শ্রদ্ধেয় প্রিয় কবি কাজী আতীক ভাইয়ার অসাধারণ দুটি কাব্য গ্রন্থ ১ আলোর নেকাব ২/ প্রেম অপ্রেমের বাস গৃহে

মৌসুমী পুলেন

শ্রদ্ধেয়
প্রিয় কবি
কাজী আতীক ভাইয়ার
অসাধারণ দুটি কাব্য গ্রন্থ

১ আলোর নেকাব
২/ প্রেম অপ্রেমের বাস গৃহে
আসলে একটা কবিতার বইয়ের সব কবিতাই যে সমান গ্রেড পায় এমনটা কিন্তু খুব কম হয় । এতো চমৎকার সবগুলো কবিতা যা যে কোনো পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যাবে ! আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কবিতায় মগ্ন ছিলাম মনে হয়েছে আর একটু দীর্ঘ হতে পারতো কিংবা আরো কিছু কবিতা থাকতে পারতো!
আমি এখানে প্রিয় লাইন আবার অংশবিশেষ প্রকাশ করেছি তবু যেন মন ভরছিলো না, মনে হচ্ছিলো বইয়ের সব কবিতা আপনাদের সাথে যদি শেয়ার করতে পারতাম ।

কবি কাজী আতিক এর জন্ম ১৬ মার্চ ১৯৫৭ সালে সিলেটের মৌলভীবাজার।  ১৯৯৪ থেকে ২০০৫ যুক্তরাজ্য, তারপর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্থায়ী প্রবাস জীবন। তাঁর মানবিক গুণাবলী, ব্যাক্তিত্ব, কর্মজীবনের সফলতা , লেখালিখি এই সব মিলিয়ে আমি বলবো তিনি সিলেটের কৃতী সন্তান।স্কুল জীবন থেকে শুরু হয় তাঁর কবিতা লেখা কবিতা প্রেমি হয়ে ওঠা। অসংখ্য বই প্রকাশ হলেই যে কেউ কবি বা লেখক হবেন বিষয় কিন্তু তা না । মানসন্মত লেখার একটি বই-ই অনেক সময় এক জীবনের জন্য যথেষ্ট।
– আজন্ম উদ্ভ্রান্র জনান্তিকে এর পর
আবার তিনি কবিতাকে আরো আরো সমৃদ্ধ করে আরো নতুন মাত্রা যোগ করে প্রকাশ করলেন
– আলোর নেকাব
– প্রেম অপ্রেমের বাসগৃহ
আলোর নেকাব //
আলোকে পেছনে রেখে যে তুমি
দাঁড়িয়ে সমুখে
চেহারা রেখেছো ঢেকে আলোর নেকাবে-
মৃদুবাতাস চুলে ঢেউ খেলে রাশি রাশি
যেনো পৃথিবী রেখেছে ঘিরে শ্রাবণের
বাদল অন্ধকার
যদি অস্পষ্ট প্রতিসরণ যেমন ঢেউ খেলে জলের ভেতর
কি করে চিনবো তোমাকে আমি
আসলে কে তুমি ?
দুর্জন পরিব্রাজক নাকি ” বনলতা শ্রাবস্তির কারুকাজ”
“বনলতাসেন জীবনানন্দ এর এক শক্তি সৃষ্টির কাল্পনিক চরিত্র ”
কবি এখানে আলোর নেকাবে আবৃত অন্ধকার কে দেখতে চান নি, খুঁজেছেন স্পষ্ট উত্তর খুঁজেছেন তার কাল্পনিক
জ্যোতির্ময় ছায়া যা কিনা তাঁর অন্তরকে আচ্ছন্ন রাখে। কি চমৎকার প্রকাশ !
” আসলে আমরা মূলত অর্বাচীন দলভুক্ত
তা’ না হলে বার বার কেনো আমাদের সাথেই এমন হবে ?
যেমন- আমরা তখনো সুখ সুখ ভাব নিয়ে নির্বোধ নিশ্চিন্ত ঘুমে, যখন ওরা সদর
দরোজা দিয়ে এসে নির্মম অনায়াসে আমাদের পিতাকে হত্যা করেছিলো”
“আমরা নির্বোধ নিশ্চিন্তে তাই ওরা নির্মম অনায়াসে ”
কবিতার অংশবিশেষ আলোর নেকাব কাব্য গ্রন্থ থেকে …
কবি গভীর উপলব্ধি, মর্মে গেঁথে রাখা কষ্ট অভিমান থেকে তিনি প্রকাশ করেছেন এমন পঙক্তি। সেই নির্মমতা আজো তাঁকে কষ্ট দেয় প্রশ্নবিদ্ধ করে কেনো এমনটা হতে হলো?
যে তোমাদের সেই বজ্রকণ্ঠের ভাষণে তুলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার মূলমন্ত্র আর আমরা কিনা তাঁকেই!!! অসম্ভব সুন্দর ও চিরসবুজ একটি কবিতা ।
পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় কবি স্মরণ করেছেন প্রয়াত প্রিয় কবি শহীদ কাদরী কে
//আমি দূর থেকেই দেখি তাঁকে//
আলোর নেকাব
“আলপথে হেঁটে যায় একতারা সাধু
নেই গেরুয়া বসন পরনে তাঁর”
তাঁকে আমি হেঁটে যেতে দেখি, কখনো দিগন্ত ছুঁয়ে, কখনো মহাকর্ষ বলয়ের কিনারা ঘেঁষে আমি কেবল তাঁর অপসৃয়মান
ছায়াটাই দেখি
তাঁর গান তাঁর কথা বুঝিনা কিছুই।
কেবল এক তুমুল আকর্ষণ তাঁর গায়কীতে….
হায় -যদি এই অপসৃয়মান ছায়াটি আবার
অবয়ব ফিরে পায় !
সম্পূর্ণ কবিতা জুড়ে রয়েছে অপূর্ব শব্দের কারুকাজ ! এক গভীর বেদনা
যেনো কবি তাঁকে দেখতে পেয়ে থাকেন
তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘুমে, অথবা ধ্যানে, কাল্পনিক বলয়ে তিনি যেনো শ্রদ্ধেয় কবি শহীদ কাদরীকে তাঁর মতো করে খোঁজেন !
অনুভব করেন সেই শূন্যতা ! আমার চোখ ভিজে উঠেছে এমন এক দুর্দান্ত চিত্র কল্পে
দ্বিধা ,কবিতার অংশ বিশে,
( আলোর নেকাব)
যেতে চাই, যাই আবার যাই না যেন
ভয়! যদি পাছে তুমি- ওদেরই একজন
ভাবো আমাকে, ওদেরই মতো কেউ?
আর আসলে তুমি তা ভাবতেই পারো,
কেনো না আমাকেও দ্যাখায় অবিকল
ওদেরই মতো ।
কবি এখানে নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেন
বাস্তবতার দ্যাখা না দ্যাখার চিত্র
বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমনটা হয়, বিশেষ করে
যখন আমরা মানুষের মতামত, আলোচনা
সমালোচনার মূল্য দিই বা তোয়াক্কা করি
তখন ঠিক এমন করেই চিন্তা করি । অত্যন্ত চমৎকার একটি কবিতা ! পুরো কবিতার জুড়ে মুগ্ধতা, প্রতিটি লাইনই কবিতা !!!
ঠিক এভাবেই কবি লিখে যান পাঠকের অনুভূতি ।
হৃদয় / (আলোর নেকাব)
হৃদয় প্রমত্ত এক নদী
বাধাহীন নিরবধি
অনাদি আকুলতা
ভেসে যাওয়া প্রান্তর
কি দুর্দান্ত পঙক্তি !! হৃদয় কেবল তার মতোই
চলে,যেখানে স্থির হয় সেই আকুলতা বয়ে বেড়ায় আজন্ম ।সে আমরা যেমন ভাবেই দেখি যে ক্ষেত্রেই হৃদয়ের বিশ্লেষণ করি।
তবু ব্যতিহার
বিব্রত বোধে
সময়কে পিঠে বেঁধে
চলেছো তুমি
উন্মাত্ত নদী এক বইছে হৃদয়ে।
ভীষণ রকম মুগ্ধকর এক কবিতা যা কিনা প্রতিটি পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করবে !
শিশির নোলক মুগ্ধ লেখা… আলোর নেকাব
আমি অপরাজিতায় লগ্নী রেখে নীল
শিশির নোলক এনেছি
তুমি নেবে কি
কেবল তোমাকেই মানাবে জানি।
আমি মুগ্ধ দেখার চোখের চাওয়া
তোমার চোখে রেখেছি
তুমি তাকাবে কি ?
কেবল তোমাকে আঁখিতে রাখি ।
আমি রৌদ্র দুপুর খরতাপ পেরিয়ে
প্রণয় সন্ধ্যা সাজিয়েছি
তুমি আসবে কি ?
কেবল তোমাকেই খুঁজেছি আমি ।
এই ছিলো সেই সেদিনের আঁকা স্বপ্ন – বেলা
প্রণয় সন্ধ্যা শিশির নোলক আর মুগ্ধ দেখা ।
অপূর্ব সুন্দর প্রেমের কবিতা আমি বলবো !
আসলে কবি হলেন আজন্ম প্রেমিক,
তাঁকে প্রেমিক হতে হয়, প্রকৃতি প্রেমিক,
শব্দ প্রেমিক । কবির প্রেম সকল সৃষ্টি সুন্দরে
যিনি সৃষ্টি করেছেন এ সংসার কবি তাঁর মনের চোখে মাধুরী মিশিয়ে দ্যাখেন !
যেন সে তাঁর প্রেয়সীকে যত্ন করে বলছে আমি নীল শিশির এনেছি
তুমি নেবে কি ? যেনো এখানে তিনি ফুটিয়ে
তুলেছেন বা বোঝাতে চেয়েছেন যে প্রেমই
হোক তা হোক নিখাত !!
অনঙ্গ সংলাপ… আলোর নেকাব
তোমার কি সময় হবে- যদি বলি আরো
কিছুক্ষন থাকো
অবশ্য যদি তাড়া থাকে যাবার
তবে না হয় আজ থাক
আবার কখনো যখন এ পথ দিয়ে যাবে
যদি মনে পড়ে কিছু-যদি থমকে দাঁড়াও
যদি ইচ্ছে হয়- নাহয় সেদিন
একটু বসে যেয়ো আবার।
এই কবিতাটি পড়ে আমার চোখের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে …! যখন মানুষ জাগতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যান আপন নিবাসে
কবি যেনো সেই তাঁদের আকুতি অনুভব করেছেন। আমরা যখন কোনো মৃত ব্যাক্তির
ঠিকানার পাশ দিয়ে যাই আমরা শুনতে
পাই না .. শ্রদ্ধেয় কবি কাজী আতিক পুরো কবিতা জুড়ে এমন নিখুঁত বর্ণনা করেছেন
তা অদ্ভুত মর্মভেদী। প্রিয় পাঠক এক’শ কবিতার বই না কিনে ভালো বই দশটা পড়া
উত্তম ।
হৃদয়ে আগলে রাখি প্রিয়া অনুরাগ/
(আলোর নেকাব)
আগলে রাখি অনুভব
শীতের শিশির ভোরে
নীল ঘাস ফুলের মতো প্রিয়তম ইচ্ছেগুলো,
আর সেই তোমাকে
যে তুমি আজো আছো
আমার লেখা- না লেখা সব কবিতায়
হৃদয়ে আগলে রাখি প্রিয়া অনুরাগ।
অপূর্ব অপূর্ব কবিতা !!! কবি আজীবন লিখেন সবার কথা কিন্তু নিজের সব
কথা,ব্যাথা বেদনা প্রকাশ করেন কি ? আসলে হয় না । ভালোবাসা আগলে রাখার,যত্ন করে সোনালী রিবনে বেঁধে হৃদয়ে
শোকেসে সাজিয়ে রাখার। ইচ্ছে থাকে কত কি বলার তবু আর হয়ে ওঠে না । তিনি ব্যাক্ত করেছেন সমস্ত প্রেমিকের কথা ।
নারী / আলোর নেকাব
নক্ষত্রের অধিকারে আছে নিজস্ব আলো
তবুও অনুজ্জ্বল- উপগ্রহ চাঁদের চেয়েও
আকাশে মিটি মিটি দেখা যায় কেবল।
নারীও নক্ষত্রের মতো মনে হয় প্রভাহীন
আসলে নারীই কেন্দ্রে থাকে সংসারের
তাঁকে ঘিরেই আবর্তমান বাদবাকী সব ।
এতো চমৎকার বিশ্লেষন করেছেন নারীর অবদান সংসারে যা অতুলনীয়। আমি মুগ্ধ তার সকল বিষয়ে দূরদর্শীতা বিচক্ষনতা
তাঁর সকল কবিতায় স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ করেছেন কবির আবেগ অনুভূতি, সমাজ সংস্কৃতি যা অবশ্য।
ওদের এবার আসতে দাও/
(প্রেম অপ্রেমের বাসগৃহে)
অংশ বিশেষ কবিতা
এই নগরীর নগ্ন বুকে আবাস যাদের
বিত্ত বৈভব সর্বগ্রাসী লিপ্সা যাদের
সেই মুখোশ পরা মানুষগুলোর
মুখোশ খুলতে হলে
সব মুখোশদারিরই নগ্ন পিঠে
শক্ত হাতে চাবুক চালাও।
চাবুক চালাও নিজের পিঠেও
তোমরা যারা হতবুদ্ধি মানুষগুলো।
……
চলতে চলতে হোঁচট খাওয়া মানুষগুলো
সব নগরীর রং বদলের চাকা ঘুরায়
তবু তারা পাওনাটুকু পায় না বুঝে
পায় না খেতে ।
অসাধারণ এবং অসসধারণ একটি কবিতা
মনে হয় যেন কবি আমার কথা এ রকম আমাদের অনেকের না বলা তিনি বলেছেন!
মেহনতি মানুষের শ্রমের ঘামে বিত্ত বৈভবের কাঞ্চনজংঘা গড়ে তোলে অথচ এক তুমুল বিভেদের দেয়াল তুলে রেখেছে মাঝখানে
অথচ আমরা কেবল মেনেই নিচ্ছি। যাদের মুখের আড়ালে লুকানো মুখ বুঝেও কিছু যারা বলছে না কবি চরম আক্ষেপে দুঃখে
প্রকাশ করেছেন এমন একটি অসাধারণ লেখা !! এমন করেই তো কবি হয়ে ওঠেন সমস্ত বঞ্চিত,নিপীড়িত মানুষের।
আমি তাঁকে কুর্ণিশ জানাই।
জন্মভূমি/
( প্রেম অপ্রেমের বাসগৃহে)
একটুখানি হেঁটে গেলেই সামনে নদী
পেছন থেকে ঝাপটে ধরে চৈতি বাতাস
বৈশাখী ঝড়,
মিষ্টি বউয়ের হাসির মতোই বাদলা দিনের
বিজলী চমক ।
একটু খানি এগিয়ে গেলেই সামনে
আকাশ,মৃদু বাতাস,
সাগর সেঁচা মানিক আমার
পাহাড় ঘেরা দেশখানি
একটুখানি সামনে গেলেই
ভালোবাসার সোনার খনি ।
যার বুকে এমন মাতৃআঁচল বিছানো সে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেনো মাতৃভূমির টান তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়;
নয় তো এমন মধুর আবেগ প্রকাশ করে কবিতাকে এতোটা সমৃদ্ধ করতে পারতেন না ।
অবশেষ প্রেম/ কবিতার অংশ বিশেষ
প্রেম অপ্রেমের বাসগৃহে
যখন দেখলাম তুমি দিক বদল
করতে চাইছো
বাকীটা পথ তো হাত ধরেই
পৌঁছে দিয়েছি আমি ।
অনেকটা হঠাৎ ক্ষেপে ওঠা একজন
শিল্পীর মতোন
যে তার নিজ হাতে গড়া প্রতিমা
ভাঙে হাতুড়ির আঘাতে।
এটা একটা সুদীর্ঘ কবিতার অংশবিশেষ
অপূর্ব সব শব্দ বিন্যাসে কবি মনের
মাধুরী মিশিয়ে নির্মাণ করেছেন এই কবিতা খানি ।।
ভালোবাসার মানুষ যখন নিজে থেকে বদলে যায় তখন তাকে পরিবর্তনের হাওয়ায় ভাসতে দিয়ে তাঁর প্রাণ প্রশান্তিতে ভরে দেয়া সে অনেক অনেক কঠিন ত্যাগ! অনেক বড় মনের অধিকারী
না হলে এটা সম্ভব নয় !! আমি যত তাঁর কবিতা পড়ি আর ডুবে যাই কবিতার গভীরে !
লিখেছেন তিনি তাঁর স্নেহভাজনদের নিয়ে
ছেলে মেয়ে কে নিয়ে একজন বাবা আর একজন কবি যেন মিলেমিশে একাকার!
আমি অনেক অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি
শ্রদ্ধেয় প্রিয় কবি কাজী আতীক তাঁর এমন অপূর্ব লেখা পাঠ করা সুযোগ দিয়েছেন।

লেখক : মৌসুমী পুলেন

Mousumee Pullenকাজী আতীকমৌসুমী পুলেন
Comments (0)
Add Comment