন্ধে হয়ে গেলো তারপর সন্ধে পেড়িয়ে রাত, কিন্তু ফোনে আর না কোনো মেসেজ এলো আর কোনো কল।
এখন রাত দশটা বেজে একান্ন মিনিট। আমি না চাইতেও তার অপেক্ষায় সারাদিন কাটিয়ে শেষ করলাম আজকের ডায়েরি লেখা।
(৫ নভেম্বর)
খুব ভোরে উঠে নীড় এর নাম্বারে কল করলাম। এখনও ফোনটা বন্ধ-ই বলছে। তবে কি নীড় এর কোনো বিপদ হয়েছে? নাকি ও ইচ্ছে করে এমন করছে? আমার সাথে আর যোগাযোগ রাখবেনা বলেই হয়তো এমন করছে।
হবে হয়তো তাই…
আমিও আর ওসব চিন্তা না করে বিছানা ছেড়ে উঠে পরলাম।
ঘড়িতে সকাল ন’টা বাজে। ঘরে ফোন টা বেজে চলেছে। আমি বাইরে সিঁড়ির ওপর বসে হালকা রোদ পোহাচ্ছিলাম। কে আর ফোন করবে বোধহয় বড় ভাইয়া। আমাকে না পেলে ভাবির ফোনে ফোন করে নেবে এই ভেবে আর ফোন ধরতে যাইনি।
প্রথমবার কল কেটে গেলে আবারও বাজতে শুরু করলো।এবার বাধ্য হয়ে উঠে গেলাম, ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো;
শুভ সকাল অপ্সরা…
কন্ঠ শুনে বোঝার বাকি রইলোনা এটা নীড় এর গলা। কারন এর আগেও আমি ফোনে ওর গলাটা শুনেছি।
ওর গলা শুনেই ইচ্ছে করছিলো ওকে জিগ্যেস করতে, কি হয়েছে আপনার? দুদিন হলো আপনি আমাকে মেসেজ করেননি, ফোনটাও বন্ধ, কি ব্যাপার বলুনতো?
কিন্তু না মনের কথাগুলো চেপে রেখেই খুব স্বাভাবিক ভাবে তাকে বললাম;
হুম শুভ সকাল…
কেমন আছেন অপ্সরা?
এইতো আছি…
দুদিন হলো আপনাকে মেসেজ করতে পারিনি,আপনি কি মন খারাপ করেছেন?
আপনার মেসেজ আমার মনের ওপর ভালো খারাপ প্রভাব ফেলেছে বলে আপনার মনেহয়?
হুম আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে আমার রোজকার মতো মেসেজ না পাঠানোতে কেউ একজন মন খারাপ করেছে, অনেক ভেবেছে সে আমায় নিয়ে।
আমি আর কোনো উত্তর দিলামনা ওর কথার। সত্যি তো এটাই যে ওর মেসেজ না পাওয়াই আমার মনে কিছু প্রভাব পরেছে-ই।
কার নাম্বার এটা?
আমার বন্ধুর নাম্বার এটা।আসলে গত পরশুদিন রাতে খুব জরুরি একটা কাজে বেড়িয়েছিলাম, বাইক চালাচ্ছিলাম আমিই, সঙ্গে ছিলো আরেকজন বন্ধু, গল্প করতে করতে বেখেয়ালে দু’সিডেন্ট হয়ে গিয়েছে বুঝলেন?
দু’সিডেন্ট মানে??
বুঝলেননা?? একা হলে তো এক্সিডেন্ট করতাম যেহেতু দুজন ছিলাম তাই দু’সিডেন্ট ই তো বলা চলে নাকি?
নীড় এর কথা শুনে কখন যে আমি বেশ জোরে করে হেসে উঠেছি টেরই পাইনি। ছেলেটা সত্যিই আধ্যাত্নিক কথা বলে বটে!
পেছন ফিরে দেখি বড় ভাবি দাড়িয়ে আমাকেই দেখছে,বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম! বড় ভাবি ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছে
কি… কার সাথে এতো হাসাহাসি হচ্ছে শুনি? ভাবিকে কি বলবো বুজতে না পেরে বলেই দিলাম আমার একজন বন্ধু-র সাথে কথা বলছিলাম।
ফোনের ওপাশ থেকে নীড় বললো;
সত্যি করে বলুন তো কি হই আমি আপনার?
মিথ্যে করে বলছি কিছুই হন-না আপনি আমার। এবার বলুনতো কেমন আঘাত লেগেছে? খুব সিরিয়াস ইনজুরি নয়তো?
না তেমন সিরিয়াস ইনজুরি নয় তবে পরে গিয়ে ফোনটা ভেঙে গিয়েছে, আর মাথায় বেশ লেগেছে বলে কাল সারাদিন একটু বেহুশ ছিলাম যার জন্য আপনাকে জানাতে পারিনি। আজ অনেকটা ভালো।
বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর বুঝতে পারলাম নীড় ওর যে বন্ধুর ফোন থেকে কথা বলছে, সে বোধহয় ফোন এর জন্য তারা দিচ্ছে। তাই বললাম আজ বরং রাখছি, আপনি এখন বিশ্রাম নিন।
ফোন রাখার পর বেশ অনেক্ক্ষণ ধরে একটা প্রশ্নই জাগছে, আচ্ছা আমার কি মানুষ টাকে একবার দেখতে যাওয়া উচিত। হসপিটালের ঠিকানা টাও নেওয়া হলোনা।
দুপুর হয়ে গেলো, কেনো জানি কিছুতেই মন বসছেনা।
বিকেল পাঁচটা….
হসপিটালের ২০৬ নাম্বার রুমের ঠিক মাঝখানের বেড টিতে শুয়ে থাকা মানুষ টা আমায় দেখে ভীষণ অবাক হয়ে হকচকিয়ে উঠতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলোনা। বোধহয় বেশ জোড় লেগেছে। আমার তাকে দেখতে আসাটা বুঝি তার ধারনার একদম ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলো।তাইতো আমাকে দেখে চোখ দুটো কেমন ছানাবড়া করে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
আচ্ছা ঝিলি বলতো ছোট ফুপু হসপিটালের ঠিকানা টা কোথায় পেলো? সেটা তো লেখেনি।
আমার মনেহয় পরে লিখেছে সেটা। বাকিটা পড় দেখি
চলবে….♥️