মুরাদ মিয়ার পরিবর্তন
ক‘ দিন আগে মুরাদ মিয়ার নির্জন বাড়িতে পা রাখাতে রাখতে রবীন্দ্রসংগীতের সুর কানে এসে আমাকে তেমনটই হতভম্ব করল, যেমনটি ঘটেছিল আজ থেকে পঞ্চান্ন বছর আগে, এলাকায় কামেল পির হিসেবে বিদিত, মুকাদ্দেস রহমাতুল্লা আলাইহির বয়ান শুনে। তিনি কবরাযাব ও কেয়ামতের বয়ান করছিলেন। সেটা স্কুলজীবনে, যখন আমি দশম শ্রেণীতে পড়ি। মুরাদ আমার সহপাঠী। তবে আজকের হতভম্ব-দশা সেদিনের বিপরীত মেরুর।
উত্তরা থেকে গাড়ি নিয়ে যখন বের হই, দিয়াবাড়ির বিস্তিৃর্ণ বালুময় প্রান্তরে শরৎ-শিশিরে ভিজা কাঁশফুলগুলো ভোরের কুহেলি মেখে যবু-থবু হয়ে মৃদু দুলছিল। ফাঁকা রাস্তায় সল্পক্ষণে বিরুলিয়া ব্রীজ পেরিয়ে কিছুদূর গিয়ে বাঁয়ে টার্ন নিয়ে পৌঁছে গেলাম শ্যামপুরের গোলাপ গ্রামে।
উঁচু-নিচু টিলাময় ভূমি জুড়ে আদিগন্ত গোলাপ চাষ। ফুটেছে গোলাপি, লাল, কিংশুক-রক্তিম সব ফুলরাণী। মাঝে মাঝে ছায়াঘেরা এক একটা বৃক্ষ স্তব্ধ প্রহরীর ন্যায় নীরবে দাঁড়িয়ে। তাদের দিকে চেয়ে আছে গোলাপ কুমারীরা। এখান থেকে গোলাপ চলে যায় রাজধানী ঢাকায়, শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে। প্রতিদিন যায়, প্রতিদিন ফুরায়। তবুও ঢাকা শহরে গোলাপের চাহিদাশেষ হয় না। ঢাকা শহরের যে প্রেমের শহর ! এখানে প্রত্যহ লক্ষ প্রেমিক ফুল দেয় প্রেমিকার হাতে। টাটকা গোলাপ। ঢাকা শহরে পথশিশু থেকে মন্ত্রীপড়ার আলিশান প্রাসাদবাসী বৃদ্ধ মন্ত্রীদের হৃদয়ও টাটকা প্রেম, যা টাটকা গোলাপের মতো লাল হয়ে থাকে। নগরের নটিনীরা মসজিদের পাশ দিয়ে খোপায় গোলাপ গুজে অভিসারে বের হন।
শ্যামপুরের নির্জন রাস্তা দিয়ে আরো কিছু গভীরে গেলে জেভিয়ার ঘাসে ভরা দুগ্ধখামারিদের গোচারণ যেখানে শুরু, তার সবুজ কোল ঘেসে নবীন আমের বনে ঘেরা যে দ্বিতল বাড়ি, মাঝে দু চারটা তাল-নারকেলের লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেটিই মুরাদ মিয়ার বাড়ি।
ছোট্ট সুন্দর রাস্তা দিয়ে ওর বাড়িতে প্রবেশ করতেই ফুল-পাতা-লতাগুল্মের গুপ্ত একটা মিষ্টি ঘ্রাণের সাথে দোতালা থেকে যে প্রভাতী প্রশংসা-সংগীত ভেসে এল, তা যেন আমার মনটাকে মাতাল করে তুলল। গানটি প্রভাত-বেলায় আমিও শুনি মাঝে মাঝে, একটি অপ্রচারিত রবীন্দ্রসংগীত। ষষ্টি তালে গাওয়া হয়, ভৈরবী রাগে। কিন্তু এমন মনপ্রাণ আচ্ছন্ন করে না তা অন্য কারো কণ্ঠে।
যখন গানটি আমার কানে এল, তখন বাজছিল তার প্রথম অন্তরা, ‘শোকে-দুখে তোমার বাণী/জাগরণ দেয় আনি’। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে পড়লাম সে সুরে। একট মৌমাছি পাশের ফুল থেকে এসে কী লোভে কী গান গেয়ে গেল তার ভিখারি-ডানায়, বুঝলাম না। দোতালার কণ্ঠ তখন গানটির মুখে ফিরে এল, ‘আনন্দ তুমি স্বামী/মঙ্গল তুমি/ তুমি হে মহা সুন্দর/জীবন নাথ’।
গানটির সাথে শুধু ভক্তিরস ছড়িয়ে দিয়েছিল একটিমাত্র যন্ত্র, হারমোনিয়াম। বুঝলাম এটা কোনো সিডি নয়, কেউ কণ্ঠে গাচ্ছেন। কণ্ঠটি আমার পরিচিত বটে, কিন্তু যার কণ্ঠ মতো লাগছে তিনি যে গান গাইবেন, আবার রবীন্দ্রসংগীত—তা তো আমি কল্পনায়ও আনতে পারিনি। সে কন্ঠ আমি ছোটোবেলা থেকে ষোলটি বছর প্রতিদিন বহুবার শুনেছি। এখনও মাঝে মধ্যে শুনি সেল-ফোনে। যতই বয়স হোক ওর, ও তো মুরাদের কণ্ঠ। কিন্তু যে ক্লাশ নাইন থেকে মুসাদ্দেক রহমাতুল্লাহির ওয়াজ শুনে গানকে হারাম মনে করে চিরজীবনের জন্য ত্যাজ্য ঘোষণা করেছিল, আজ বৃদ্ধ বয়সে সে গান গাইবে কেন ! আমি রেডিওতে গান শুনলে সে বিরক্ত হতো। বলত দোস্ত, বন্ধ কর গান, তুই আগুনের কাবাব হবি রে ভাই। আমি মৃদু হাসি দিতাম, গান থামাতাম না। পুরুষ-কণ্ঠের গানে কিছুক্ষণ বসলেও, যেই মেয়ে কণ্ঠের গান হতো, সে কানে আগুল দিয়ে উঠে যেত। যেতে যেতে একটা আয়াত বা হাদিস পড়ে তার তর্জমা বাংলায় করতে করতে বলত, ‘নিশ্চয় গান হচ্ছে জিনার তুল্য অপরাধ’। বলত মুকাদ্দেস হুজুরের মতো আল্লার অলি যা কইছে, কোরান-হাদিস থেকে, তা মিথ্যা হতি পারে না। আমি জিনার পাপ করে কবরের মদ্যি আগুনের সাপের কামড় খাতি পারব না।
ওই ওয়াজ আমিও শুনেছি। আমার আব্বাও শুনেছেন। কিন্তু আমার আব্বা গান ভালোবাসতেন, শুধু শোনা নয়, গাইতেনও। রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুল গীতির কিছু কিছু প্রিয় অংশ। তবে খালি গলায়। আমাদের গ্রামে তখন হারমোনিয়াম-টাম কিছু ছিল না। আমি এই সত্তর বসর বয়সে এসে যখন বাড়ি যাই, তখনও এক চিত্র দেখি। বিশাল একটা মুসলিম গ্রামে আজ অব্দি কেউ কোনো হারমনিয়াম রাখেন না। তাঁদের কথা হুজুরদের কাছ থেকেই শোনা কথা। হারমনিয়াম হারাম, ঘরে রাখলে রহমতের ফেরেশতা সে ঘরে প্রবেশ করে না।
রহমতের ফেরেশতা কেন ঘরে আসেন, কী করেন ঘরে এসে, তাতে গৃহবাসৗ কি ভাবে লাভবান হচ্ছেন, এসব প্রশ্ন আমার মনে ওই ছোটোবেলা থেকে ছিল। আর বন্ধু মুরাদ ছিল আমার একেবারে বিপরীত। ক্লাশের ফাঁকে ফাঁকে সে নামাজ পড়ে নিত। বন্ধ বা ছুটিতে ওই বয়সেই তাবলিগে যেত। হুর-গেলমানের লোভ তার তেমন কিছু ছিল বলে মনে হয় না। ক্লাসে ফার্স্টবয় হিসেবে তার প্রতি মেয়েরা আকৃষ্ট ছিল স্কুলজীবনেই। কিন্তু সে ও-সবে পাত্তাই দেয়নি। লেখাপড়া আর নামাজ কালামেই সে পুরে রেখেছিল তার একরোখা মন। দোজখের সাপ-বিচ্ছুর ভয়ে সে বিচলিত হয়ে থাকত।
আমার গাড়ির সাড়া পেয়ে ভিতর থেকে একটা ছেলে বেরিয়ে এল। দেখলেই মনে হয় রাখাল-টাখাল। তাকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হলাম। লম্বাটে চিকুন, ঘনচুলের ছেলেটি মুরাদের গরু পালে আর এই বাগান বাড়ির গাছগাছালির যত্ন-আর্তি করে। বললাম, গান করে কে ?
স্যারে ?
কোন স্যারে ?
মুরাদ স্যারে।
আমার মাথায় এক মহাবিস্ময় ঘনিভূত হলো, মুরাদ গান করে !
মুরাদের বন্ধু পরিচয় দেওয়ায় সে আমাকে দোতাল নিয়ে গেল।
যেতে যেতে বলল, আপনি স্যারের বন্দু কুদ্দুস সাপ না ? আপনি যে আজ আইবেন তা মোরার জানা আছিল। স্যারে কইছিল। কিন্তু আপনি এত বোরে আইলেন কেমতে ? আপনের না ঢাহা থেইক্যা আসার কথা ?
ঢাকা থেকেই এসেছি।
এত্ত বোরে ! ঢাহা না মেলা দূর ?
না, এত দূর না। তুমি কখনো ঢাকা যাওনি ?
কেমনে যাইতাম ? কে লইয়া যাইবাম ? শুনছি ঢাহা নাকি খুব খারাপ জায়গা। নতুন পোলাপান রাস্তাত দেখলে বডি চোররা কৌশলে ধরি নি যায়। তারপর বেচবার জন্যি কলিজা ফ্যাপসা, কিডনি কাইটা নি মারইরা ফেলায় থোয়।
না না আত ভয়ের কিছু নেই। ঢাকায় প্রতিদিনই তো শয়ে শয়ে নতুন লোক আসে, যুবক বৃদ্ধ শিশু। অমন হলে কি কেউ আসত বলো ? তুমি একবার যাও, ভালো লাগবে।
ছেলেটি বলল, কেমনে যাইতাম, স্যারের চারটি গাবি আমার দেকতি অয়। দুইডা আবার গাবিন অইছে। তার সাথে গাচগাচালির যত্ন নিতে দিন কইটা যায় গা।
দোতালায় উঠে ছেলেটিকে বললাম, এবার তুমি যাও। স্যারে রে ডাকার দরকার নেই। আমি একা ঢুকতে পারব। গানটা শুনবার দাও আগে।
ততক্ষণে মুরাদ আর একটা গান ধরেছে, ‘প্রতিদিন তব গাঁথা গাবো আমি সুমধুর/তুমি দেহ মোরে কথা, তুমি দেহ মরে সুর।’
এ যেন সুর ও বাণীর মধ্য দিয়ে প্রভুর কাছে গলে গলে জীবনকে দ্রবীভূত করা। কী আন্তরিক, কী সে গভীর নিবেদেন।
গান শেষ হলে আমি সারা মুখে বিস্ময় ধরে তার রুমে ঢুকলাম। চোখ মেলে বলল, তুই এত ভোরে এসে গেলি ? আয় আয়। শিঘ্র আয়। বিচলিত আনন্দে সে আমার দিয়ে ছুটে এসে তার হারমনিয়ামের পাশে বসালো। বলল, আর মাত্র দুটি গান গাইব। আমার প্রভাতী প্রার্থনা তখন শেষ। তারপর তোরে নিয়ে সারা দিন কাটাবো রে। তুই তো আমার প্রাণের বন্ধু।
মুরাদ গাইল আরো দুটি গান। মুদিত নয়ন, ধ্যানমগ্ন মুদ্রা। স্বাস্থ্যবান ফর্সা মানুষটিকে গৌতম বুদ্ধের মতো লাগছিল।
প্রথমে গাইল, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’। পরেরটা, ‘কেন রে এ দুয়ারটুকু পা হতে শংসয়, জয় অজানার জয়’।
আমি ওর মুখে চেয়ে আছি। ছোটোবেলা থেকে সিজদা দিতে দিতে করা নামাজের দাগ, যেটুকু দেখেছিলাম চার বছর আগেও, ওর অফিসে, মতিঝিল সোনালি ব্যাংকের ব্যাবস্থাপকের চেয়ারে, সেটুকুও এখন আর অবশিষ্ট নেই।
বললাম, দোস্ত, তুই তো আমারে হতবাক করে দিলি ! তুই গান গাস্, তা-ও রবীন্দ্রসংগীত। অথচ তুই গান শোনা তো দূরের কথা, আমারেও শুনতে বারণ করতি। রবীন্দ্রসংগীকে বলতি কাফেরের গান, ব্যঙ্গ করতি, ‘গোবিন্দসংগীত’ সংগীত বলে, এ পরিবর্তন তোর হলো কী করে ?
মুরাদ বলল, দোস্ত সে অনেক দিনের কথা। ঠিক এগার বছর আগে বিলকিস, তোর ভাবি, চলে গেল। হেমন্তের এক কুয়াশা-রোদনের ভিজা সন্ধায় তাকে কবরে রাখলাম। তখন আমার উনষাট। তারপর সীমাহীন নিঃসঙ্গতায় পড়ল জীবন। ছেলেটাও ছুটে এসেছিল মৃত্যুর আগে। সেও একদিন চোখের জল মুছে ফিরে গেল আমেরিকায়। ওখানে সে গ্রীন কার্ড পেয়েছে। একটা ভালো ফার্মে চাকরি করে। যাওয়ার আগে বলল, তুমিও চলো বাবা ! তুমি বড় একা হয়ে গেছ, তোমারে কে দেখবে ?
বললাম, না বাবা আমি যেতে পারব না। আমি গেলে তোর মায়ের কবরটা কে দেখবে ? ওকে তো আমার বাড়ির আঙিনায় শুইয়েছি। এই যে প্রতি ভোরে গোলাপ ছায়ায় দাঁড়িয়ে তোর মায়ের জন্য তার কবরের পাশে বসে দোয়া করি, আমেরিকায় গেলে তো আমি তা পাবো না।
এখন ওই রাখাল ছেলেকে নিয়ে গাই পালি। গাইয়ের গায়ে চুলকিয়ে ভাব করি, ডাস মারি। বাছুরগুলোর সাথে খেলা করি। খোরা রোগে আমার একটা গাই মরেগিয়েছিল, ছোট্ট বাছুর রেখে। ওকে ফিডারে দুধ খাওয়াতাম, গলা জড়িয়ে আদর করতাম। ওর মা ওর শরীর চেটে দিও। আমিও শিশু বাছুরটির শরীর চেটে দিতাম। একটা ফিলিং দেওয়া আর কি ! অবলা শিশু-প্রাণী যেন মায়ের অভাব কম মনে করে। ও তো এখন বড় হয়ে গেছে। তবুও আমার সাথে কী খাতির তুই দেখতে পাবি। এখনো আমার কাছে আসে চাটা খেতে, গলা উঁচিয়ে আদর নিতে। আমার আদরে অবহেলা এলে ও আমাকে আলত আলত করে গুতা দেয়। বুঝায়, তুমি তো আদরে মনযোগ দিচ্ছ না। একেবারে মানুষের মতো আচরণ করে বাছরুটি। গাভিগুলোও আমার নেউলা।
দারুণতো মুরাদ ! এমন বন্ধু পেলে কে বিদেশে যায় ? তারপর এমন একটি নিরিবিলি বাড়ি। ফুল-ফলের স্নিগ্ধ সমাহার। তো আরো ভালো হতো, তুই যদি একটা বিয়ে করতি। আসলে যাই বলিস এ বয়সে একজন সাথি থাকা দরকার।
মুরাদ বলল, এ কথা অনেকেই বলে। ছেলে তো নিজে বলতে বিব্রত বোধ করে, সে তার খালুকে দিয়ে বলায়। কিন্তু ইতোমধ্যে যে আমি রবীন্দ্রনাথকে পেয়ে গেছি। শুধু তাঁর গান করা নয়, তাঁর জীবনীও আার প্রিয় পাঠ্য। লোকটির স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে। তখন ওঁর বয়স মাত্র একচল্লিশ। জমিদার পুত্র, ততদিনে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছেন। সারা বিশ্বে তাঁর খ্যাতি ছড়াতে শুরু করেছে, অথচ তিনি আর বিয়ে করলেন না। আর আমার স্ত্রী গিয়েছে উনষাট বছর বয়সে। এখন সত্তুর। বল কী জন্য বিয়ে করব ?
আমি বলতে পারতাম অনেক কথা। জবাবে সে হয় তো বলত আরো অনেক কথা। হয় তো বলতো নতুন বউ ঘরে এলে তাঁকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হতো। পুরানো প্রেমের স্মৃতি ফিকে হতে হতে মুছে যেত। গোলাপ-ছায়ায় ঘুমানো স্ত্রীর কবরে আর কোনো আকর্ষণ থাকতো না। গোলাপের সাথে ভেসে আসত না বিগত জীবনের হাসি-আনন্দের গন্ধ, কান্নার বেদনামথিত সৌরভ। হয় তো গোবৎসের আদরে অবহেলা হতো, এই সব।
আমি তাই ও-সব কান্না-ধোওয়া কাহিনী এড়াতে প্রসঙ্গ পালটালাম, তা তুই রবীন্দ্রভক্ত হলি কি করে তাই বল ?
একটু পোজ নেয়। একটু চোখ বোজে। তারপর বলে, এক্ষেত্রেও আমার ওই এতিম গোবৎসকে ক্রেডিট দিতে হয়। ওর মা ওর জন্মের মাত্র তিন দিনের মাথায় মরে যাওয়ার পর, কয়েকজন মজুরকে বাড়িতে আনাই। তারা গরুটার মৃতদেহ চার পা বেঁধে বাঁশে করে ঝুলিয়ে নিয়ে চলে যায় দূরের এক ভাগাড়ের উদ্দেশ্যে। বাড়ির মধ্যে ঢুকে তারা ওই পথ দিয়ে ওর মাকে নিয়ে যায় বলে অবলা বাছুরটি ওই পথে বেরনোর জন্য ছোটাছুটি করত। আর কাতর কণ্ঠে হাম্বা বলত।
আমি তা সহ্য করতে না পেরে ওর গলায় রশি বেঁধে রাস্তার নিয়ে ঘুরিয়ে আনি। দেখলাম কে যেন একটা গানের সিডি ছেড়ে রাস্তার মুখে কালো রঙের একটা গাড়ি রেখে গান শুনছে। সে কী গান ! আসলে গান নয় মনে হয়েছিল দৈব বাণী। স্ত্রীহারা আমি, আর মাতৃহারা বাছুরটার জন্য গানটি কবি রচনা করে রেখে গেছেন যেন। বাছুরটা বুঝল না। আমি তো বুঝলাম। গানটির দৈব সুর যখন আমার সন্তপ্ত কানে এসে লাগল, আমার পক্ষে আর কানে আঙুল দেওয়া সম্ভব হলো না। চোখ জলে ভরে গেল। সেই চোখের জলে নবজীবনের অঙ্কুর গজালো। আমি বাছুরটির দড়ি ধরে গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। গানটি শেষ হলে ভিতরের তরুণকে বললাম, বাবা, আপনার বাজানো গানটি শুনে আমার মনটি জুড়িয়ে গেল। এই গান কোথায় পাওয়া যাবে ?
ছেলেটি বলল, আপনি কাঁদছেন কাকা ? কেন কাঁদছেন ?
বললাম, বাবা কান্নার অগাধ জলেই ডুবে গেছে আমার দুখী জীবন। আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে গেছে কদিন আগে। সে এখন ও-পারে, আমি এ-পারে। তাই।
ছেলেটি একটা টিপ দিল গাড়ির বোতামে, তার সামনেই সে বোতাম। সিডিটা বেরিয়ে এল। সে একটি খাপে ভরে গাড়ি থেকে নেমে এল। বড় আদবের সাথে সিডিটি আমার হাতে দিয়ে বলল, চাচাজি, এই নেন সিডি এখানে মোট দশটি গান আছে। আপনার ভালো লাগবে।
তারপর বলল, চাচা, রেকর্ড প্লেয়ার আছে তো ?
বললাম, না বাবা, কিনে নেব।
ছেলেটি বলল, কাল এসে আপনাকে একটা রেকর্ড-প্লেয়ার দিয়ে যাবো।
বললাম তোমারটা দিলে, তোমার কমতি হবে না ? সখের জিনিস তো। আমি কিনে নিব।
ছেলেটি বলল, চাচা আমার বাসার কাছেই সিডি প্লেয়ারের দোকান। আমি কিনে নিব। আর আপনার কষ্ট করে প্লেয়ার কিনতে হবে না। আমার বাড়িতে একটা এক্সট্রা আছে,।
ছেলেটি আর দাঁড়াল না।
একটি হাই তুলে মুরাদ বলে, ছেলেটি কত যে ভালো ! ঠিক পরের দিন একটা রেকর্ডপ্লেয়ার নিয়ে হাজির। এক্কেবারে নতুন। আমি তার হাতে দু হাজার টাকা গুজে দিতে চাইলাম। বললাম, আমি তো এর দাম জানি না। দাম আরো বেশি হলে বলো, আমি দিয়ে দেই।
ছেলেটি নিষ্পাপ হাসি হেসে বলল, চাচাজি এর এত দাম নয়। আপনি চালান। গান শুনুন। এতেই আমার সকল দাম পাওয়া।
ছেলেটি কোনো টাকা না নিয়ে দ্রুত গাড়ি ছাড়ল। নিজেই প্রাইভ করে। আমি ওর গমন পথে কৃতজ্ঞচিত্তে তাকিয়ে থাকলাম।
এরপর দোতালয় ফিরে আগের দিন দেওয়া সিডিটা ধরলাম। দেখলাম,রবীন্দ্রনাথের ছবি-আঁকা রেকর্ডটির খাপের একেবারে শেষ গানটি আমার সেই ভালোলাগা গান, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’ গেয়েছেন দেবব্রত বিশ্বাস নামক একজন শিল্পী।
সারা মুখে আলোর ঝলকানি এনে মুরাদ আবার শুরু করল, আমি তো তখন সিডি টানা শিখিনি, তাই সিডিটা শুরু থেকে ছেড়ে দিয়ে কান পেতে রইলাম শেষ গানটির জন্য। কিন্তু এ কী বিস্ময় ! প্রতিটি গানই যে আমাকে বিবশ করে দিচ্ছে ! প্রথম গানটা শুনে মনে হল, কেন এত অকারণ মৃত্যুভয়ে ভুগি ! এই মহা কবির এ গানটি তো আমার ভয় হরণের মন্ত্র, ‘কেন রে এ দুয়ারটুকু পার হতে শংসয়’। জীবনের খিড়কি পেরিয়ে যে নতুন ঘরে যাবো, কবরে, সে তো শূন্য নয়। দুদিনের এই ঘরে যদি আমার এত ভালোলাগা, আমার চিরকেলে বসতিটা শূন্য হবে কেন ?
মুরাদ চুপ হয়ে গেল। শেষ বাক্যে সে স্থির হয়ে রইল অন্তত তিন মিনিট। আধ্যাত্মিকতার অরূপ আবীর সারা মুখে মেখে দিল কে যেন, যেন তার ভিতর থেকে। তারপর কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল, সেই আমার শুরু। আর ছাড়িনি রবীন্দ্রনাথকে। আমি অনেক বই কিনেছি তাঁর। কিনেছি তাঁর সমগ্র স্বরলিপি। একদিন বিজ্ঞাপন দেখে এক গানের শিক্ষককে ফোন করলাম। তিনি এলেন। আমি বললাম, আমাকে গান শেখাবেন ? বয়সটা একটু বেশি হয়েছে, তবুও শিখতে চাই।
সহাস্যে শিক্ষক বললেন, চাচা বয়স কিছু নয়, গান শিখতে চাই অনুরাগ এবং আগ্রহ। আপনার নিশ্চয়ই তা আছে। হারমোনিয়াম আছে তো ?
না। তবে আজই কিনব। যদি আপনি কাল থেকে আসেন।
গানের শিক্ষক কথা দিলেন।
এখন আর মুরাদের শিক্ষক লাগে না। গীতবিতানের যে গানটি তার মনে ভর করে, সে গানটির সরলিপি খুলে সে নিজেই গায় হারমনিয়ামে।
বললাম, তোর পুরানো সব অভ্যাস ত্যাগ করে এমন করে রবীন্দ্রনাথে মগ্ন হয়ে গেলি ? কপালের দাগটি যে তোর বিলিন হয়ে গেল রে ? তুইই না বলতি এই কালো দাগ হাসরের মাঠে হীরার মতো জ্বলজ্বল করবে ? ও নাকি বেহেশেতের চাবির গোছা ?
যাঁরা সরল বিশ্বাসে তা পালন করবে তারা তা পাবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে মনে-প্রাণে বরণ করলে আর কোনো প্রর্থনার দরকার হয় না। তাঁর গানতো আমাদের অলৌকিক জগতের সাথে একাকার করে দেয়। জীবনপতির সাথে আত্মার যোগসূত্র ঘটায়।
এরপর মুরাদ হাতের ইশারায় তার বুক-শেলফের কাছে নিয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের বই দিয়েই ঠাসা সে শেলফ। তার ভিতর থেকে ‘রবীন্দ্রনাথ : আশ্রয়ের ছায়াতল নামে একটি বই বের করল। আমার হাতে দিয়ে বলল, বইটি বাংলা একাডেমি বের করেছে। পড়তে পারো। দেখবে এক জায়গায় লেখক লিখেছেন সুরেন করের কথা। ভদ্রলোক ‘শান্তিনিকেতনের স্থাপতি’ হিসেবে সুখ্যাত ছিলেন। বৃদ্ধ হলে অবসর নিয়ে তিনি ছেলের কাছে কাশিতে চলে যান। বন্ধু বৃদ্ধরা তাঁকে বলত, ‘এখন তো যাবার সময় হলো, এবার একটু মন্দিরমুখী হও।’ সুরেন কর বলতেন, আমি রবীন্দ্রনাথকে দেখেছি, তাঁর হাত ছুঁয়েছি, আমার আর কোনো দেবতা দর্শনের দরকার নেই’।
মুরাদের ঠোঁটে এক টুকরা হাসি। বলল, আমার এখন সুরেন করের দশা। আমি রবীন্দ্রনাথকে দেখিনি, তাঁর হাত ছুঁইনি বটে, আমি তাঁরই গানের ভিতর দিয়ে প্রতিদিন তাঁকে দেখি, প্রতিদিন তাঁকে ছুঁই।
লেখক : সাবেক সচিব ও কবি ।