“ভালবাসার চিলেকোঠা ” – তানিয়া শারমিন মিতু

অভিক ছিল স্কুলের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। শুধু তাই নয় পড়াশোনা ছাড়াও অন্যান্য কো-কারিকুলাম এক্টিভিটিতেও ছিল দারুন পারদর্শী। সব সময় থাকত হাসি মাখা মুখ। স্কুলের প্রতিটা প্রোগ্রাম এ সে ছিল সবার মধ্যমনি। নাচ গান দিয়ে মাতিতে তুলতো সবাইকে। অভিক যখন দশম শ্রেণী তে তখন তার জীবনে ঘটে সব চেয়ে বড় ট্রাজেড। সড়ক দুর্ঘটনায় সে হারায় তার মা বাবাকে। অভিকের সব স্বপ্ন যেন ভাংগার পথে। এত কিছুর পরও অভিক এস.এসসি তে কৃতিত্বের সাথে জিপিএ ৫.০০ পেয়ে উত্তির্ন হয়। গ্রামে অভিকের আর কেউ নেই। স্কুল জীবনের ইতি টেনে শহরে তার চাচ্চুর বাড়ি এসে ঠাই নিল। শুধু কলেজ নয় ভার্সিটি জিবনের ইতি টানা পর্যন্তও অভিক তার চাচ্চুদের বাড়িতেই থাকল।
অভিকের একটা চাচাতো বোন ছিল। পরীর মত দেখতে। নাম তার অধরা। এই নতুন পরিবেশে একমাত্র বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়েছে অধরাকে। অধরা বন্ধু হিসেবে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাকে।

অভিক ঢাকা ভার্সিটির ফার্মেসিতে চান্স পেল। সন্মানের সাথে ৪ আউট অফ ৪ পেয়ে তার গ্রাজুয়েশন শেষ করল সে। এর মাঝে তাদের মধ্যে এত বছরের বন্ধুত্ব যে কবে প্রেমে পরিণত হল দুজন বুঝতেও পারল না। যখন বুঝতে পাড়ল তখন দুজন দুজন কে বলবে বলবে করে বলেই উঠতে পারছিল না দুজন। এই এতগুলো বছর যে মেয়েটি তাকে সাপোর্ট করেছে, পাশে দাড়িয়েছে, যার সকলকিছু নিজে পছন্দ করে কিনে দিয়েছে তাকে ছাড়া অভিক কিভাবে থাকবে।

মাঝে মাঝে অধরাকে স্বপ্নে নিজের মত করে সাজায় অভিক। অভিকের অনেক ভয় হয় অধরাকে বললে যদি অধরা তাকে না মেনে নেয় তাকে যদি রিফিউজ করে দেয়, রেগে গিয়ে যদি কথা বলা বন্ধ করে দেয়। অভিক ডিসিশন নিল চাকরি পেলেই সে অধরা বলবে, বলবে অধরাকে ঘরের বউ করতে চায়।। বড্ড ভালবাসে সে অধরাকে।

আজ অভিকের চাকরির ভাইভার ফলাফল দিবে। অভিকের অনেক দুঃচিন্তা হছে যদি চাকরিটা তার না হয়, কি হবে তাহলে, কিভাবে অধরার সামনে দাড়াবে, কিভাবে বলবে সে তার মনের কথা। ইতোমধ্যে তার ফোনটি বেজে উঠল।ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠল- আপনি কি অভিক বলছেন? অভিক- জি বলুল। আপনার চাকরি হয়ে গেছে। আগামী মাস থেকে আপনি জয়েন দিতে পারেন। অভিকের আনন্দ দেখে কে। মন চাইছে দৌড়ে গিয়ে অধরাকে বলতে – চাকরিটা তার হয়ে গেছে। এখন বউ করে ঘরে তুলতে চায় তাকে। আজ অভিক অধরাকে সব বলবে, মনের ভিতর লুকানো কথা গুলো আজ যে তাকে বলতেই হবে।

এদিকে অধরাও অপেক্ষা করে বসে আছে কখন অভিক আসবে আর সেও আজ যত কথা আছে বলে দিবে অভিক কে। বলবে সে অনেক ভালবাসে অভিককে। প্রথমে বন্ধু হিসেবে পাশে দাড়ালেও এই বন্ধুত্ব যে কবে প্রেমে পরিণত হয়েছে অধরা তা বুঝতেও পারেনি।

এদিকে কিছুদিন হল গলা দিয়ে রক্ত পড়ছে অধরার। শরীরটা কেমন যেন ভালো যাচ্ছেনা। কিছু মেডিকেল টেস্ট করাতে দিয়েছে নিজে নিজেই তার পরিচিত ডাক্তারের কাছে। হঠাৎ ডাক্তার তাকে হাসপাতালে ডেকে পাঠালেন। সে হাসপাতালে পৌঁছে রিপোর্ট গুলো হাত নিয়ে দেখতেই যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। সে সুখের মুখ দেখবে বলে আজ অধরা স্বপ্নে বিভোর সেই স্বপ্নগুলো আজ এভাবে ভেঙে যাবে সে তা কল্পনাও করেনি। রিপোর্ট নিয়ে অধরা দৌড়ে বাড়ি চলে এসে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।

হঠাৎ তার দরজার ওপাশ থেকে অভিক বলে উঠল অধরা দরজা খোলো। চোখের জল মুছতে মুছতে অধরা দরজা খুলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখল যাতে অভিক বুঝতে না পারে অধরার মনের অবস্থা। দরজা খুলতেই আচমকা অধরাকে কোলে তুলে নিল অভিক। আনন্দে বলতে লাগল চাকরিটা সে পেয়ে গেছে। তার স্বপ্ন যে পূরণ হয়েছে কোল থেকে নামিয়ে হাটু গেড়ে অভিক বলে উঠল – তুমি আমার ঘরের বউ হবে।
অধরা মনে মনে তো এটাই চাচ্ছিল। আজ সকাল অব্দিও এই প্রেমের বাশি তার মনে বাজছিল। হাতে পাওয়া রিপোর্ট সব বাঁশির সুর কেড়ে নিয়েছে। মনের ভিতর পাথর বেধে অধরা অভিককে অপমান করতে শুরু করল। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল তাকে। কোনো দিন তার মুখ দেখতে চায় না এসব বলে দরজাটা বন্ধ করে কাদতে শুরু করল। অধরা জানে সে আর বাঁচবে না। তার হাতে যে আর বেশি দিন নেই।
১৫ দিন পার হয়ে গেল। অভিক চাইলেও আর অধরার কাছে যেতে পারছে না। তাকে ফোন দিতে পারছে না। অধরা যে তার মুখ দেখতে চায় না বলেছে।

এদিকে অধরার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। একদিন অবস্থা গুরুতর হওয়াতে তাকে হাসপালতালে নিয়ে যাওয়া হল। এ খবরটি পেয়ে অভিক দৌড়ে গেল হাসপাতালে। দরজার পাশ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে অভিক অধরাকে দেখছে আর তার চোখ দুটি থেকে পানি পড়ছে অঝোরে। অধরার কাছে যাওয়ার সাহস যে তার নেই।

অধরার এসব দৃষ্টিগোচর হলন। হাত দিয়ে ইশারা দিতেই ছুটে গেল অভিক অধরার কাছে। অধরার হাতটিতে চুমু একে অভিক বলতে লাগল কিচ্ছু হবে না তোমার,,,, অধরা কান্নাজড়িত গলায় বলে উঠল সেদিনের ব্যবহারের জন্য দুঃখিত। আমি চাচ্ছিলামনা যে স্বপ্নগুলো কখনো সত্যি হবার হয় সেই স্বপ্ন তোমাকে দেখাই কি করে। আমি যে বাঁচবনা অভিক। তোমাকে যে বড্ড ভালবাসি। তোমাকে যে পাওয়া হলনা আমার। এ কথাটি বলতে বলতে ধরা চিরতরে বিদায় নিল অভিকের কাছ থেকে।

অধরাকে না পেলেও অধরার স্মৃতি নিয়ে আজও বেঁচে আছেন অভিক। অধরার প্রতি ভালবাসা তার একদমই কমেনি৷ অভিক আজ ৭০ এ পা দিলেও এতগুলো বছর কাটিয়ে চলেছেন অধরার নিজ হাতে গড়া বাড়ির চিলেকোঠায়। অধরার দেয়া সব বই আজ তার সঙী। সব বই সে আজও যত্নে রেখেছেন। চিলেকোঠায় দাড়িয়ে সে আজও কবিতা আর গল্প লিখে অধরাকে নিয়ে। এই চিলেকোঠা, কবিতা, গল্প, আর অধরার রেখে যাওয়া সব স্মৃতিই আজ অভিকের বাঁচার একমাত্র সম্বল।

তানিয়া শারমিন মিতু
Comments (0)
Add Comment